সূফিজম বা তরীকত পন্থাই আনতে পারে বিশ্ব শান্তি

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যিনি আমাদেরকে সামাজিক জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। লাখো-কোটি সালাত ও সালাম দুজাহানের সর্দার, হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি।
গত কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইংল্যান্ড সফরে এসেছিলেন। সেসময় লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলী এরেনাতে প্রদত্ত ভাষণের এক অংশে তিনি বলেছিলেন, ‘সূফিজম হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক’। আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ কথাকে কোন দলীল হিসেবে পেশ করতে চাই না, কারণ আমাদের ধর্মের সবকিছুর দলীল কুরআনে কারীম এবং হাদীসে রাসূল থেকে উৎসারিত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সূফিজম সম্পর্কে যে সম্পূর্ণ সত্য একটি উক্তি করেছেন, তাঁর একটি কারণ হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম এসেছে সূফিজমের মাধ্যমে। সূফি সাধকদের আধ্যাত্মিক শক্তি ও চারিত্রিক মাধুরতা মানুষকে মোহিত করেছে, তাঁদের আদর্শিক সৌন্দর্য হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নির্বিশেষে সকল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইতিহাস জানেন, তিনি জানেন কিভাবে খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী (রহ.) ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছিলেন, কিভাবে খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) ইসলাম প্রচার করেছিলেন, কিভাবে হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রহ.) কোন রক্তপাত ছাড়াই, একজন মানুষকে খুন না করেই বৃহত্তর সিলেট, আসাম, করিমগঞ্জের লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করেছিলেন।
আজ কিছু সংখ্যক মুসলমানের উগ্র স্বভাবের কারণে, তথাকথিত বিপ্লবী মতবাদের কারণে মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী-টেরোরিস্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তাই এখন সময় এসেছে দুনিয়ার মুসলমানদেরকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এ উক্তি উপলব্ধি করার। সময় এসেছে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বুঝার। দুনিয়াব্যাপী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী তথাকথিত এ মুসলমানদের সম্পর্কে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এরা কোন দিন কোন পীর-বুযুর্গের দরাবারে যায় নাই। সূফিজম তথা তরীকতপন্থাকে তারা শিরক মনে করে।
আমাদের বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য করলেও বিষয়টি পরিস্কার হয়ে ওঠে। কয়েক বছর আগে আমাদের দেশে জেএমবি নামে ইসলামপন্থী একটি উগ্রাবাদী সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে। যারা মাজারে মাজারে বোমা ফেলে, মানুষ হত্যা করে ইসলাম কায়েম করতে চেয়েছিল। শাস্তিপ্রাপ্ত সেই বাংলা ভাই, কিংবা শায়খ আবদুর রহমান এরা কোন তরীকতপন্থী বুযুর্গের মুরীদ ছিলেন না। অন্য কথায়, হক্কানী তরীকতপন্থী কোন বুযুর্গের কোন মুরীদ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করতে পারেন না। রগ কাটার রাজনীতি করতে পারেন না। এর কারণ, পীরসাহেবগণ তাঁদের মুরীদদেরকে তা-ই শিক্ষা দেন যা আজ থেকে চৌদ্দশত বছর আগে রাহমাতুল লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। যে শিক্ষা হচ্ছে শান্তির শিক্ষা, যে শিক্ষা হচ্ছে মানবতার শিক্ষা, যে শিক্ষা সহানুভুতি ও ধৈর্য্যশীলতার শিক্ষা। তাই হক্কানী কোন পীর সাহেবের মুরীদকে কখনও রগ কাটতে দেখা যাবে না, কোন প্রকৃত মুরীদকে কখনও সুইসাইড বোমা নিয়ে কোন মার্কেটে কিংবা মসজিদে প্রবেশ করতে দেখা যাবে না।
এখন দেখা যাক ইসলামে সূফিজম কি আছে না নেই। ইসলামে তাসাউফ তথা সূফিজমের উৎস হচ্ছে হাদীসে জিবরাইল, যেখানে জিবরাইল (আ.) রাসূলে পাক (সা.) কে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘ইইসান কি?’ তখন আল্লাহর রাসূল জবাব দিয়েছিলেন, ‘ইহসান হচ্ছে এমন একটি পর্যায়, যখন তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তুমি অনুধাবন করবে যে তুমি আল্লাহকে দেখছ। আর যদি সে পর্যায়ে পৌঁছতে না পারো অন্ততপক্ষে এ বিশ্বাস রাখবে যে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।’ এটিই হচ্ছে তরীকতের মূল ভিত্তি। তরীকত, তাসাউফ কিংবা সূফিজম যে নামেই এটাকে আমরা ডাকি না কেন এটার প্রয়োজনীয়তা ইসলামের মধ্যে অনস্বীকার্য। কেননা ইবাদত কবূল হওয়ার শর্ত হচ্ছে আল্লাহর সমীপে অন্তরের উপস্থিতি তথা হুযুরে ক্বালব। আপনি সারাদিন নামাজ পড়েন কিন্তু আপনার মন আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট থাকে, আপনার নামাজ পড়া হবে ঠিক, কিন্তু আল্লাহর কাছে তার কোন প্রতিদান থাকবে না। অন্তরের এই পরিশুদ্ধি অর্জনের সাধনাকেই বলা হয় তরীকত বা আধ্যাত্মিকতা। আর এই পরিশুদ্ধি অর্জনের শর্ত হচ্ছে একজন কামেল মুরশিদের সান্নিধ্যে আসা। হযরত শাহজালাল (রহ.) যখন সিলেটে এসেছিলেন তাঁর সঙ্গী-সাথী সবাই তখন বুযুর্গ হয়ে গিয়েছিলেন, অথচ শাহজালাল (রহ.) এর সঙ্গী হবার আগে অনেকে এ পথের পথিক ছিলেন না। এ জন্য বুযুর্গ বা আল্লাহওয়ালা হতে হলে আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গী হতে হয়। যেভাবে একজন মানুষকে গাড়ি চালনা শেখার জন্য কেবল থিওরী বই পড়ে শেষ করলেই হয় না, একজন অভিজ্ঞ ইনস্ট্রাক্টরের কাছে হাতে কলমে শিক্ষা নিতে হয়, তেমনিভাবে কেবল কুরআন-হাদীস পড়া শিখলেই আল্লাহওয়ালা হওয়া যায়না, একজন অভিজ্ঞ মুরশিদের কাছে হাতে-কলমে আধ্যাত্মিকতার দীক্ষা নিতে হয়। এজন্য দেখা যায় ইসলামের ইতিহাসে যারাই আল্লাহওয়ালা হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই কোন না কোন বুযুর্গের কাছ থেকে আধ্যাত্মিকতার দীক্ষা নিয়েছিলেন। চার মাজহাবের ইমামগণও এ থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন না।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, দুনিয়ার মধ্যে ইসলামের নামে যারা আজ ফিতনা-ফাসাদ, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তারা যেমন কোন তরীকতপন্থী মুসলমান নয় তেমনি কোন মাযহাবপন্থী মুসলমানও নন। ইসলামের উত্তম যুগ থেকে মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে এবং দুনিয়ার হকপন্থী সকল মুসলমানের কাছে এ চারটি মাজহার গ্রহণযোগ্য হিসেবে গৃহিত হয়েছে। চার মাজহাবের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিংবা নিজের খেয়াল খুশি মত নতুন নতুন মাসআলার উদ্ভাবন করে এরা ইসলামকেই বিকৃত এবং বিতর্কিত করছে। প্রসঙ্গত সদ্য আবির্ভুত আইএস আইএস নামক জঙ্গী সংগঠন তারই প্রমাণ। ইদানিং একটি রিপোর্টে দেখা গেছে আইএস আইএস এর পাঠ্যবইয়ের তালিকায় লামাজহাবী সালাফী ওয়াহাবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদীর ‘কিতাবুত তাওহীদ’ কে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। তারাবীহর নামাজকে সংক্ষিপ্ত করা, লম্বা দিনে রোযাকে সংক্ষেপ করে নিয়ে আসা, ক্বাবলাল জুমু’আ-বা’দাল জুমু’আকে বাদ দিয়ে দেওয়া, শবে বরাতের ইবাদত থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা, আল্লাহর নবীর আগমনের দিনে খুশি প্রকাশের পরিবর্তে এটিকে বিতর্কিত করা তারই ধারাবাহিতকার প্রমাণ।
ইদানিংকালে আমাদের দেশে ‘গায়েবানা জানাযা’ নামাজ নামে নতুন ধরণের একটি জানাযার নামাজের উদ্ভাবন করা হয়েছে যা কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় কিংবা কোন মাজহাব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। আল্লাহর রাসূল (সা.) আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাসীর জন্য যে জানাযা পড়েছিলেন তাকে দলীল দিয়ে যে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য দ্বীনের মধ্যে একটি নতুন বিষয়কে আবিষ্কার করা হয়েছে সেটাই বড় বিদ’আত। অথচ মুহাদ্দিসীনে কেরামগণ আল্লাহর রাসূলের এ জানাযা পড়াকে গায়েবানা জানাযা বলেননি, কেননা আল্লাহর রাসূলের সামনে নাজ্জাশীর বাদশাহর লাশ গোপন ছিল না। তাছাড়া আল্লাহর রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করলেন, যে সমস্ত সাহাবী তখন মক্কা শরীফে কিংবা অন্যান্য স্থানে ছিলেন তাঁরা আল্লাহর রাসূলের জন্য গায়েবানা জানাযা পড়েছেন তার কোন প্রমাণ হাদীস কিংবা ইতিহাসে লেখা নেই, অথচ আল্লাহর রাসূল (সা.) তাঁদের কাছে নিজেদের আত্মার চেয়েও বেশি প্রিয় ছিলেন। এভাবে আল্লাহর রাসূলের (সা.) অনেক প্রিয় সাহাবী বিভিন্ন স্থানে শহীদ হয়েছিলেন আল্লাহর রাসূল তাঁদের জন্য কখনও ‘গায়েবানা জানাযা’ পড়েননি। ইসলামের ইতিহাসে চার মাজহাবের ইমাম কিংবা কোন বুযুর্গ-আউলিয়ায়ে কিরামের জন্যও কোন দেশে কোন কালে কেউ ‘গায়েবানা জানাযা’ নামে নতুন একটি বিষয়ের অবতারণা করেননি।
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে সেই শিক্ষা যা সাহাবায়ে কিরাম, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, সলফে সালেহীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন এবং আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। আমরা বাংলাদেশের বিশেষ করে সিলেটের মানুষ মুসলমান হয়েছি হযরত শাহজালাল (রহ.) এর মত বুযুর্গদের মাধ্যমে। তাঁদের দেখানো পথই হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত পথ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বর্ণিত সিরাতুল মুস্তাকীম-সরল সঠিক পথ। সেই পথ ও মত অনুসারে আল্লাহ পাক আমাদেরকে চলার তাওফীক দান করুন, আমাদের অন্তকরণকে ইলমে মা’রিফাতের নূরে আলোকিত করুন এবং তাঁর মনোনীত মানুষদের মত ও পথের উপর আমাদেরকে মৃত্যু দান করুন। আমিন।

Comments

comments

About

Check Also

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্তপ্রতীক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ইদানিংকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। জাতি সংঘ সহ সারাবিশ্বের সব দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *