কেমন ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে আমাদের শিশুরা?

কাঁধে করে বিদ্যালয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। চিন্তা করে দেখলাম ব্যাপারটি ভালইতো। সকালবেলা মানুষের মস্তিষ্ক খুবই সতেজ থাকে,তাই কর্মোদ্দিপনাও দিনের অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে। আর তা নিঃসন্দেহে সহজেই পাঠদান বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু,আবার সন্ধ্যা বেলা যখন দেখি সেই ছাত্রছাত্রী গুলোই ব্যাগ কাঁধে করে অবসন্ন মন আর ক্লান্তিমাখা দেহ নিয়ে ঘরে ফিরে তখন আমি নিতান্তই অবাক হই!! একটি ছেলে কী সারাদিনই জ্ঞান অন্বেষণে থাকে? ব্যাপারটি আসলে মোটেও তা নয়! বরঞ্চ সে সমস্ত দিনটি পরিবার কর্তৃক চাপ প্রয়োগের ফলে,শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভাল ফলাফল অর্জনের নিমিত্তে নিজ বিদ্যালয় ছাড়াও একাধিক কোচিং সেন্টারে কাটিয়ে দেয় (তবে, এক্ষেত্রে তারা একান্ত মৌলিক কাজগুলো করার কিছুটা অবকাশ পায়)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ছাত্রের সফল ভবিষ্যতের জন্য কী এগুলোই যথেষ্ঠ? উত্তরটা হচ্ছে, মোটেও না। বরঞ্চ সে তার প্রকৃত শিক্ষা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। পৃথিবীর মহা-মনীষীদের মতে একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য মূল্যবোধ সৃষ্টি হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর মূল্যবোধ সৃষ্টি হয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা থেকে। কিন্তু আমাদের শিশুদের সেই সুযোগটা কোথায়? ওরা’তো ওদের সমস্ত দিনটাই পার করে দিচ্ছে বিদ্যালয়ের পুঁথিগত বিদ্যা আহরণে!! যদিও গ্রামাঞ্চলে মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম এখনও ধর্মীয় শিক্ষার্জনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।
আমার পাশের বাসার একটি ছোট্ট মেয়ে খুব ছোটকাল থেকে কার্টুনের প্রতি প্রচন্ড আসক্ত ছিল, যখন সে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল তখন সে তার আশেপাশের মানুষগুলোকে তার দেখা কার্টুনের চরিত্র ভাবতে শুরু করল, সে বাবা-মা, ভাই-বোন এর পরিবর্তে তার প্রিয়জনকে বিভিন্ন কার্টুন চরিত্রের নামানুসারে ডাকতে শুরু করল, এক পর্যায়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হলে জানা গেল সে নিজেকে একটি কার্টুনের জগতের মধ্যে চিন্তা করে, এমনকি সে এর বাইরে কিছু চিন্তাও করতে পারে না!! ফলস্বরুপ সে এখন একরকম বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের মতো জীবন কাটাচ্ছে!! এর মূল কারণ তার সঠিক মানসিক বিকাশ হয়নি। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে সুস্থ বিনোদন অত্যন্ত কার্যকরি একটি পন্থা, যেমন: পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কর্মকান্ড এবং খেলাধুলা মানুষের সৃজনশীল মানসিকতাকে বিকাশ করে। এজন্য শিশুদের এসব কাজের যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া সবার একান্ত দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে তাদের সেই সুযোগ ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে শিশুরা বিকল্প পন্থা হিসেবে কার্টুন, ভিডিও গেমস প্রভৃতির প্রতি মারাত্মক ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। যা শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ করা, চিন্তার পরিসরকে সংকুচিত করার পাশাপাশি ভয়াবহ মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৬ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভুগছে!!


নিজ কক্ষে বসে ছিলাম, হঠাৎ অদূরবর্তী কোনো স্থান থেকে কচি-কাচাদের সম্মিলিত কন্ঠে হিন্দি গানের সুর ভেসে আসল, কন্ঠ শুনে যতদূর মনে হলো, যারা গাচ্ছিলো তাদের সবার বয়সই ৭/৮ বছরের কম। এটা সহজেই অনুমেয় যে তারা তাদের অভিভাবকদের সংস্পর্শেই ছিল। এটি হচ্ছে আমাদের সমাজের শিশুদের উপর বিদেশি অপসংস্কৃতির করুণ আগ্রাসনের একটি খন্ডচিত্র, পাশাপাশি অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতারও একটি দৃষ্টান্ত। এভাবেই ধীরে-ধীরে বিদেশি অপসংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির জায়গা দখল করছে। আর শিশুরাও ক্রমশই সুস্থ সংস্কৃতির বদলে ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতির দিকে ঝুকছে। এর দায়ভারও কিন্তু সমাজকেই নিতে হবে!!
বাস্তব জীবনের এরকম শত-শত উদাহরণ প্রতিনিয়তই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে আজকের কোমলমতি শিশুদের ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা। যদি আমরা এখনই এসব বিষয়ের প্রতি খেয়াল না করি এবং জনসচেতনতা তৈরি না করি, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই আমরা মানসিক দিক বিবেচনায় একটি পঙ্গু জাতিতে পরিণত হব।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *