কুরবানী : আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মোক্ষম সুযোগ

মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করে যে দুনিয়ার সব সভ্য জাতি ও সম্প্রদায় কোনোনা কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ বা কুরবানী করতেন। কুরবানীর বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। আর এসবের উদ্দেশ্য ছিল একটাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ্জ : ৩৪)
কুরবানী কি? আরবি ‘করব’ বা ‘কুরবান’ শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে কুরবানী নামে প্রচলিত আছে। অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। কুরআনুল কারিমে কুরবানীর একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
(ক) ‘নাহর’ অর্থে; আল্লাহ বলেন ‘সুতরাং, আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কুরবানি আদায় করুন (কাওসার : ২)। এ কারণে কুরবানীর দিনকে ‘ইয়াওমে নাহর’ বলা হয়।
(খ) ‘নুসক’ অর্থে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআ’ম : ১৬২) ।
(গ) ‘মানসাক’ অর্থে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন; আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানীর বিধান রেখেছি।’ (সুরা হজ্জ : ৩৪)।
(গ) ‘আধাহী’ অর্থে। হাদিসের ভাষায় “আধাহী” অর্থে কুরবানির ঈদকে ‘ঈদ-উল-আদহা’ বলা হয়।
আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কোরআনে পাকের বিভিন্ন আয়াতে তার প্রিয় হাবিবকে কুরবানী করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী করা, ত্যাগ স্বীকার করা, উৎসর্গ করা ইত্যাদির নাম হচ্ছে কুরবানী। ইমাম আবু হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু সহ অধিকাংশ ইমামদের মতে কুরবানী করা ওয়াজিব। আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর ব্যাপারে অত্যন্ত যতœবান ছিলেন, এবং সারা জীবন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কুরবানী আদায় করেছেন। হাদীস শরীফে এসেছে: ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদীনায় দশ বছর থেকেছেন এবং প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। (আহমদ ও তিরমিজি)।
কুরবানীর প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন শরীফে ইরশাদ করেন :
অর্থাৎ-আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের মাংস এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং, আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্ম পালনকারীদের। (সুরা : আল হাজ্ব : ৩৭)


পশু কুরবানি করা হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
অর্থাৎ- বল আমার সালাত (নামাজ), আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মরণ বিশ্বজাহানের প্রতিপালক কেবল আল্লাহর জন্য। তার কোন অংশিদার নেই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর আমিই প্রথম মুসলিম। (সূরা আল আনআম: ১৪২-১৪৩)
কুরবানী হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে শুরু হলেও মুসলিম উম্মাহ কুরবানী মূলতঃ হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এবং হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের স্মৃতিময় সুন্নতের অনুসরণেই করে থাকে। পিতা পুত্র কঠিন এক পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে ধন্য হয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ বয়সে কঠিন পরীক্ষায় ধৈর্যের সাথে হয়ে মালিক ও মাওলার নৈকট্য লাভ করেছিলেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন : ‘যখন ইব্রাহিম আলাইহিস সালামকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’ (সুরা বাকারা : ১২৪)
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কুবানীর নির্দেশ পালন করা এবং সে বিধান বাস্তবায়নে তাঁর মানসিকতা আল্লাহর নিকট কবুল হয়েছিল। ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নৈকট্য লাভের এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করেননি; তাইতো তিনি উপাধি লাভ করেছিলেন ‘খালিলুল্লাহ’!
আল্লাহ তাআলার খালিল, ইব্রাহিম আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা মুসলিম উম্মাহকে যে শিক্ষা দিয়েছে তা হলো ‘কুরবানী শুধু লোক দেখানোর জন্য নয় বরং পশুকে জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
ঈদুল আদহার অন্যতম একটি কাজ হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু কুরবানী করা। এই কুরবানী আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণাধারায় মানবতাকে পুণ্যসিক্ত ও সমৃদ্ধ হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। প্রকৃত কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দা’র দূরত্ব ঘুচে যায়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতুবন্ধের মাধ্যমে দুনিয়ায় অঝোর ধারায় নামে রহমতের বারিধারা। কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর ডাকে নিষ্ঠার সঙ্গে সাড়া দেয়া মানুষের সৌভাগ্য ও শান্তি সুনিশ্চিত হয়। ঈদুল আদহার কুরবানী বান্দাহর প্রতি স্রষ্টার এক বড় অনুগ্রহ। পাপ-তাপে দগ্ধ মানুষের করুণাসিক্ত হওয়ার বিরাট সুযোগ। মুসলমানদের পাপে ভরা মৃত জীবনবৃক্ষ সজীব হয়।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করুন। কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার সুযোগ দান করুন। আমিন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *