কবি আল মাহমুদের কবিতায় ধর্মীয় চেতনাবোধ

আধুনিকতার অবক্ষয়ী চেতনার বিপরীতে নিঃসঙ্গ ও আত্মমগ্নতাই আল মাহমুদের কবিতার উপজীব্য। ছন্দ-নির্বাচন, আঙ্গিক ও অলঙ্কারের পাশাপাশি বিষয় নির্বাচনে আল মাহমুদ ঐতিহ্যিক-মিথাশ্রয়ী। এর সঙ্গে স্বকালচেতনায়ও প্রোজ্জ্বল। আল মাহমুদ জীবন ও কবিতাকে দেখেছেন অভিন্ন দৃষ্টিতে। স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতা বোধের যুগ্ম-স্বাক্ষর রয়েছে তার কবিতায়। রাজনৈতিক চেতনা তাকে করে তুলেছে জনবান্ধব। সেই সঙ্গে ইসলাম ধর্মের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ও ভালোবাসার কথা ফুটে উঠেছে তার অসংখ্য কবিতায়। কেবল গ্রামীণ জীবন-যাত্রা, নাগরিক বোধ, প্রকৃতি, নারী, মানবপ্রেমই নয়; ধর্মীয় চেতনাসমৃদ্ধ কবিতার বিপুল অংশ প্রচ্ছন্ন রয়েছে তার কবিভাণ্ডারে।
১৯৩৬ সালে জন্ম নেয়া আল মাহমুদ লেখালেখি শুরু করেন ৫০ দশকে। প্রথমদিকে তার লেখায় বামপন্থী মনোভাব ও মার্কসবাদি চিন্তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসী হিসেবে পরিলক্ষিত হলেও আস্তে আস্তে তা পরিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ ইসলামি ভাবধারায় চলে আসে। তিনি নিজেই বলেন, ‘আমি যে পরিবারে জন্মেছি তারা সবাই ছিল খুবই ধর্মপ্রবণ লোক। কীভাবে যেন তাদের মধ্যেই যে রয়েছে সত্যিকারের পথের ঠিকানা এটা আমাকে দূর থেকে ইশারায় ডাকতো’।
ইসলামের প্রতি প্রবল অনুরাগের চিত্র ফুটে উঠেছে তার কবিতার পংক্তিতে। নাস্তিকতার পরিমণ্ডল থেকে সরে গিয়ে তিনি নিজের পরিচয় লিপিবদ্ধ করেন- ‘হে মোহান্ত, তেমন কোনো শব্দ জানো কি/যার উচ্চারণকে মন্ত্র বলা যায়?/হে মোয়াজ্জিন, তোমার আহ্বানকে/কী করে আজান বলো, যা এতো নির্দিষ্ট।/আর হে নাস্তিক/তোমর উচ্চকণ্ঠ উল্লাসকে কোন শর্তে আনন্দ বলো/যা এত দ্বিধান্বিত/তাই আমি নাস্তিক নই।’
শব্দের নিপুণ বিন্যাসে বিশ্বাসবাদীদের ব্যবচ্ছেদ করে উচ্চারণ করলেন- ‘আমি জনমানবহীন বিরান নগরীর পরিত্যক্ত পাথরে/আল্লার আদেশ পরিত্যাগ করতে পারি না। আমি/ধ্বংসস্তূপের ওপর থেকে কাছে নেমে এলাম’। (মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)
কবি আল মাহমুদের শেষ দিকের কবিতাগুলোতে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিকতায় কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কাব্যগ্রন্থের ‘সবুজ ঈমান’ কবিতায় লিখেছেন-‘নগরে প্রচার করে পরিপূর্ণ পল্লবের ভয়।/অথচ ঘুমের মধ্যে করা যেন, মানুষ না জিন/আমার কবিতা পড়ে বলে ওঠে, আমিন, আমিন।’
‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’ কবিতার অন্তর্গঠন-বহির্গঠন সর্বত্রই খেলা করছে ধর্মবোধ। কবি এখানে ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় খুঁজে বলেন- ‘সালাত ভাঙলো। আমিন, আমিন-/প্রতিটি মসজিদ থেকে তাঁরা বেরিয়ে পড়েছেন। যেন কেউ/ওমরের গণকোষাগার থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন হিসেব করা দীনার।’
নির্ভীক কবি ‘সাহসের উপমা’ কবিতায় বলেছেন- ‘সাহস হলো, বিদ্যুৎ চমকের মতো বিপদ আর মানুষের অসহায়তার ওপর দিয়ে যা হৃদয়ের ভেতরে সঞ্চারিত হয়।/কিংবা ঈমানের উপমা হলো সাহস।’ অনাচার ও অত্যাচারে ভরপুর ধরণী দেখে কবি ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কবিতায় লেখেন- ‘মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি; আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।’
সত্য ও ন্যায়ের কবি ‘আমাদের মিছিল’ কবিতায় এক শ্বাস্বত পথ চলার কথা বলেছেন- ‘আমাদের এ মিছিল নিকট অতীত থেকে অনন্ত কালের দিকে আমরা বদর থেকে ওহুদ হয়ে এখানে, শত সংঘাতের মধ্যে এ কাফেলায় এসে দাঁড়িয়েছি। কে জিজ্ঞেস করে আমরা কোথায় যাবো? আমরা তো বলেছি আমাদের যাত্রা অনন্ত কালের। উদয় ও অস্তের ক্লান্তি আমাদের কোনদিনই বিহবল করতে পারেনি।’
হজরত নূহ (আ.) এর ঘটনাকে অবলম্বন করে লেখেন- ‘পৃথিবীর চিহ্ন নিয়ে যদি ফেরে আশার কপোত/গভীর আদরে আমি তুলে নেবো ফসলের বীজ/ আল্লাহর আক্রোশ থেকে যা এনেছি বাঁচিয়ে যতনে/ আবার বুনবো তা-ই পুণ্যসিক্ত নতুন মাটিতে।/ তোমাকে জড়াবো বুকে হে প্রেয়সী, তোমাকে কেবল/রক্তের উত্তাপ দেবো, প্রেম দেবো, গান দেবো বেঁধে,/ তোমাকে ফসল দেবো, গৃহ দেবো, তৃপ্তি দেবো নারী।/আপনাকে শান্তি দেবো আর নূহ, শক্তি দেবো আমি’। (নুহের প্রার্থনা)
তিনি কবিতায় কোরআন থেকেও বিভিন্ন কাহিনীকে অবলম্বন করেছেন। যেমন- ‘অলৌকিক স্পর্ধা দাও। ঈশ্বরের অপরূপ ফল/আমি যেন বিদ্ধ করে নিতে পারি। যেন/ভাগ করে দিতে পারি/আমার সে প্রিয়তমা নারীকে কেবল’। (অন্ধকারে একদিন) এই কাহিনী তিনি কোরআনের আদম-হাওয়ার নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ঘটনা থেকে নিয়েছেন।
পবিত্র রজনী রাইলাতুল কদর সম্পর্কে লিখেছেন- ‘হে আল্লাহ/হে সমস্ত উদয়দিগন্ত ও অস্তাচলগামী/আলোকরশ্মির মালিক/
আজকের এই পবিত্র মহাযামিনীর সব/ রকম বরকত আমাকে দাও’। (কদর রাত্রির প্রার্থনা)
কোনো কোনো সুরার ভাবানুবাদও করেছেন কবি আল মাহমুদ। কখনও মাত্র কয়েকটি আয়াত নিয়ে রচনা করেছেন সুবিশাল কবিতা। সুরা ইউসুফের তৃতীয় ও চতুর্থ রুকু নিয়ে ‘জুলেখার আহ্বান’ এবং ‘ইউসুফের উত্তর’ নামে একশর বেশি চরণের দুটি বিশাল কবিতা লিখেছেন।
সুরা নমলের হুদহুদ পাখির ঘটনার আলোকে তিনি লিখেছেন ‘হুদহুদ পাখির কৈফিয়ত’- ‘ও রাজা সোলেমান,/
কেন আমার একটু এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানোতে আপনি এমন তিতিবিরক্ত?/
আল্লাহ আপনাকে মানুষের, জিন ও হাওয়ানদের রাজা বানিয়েছেন’।
প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি গভীর ভক্তি প্রকাশ করে লিখেছেন-
‘লাঞ্ছিতের আসমানে তিনি যেন সোনালি ঈগল/ডানার আওয়াজে তার কেঁপে ওঠে বন্দির দুয়ার;/ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় জাহেলের সামান্য শিকল/ আদিগন্ত ভেদ করে চলে সেই আলোর জোয়ার’। (হজরত মুহাম্মদ)
‘সক্রেটিসের মোরগ সোনা’ কবিতায় ইহুদি সম্পর্কে লিখেন- ‘ইহুদিরা হাসুক,/তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।/ইহুদিরা নাচুক, তবু/ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন। আর মানুষ মানুষের ভাই’।
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বিশিষ্ট সাহাবী হজরত আবু জর গিফারি (রা.) এর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করে লিখেন- ‘আমি কৃষণ ছায়া সঙ্গিনী তোমার, হে গিফারী।/ সেই কালো খাপ, যাতে প্রবিষ্ট ছিলে/ ঈমানের তীক্ষè তরবারি তুমি।/সোনা ও চাঁদির পাহাড় নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে/ তুমি ছিলে পবিত্র কোরআনের তুফান।/ আমি বাতাসের বেগ নিয়ে তোমার ঝড়কে চুম্বন করি প্রিয়তম’।
কবিমানস কেবল আল্লাহ তায়ালারই সামনে সিজদাবনত হতো। তারই প্রমাণ পাওয়া যায় ‘নেকাব’ কবিতায়- ‘সিজদায় পড়ে থাকি। তোমার যাচনা করে মন/তসবী ঘুরিয়ে বলি, দাও তাকে। নেকাব সরালে যাব নীল/তিলের চিহ্নের জন্য তড়পায় আমার নিখিল’।
স্বপ্নে দর্শানো পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন নিয়ে লিখেছেন- ‘পৃথিবীর সর্বশেষ ধর্মগ্রন্থটি বুকের ওপর রেখে/আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হয় এ ছিলো সত্যিকার ঘুম/ কিংবা দুপুরে খাওয়ার পর ভাতের দুলিনি, আর ঠিক তখুনি/সেই মায়াবী পর্দা উঠলো যার ফাঁক দিয়ে/ যে দৃশ্যই চোখে পড়ে তোমরা বলো, স্বপ্ন’। (মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো)
আল মাহমুদের মনে মাওলানা জালাল উদ্দির রুমী (র.) এর ভালোবাসার যে আগুন জ্বলছিলো, তাঁর বিভিন্ন কবিতায় সে ভালোবাসার চিহ্ন ফুটে উঠেছে- ‘সরাসরি কিংবা ইশারা ইঙ্গিতে পাওয়া যায়, /ইশকের আগুনে বসে মাওলানা রুমীর গজল/গাও কি রুহের পাখি? নাকি কোনো সুফীর সাধনে/মেঘলোক ভেদ করে ছিন্ন করে নীলের চাদর/ অনন্তে সাঁতার কেটে ছুঁতে চাও ও-মুখাবয়ব’। (নেকাব)
জাহেলী যুগের শ্রেষ্ঠ কবি লাবিদ থেকে শুরু করে ইরানের খোমেনি এবং উপমহাদেশের ইকবাল, কাজী নজরুল ও ফররুখ আহমেদসহ মুসলিম ব্যক্তিত্ব কেউ বাদ যায়নি তার কবিতা থেকে। আসলে আল মাহমুদ তো তাদেরই যোগ্য উত্তসূরি। জাতীয় কবির ভাষায় বলতে গেলে, বীণা শুধু হাত বদল হয়েছে। নয়তো বীণার সুর ও ভাষা, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য এক ও অভিন্ন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *