ইসলাম, আমেরিকা ও মাওলানা রুমি

মাওলানা রুমি মুসলিম-অমুসলিম সবার কাছেই বিপুল জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। কারও কারও ধারণা প্রাচ্যের চেয়ে পাশ্চাত্যেই তাঁকে নিয়ে চর্চা বেশি। তিনি আমেরিকার সর্বাধিক বিক্রিত কবি বলে প্রসিদ্ধ। এদিকে মুসলিম দেশগুলোতে ক্রমে ক্রমে মূল ফার্সী চর্চা অনেকটাই বিলুপ্তির সম্মুখীন। তাই মসনভিয়ে রুমির চর্চাতেও যেন অনেকটা ভাটা পড়েছে। সেদিক থেকে ইংরেজি অনুবাদের জোরে রুমিচর্চায় পাশ্চাত্য অনেকটাই এগিয়ে। তবে মাওলানা রুমির অমুসলিম ভক্তরা তাঁকে কেবলই একজন মরমিবাদী মনে করেন। তাঁকে খাঁটি মুসলিম ও আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সুফি হিসেবে দেখতে যেন অনেকটাই নারাজ। এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ রুমি বিশেষজ্ঞ ইবরাহিম জামার্ড, যিনি নিজেও মৌলভিয়া সুফি তরিকার একজন শায়খ। মুরতাজালি দুর্গিচিলভের সাথে এক আলাপচারিতায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন কেন মাওলানা রুমি পাশ্চাত্যে এত জনপ্রিয় এবং পাশ্চাত্যে তাঁর ভক্তদের খুঁতগুলোই বা কোথায়? অনলাইনের একটি গণমাধ্যম থেকে সাক্ষাতকারটি অনুবাদ করেছেন- আব্দুল্লাহ যোবায়ের।
মুরতাজালি দুর্গিচিলভ : এমনটা বলা কি সম্ভব যে, বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে পাশ্চাত্যেই মাওলানা রুমির কবিতা বেশি জনপ্রিয়?
ইবরাহিম জামার্ড : হ্যাঁ। সম্ভব। তুর্কিতেও আমি একই কথা শুনেছি। আসলে ভাষা এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে সাধারণ মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্ম রুমির কবিতা খুবই কম পড়ছে। এর কারণ হল তারা তুর্কি অনুবাদগুলোর শব্দগুলো প্রয়োজনমাফিক বুঝতে পারছে না। সেসব অনুবাদে প্রচুর ফার্সী ও আরবি শব্দ আছে, যা এখন আর তুর্কি ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে না। আফগানিস্তানে কয়েক দশকের যুদ্ধ আর শিক্ষাব্যবস্থার ভগ্নদশার জন্য সেখানকার লোকেরাও তাঁর কবিতা আরও কম পড়ে। পাকিস্তান আর ভারতেও পুরোনো ফার্সি ভাষা শেখানোতে ভাটা পড়েছে। অবশ্য ইরানে এখনও রুমির কবিতার সমাদৃত, পড়াও হয় প্রচুর। ফার্সীভাষী অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন তাজিকিস্তান এবং অন্যান্য শহর যেমন বুখারা, সমরকন্দ- এদের কথা আমি জানি না। তবে আশা করি তাদের কাছে এখনও মাওলানা রুমির কবিতা সমাদৃত। অন্যদিকে মসনভির আরবি অনুবাদ হওয়ার পরও আরব বিশ্বে শত শত বছর ধরেই রুমির কবিতার প্রতি আগ্রহ অনেকটাই কম। রুমি নিজেই আরবিতে কিছু কবিতা লিখেছিলেন। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলোতে সেগুলোর পরিচিতি নিতান্তই কম।
দুর্গিচিলভ : পাশ্চাত্যে ইসলামবিরোধী মনোভাবের উত্থানের সাথে সাথে মাওলানা রুমীসহ অন্যান্য মুসলিম কবিদের বিপুল জনপ্রিয়তাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন? ইসলামিক কালচার অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এটাকে কি পশ্চিমারা পলিটিক্যাল ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রপঞ্চ মনে করেন?
জামার্ড : ইসলামবিরোধী মনোভাব থাকার পরও ইসলাম আমেরিকার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম। একই সাথে সেখানে তাসাউফের উপর আগ্রহও ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। অবশ্য এর কারণ হল, তাসাউফকে এমন এক ধরণের মরমিবাদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ইসলাম নির্ভর নয়, যা বিশেষ কোন ধর্মমতের উর্ধে।
আপনি জানেন বোধহয়, এসব অঞ্চলে যেমন মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম ছড়িয়েছে আঞ্চলিক সুফিবাদের ধারায়; পরবর্তীতে ইসলাম ও ইসলামী সুফিবাদের আরও মূলানুগ ধারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যা ছিল অনেকটাই স্বল্প-ইসলামি। একইভাবে আমেরিকাতেও জনপ্রিয় কিছু সুফি গোষ্ঠী আছে, যারা আমেরিকানদের কাছে আকর্ষণীয়। কারণ তারা স্বল্পই ইসলামী। রুমির কবিতা তুমুল জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ ঠিক এটাই। রুমি কবিতার বিশ্বস্ত অনুবাদ না করে সেগুলোকে জনপ্রিয়তার মোড়কে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে রুমি এমন একজন সুফি হিসেবে চিত্রায়িত, যিনি অল্পই ইসলামী ভাবধারার। একই কারণে আমার লেখা ‘রুমি এন্ড ইসলাম’ বইটি, যাতে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসায় রুমির নাতগুলোর অনুবাদ স্থান পেয়েছে, সেটি খুব অল্পই চলেছে। অনেক আমেরিকান রুমিকে ভালোবাসে কেবল স্বর্গীয় ভালোবাসা নিয়ে তাঁর ভাবাবেগপূর্ণ আধ্যাত্মিকতার জন্য; কিন্তু তারা চায় তিনি যদি মুসলিম না হতেন কিংবা হলেও যেন খুব সামান্য- বেশি কিছু না হন। এজন্যই রুমির বেশিরভাগ বই বাজারজাত করা হয় সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিকতা আর সর্বনি¤œ ইসলামের ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য। ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ সম্পর্কে আমেরিকানদের আগ্রহ বা সহানুভূতি খুবই কম। এরপরও এমনকি রুমির সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলো পড়েও তারা মুসলমানদের চিরায়ত অনেক নীতি ও তত্ত্বকথা শিখতে পারছে।
দুর্গিচিলভ : আপনি ১৯৮৪ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এটা কিভাবে ঘটলো? আপনি কখনও বুঝলেন যে, আপনি একজন মুসলিম হতে চান?
জামার্ড : আমি একজন খ্রিস্টান হিসেবে বেড়ে উঠেছিলাম এবং বাইবেলের একটি বাণীতে আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, যেখানে ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ। আমার ইচ্ছা নয়, আপনার ইচ্ছাই হোক।’ এজন্য আমি আসলে একজন মুসলিমই ছিলাম, যদিও আমি জানতাম না। পরবর্তীতে কলেজে আমি আধ্যাত্মিকতা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম, যা ছিল সাধারণ বোধবুদ্ধির অতীত চেতনার আধ্যাত্মিক স্তরসমূহ সম্পর্কে। কয়েক বছর পর বুঝলাম, যেসব আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আমি পড়েছি, সেগুলোর মধ্যে তাসাউফের দিকেই আমার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। অবশ্য তখন আমি বুঝিনি যে, তাসাউফ ইসলামেরই আধ্যাত্মিক মাত্রা। এরও বছর দশেক পরে ইসলাম সম্পর্কে আরও পড়াশোনার পর শেষপর্যন্ত আমি মেনে নিলাম যে, প্রকৃত সুফিরা আসলে একনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন এবং সুফি হওয়ার ইচ্ছায় আমি যদি একনিষ্ঠ হয়ে থাকি, তবে আমারও ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। আমি মুসলমান হলাম এবং দ্রুতই নামাযের প্রেমে পড়ে গেলাম। তখন যেহেতু কয়েকবছর ধরে ফার্সী পড়ছিলাম, তাই কুরআন পড়ার মতো চলনসই আরবি শেখাটা আমার কাছে সহজ হয়ে গেলো।


দুর্গিচিলভ : শুধু অনেকগুলো বইয়ের লেখক হিসেবে নয়, মৌলভিয়া তরিকার একজন শায়খ হিসেবেও আপনি বিখ্যাত। আপনার আধ্যাত্মিক সাধনা নিয়ে কিছু যদি বলতেন।
জামার্ড : এ বিষয়টা মনে হয় একান্ত থাকাই যথোচিত। তবে এটুকু বলবো, প্রতিদিন আমার মূল সাধনা হলো প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া এবং সারাদিনে যতবার সম্ভব আমার কলবে আল্লাহর নাম যতবেশি সম্ভব যিকর করা, যেমন কুরআন বলেছে- ‘তোমার প্রভূকে বেশি বেশি স্মরণ করো।’ (সুরা আলে ইমরান: ৪১) এরপর যখন সময় পাই, রুমিকে নিয়ে আমার ওয়েবসাইটে সংযোজন করি, ফার্সী ভাষায় তাঁর মসনভি পড়ি এবং আরবি ভাষায় কুরআন পড়ি অথবা শুনি।
দুর্গিচিলভ : ২০০৭ সালে আপনি মৌলভিয়া তরিকার একজন শায়খ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন। অভিষেক অনুষ্ঠানের কিছু বর্ণনা দিবেন কি?
জামার্ড : এটা কয়েকটি ধাপে হয়েছে। প্রথমত, আমি ইস্তাম্বুলে মৌলভিদের একটি ঐতিহাসিক কেন্দ্রে তাঁদের মজলিসে ছিলাম। তখন আমাদের তরিকার প্রধান, যিনি মাওলানা রুমির সরাসরি ২২ তম বংশধর, তাঁর কাছ থেকে একটি ফোন আসল। আমাকে বলা হলো তিনি এখনই আমাকে একজন মৌলভি শায়খ হওয়ার অনুমোদন দিলেন।
ইস্তাম্বুলে আমার পরবর্তী ভ্রমণের সময় আমাকে ইজাজত বা ক্যালিগ্রাফি করা অনুমতিপত্র দেয়া হলো। অটোম্যান তার্কিশে লেখা এই লিপির শেষে আমার শায়খের স্বাক্ষর ছিল। এরপর একটি মসজিদের ওপরতলায় সাদামাটা অনুষ্ঠান হলো। সেখানে একজন বয়োবৃদ্ধ মৌলভি সুফি আমাকে আমাদের শায়খের তরিকার একজন শায়খ হিসেবে অভিষিক্ত করলেন। আমি আলখাল্লা পরলাম এবং কার্পেটের উপর দুজনে মুখোমুখি হয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। তিনি আরবিতে কুরআনের কয়েকটি আয়াত পড়লেন এবং অটোম্যান তুর্কিশে শায়খ অভিষেকের দুআ পড়ে আমার মাথায় শায়খের পাগড়ি পরিয়ে দিলেন। এরপর আমরা পাশাপাশি বসলাম। মৌলভি তরিকার মুরিদদের অভিষেক অনুষ্ঠান অবশ্য একটু আলাদা। সেখানে মুরিদগণ মেঝেতে বসে তাঁদের মাথা শায়খের হাঁটুতে রাখেন। তখন ছবি তোলা হয়, ছোটোখাটো উদযাপনও হয়।
পরের বছর তুরস্ক সফরে রমজানের বেশিরভাগ সময়টাই আমি কোনিয়ায় কাটিয়েছিলাম। কারণ অভিষিক্ত শায়খদের একটি প্রথা হলো সেখানে গিয়ে আঠারো দিনের জন্য নির্জনবাস করা। এর মধ্যে দশ দিনের জন্য আমার শায়খের পাগড়ি মাওলানা রুমির কবরের গিলাফের নিচে বরকত হাসিলের জন্য রাখা হয়েছিল। খিদমতস্বরূপ আমিও কিছু কাজ করেছিলাম। যেমন বাইরের প্রাঙ্গন ঝাড়– দেয়া এবং মাওলানা রুমির কবরের সামনের কিছু অংশ মুছে দেয়া।
দুর্গিচিলভ : শত শত বছর আগে যেমন ছিল, মৌলভি তরিকার অভ্যন্তরীণ সিলসিলা ও কাঠামো আজও কি তেমন অক্ষুণœ আছে? যদি না থাকে, তবে তার সাথে বর্তমানের মৌলিক পার্থক্য কি?
জামার্ড : আসলে মৌলিক পার্থক্যগুলো এত বেশি যে, এখানে বলার মতো না। আগে প্রচলিত সিলসিলা ও কাঠামোয় অটোম্যান স¤্রাজ্যের পরিপূর্ণ মদদ শতশত বছর ধরে চালু ছিল। কিন্তু ১৯২৫ সালে অট্যোম্যান তুর্কিশদের হটিয়ে নবগঠিত তুর্কিশ রিপাবলিক সবধরণের সুফি তরিকা, পেশা ও পদবী বেআইনী ঘোষণা দিয়েছিল। মৌলভিদের সমস্ত বাড়িঘর, স্থাবর সম্পত্তি, ওয়াকফকৃত সম্পদ বজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ১৯৫৩ থেকে শুরু হওয়া মৌলভি তরিকার বিখ্যাত ঘূর্ণায়মান দুআ অনুষ্ঠান অনুমোদিত ছিল ঠিক, তবে সেটাও তুর্কি সংস্কৃতি ও পর্যটনের উন্নতির জন্য স্টেইজ পারফরমেন্স হিসেবে। এই অনুষ্ঠান যেহেতু অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরিহিত একজন মৌলভি শায়খের মাধ্যমে পরিচালিত হতে হবে, তাই তুর্কি সরকার এটার অনুমতি দিয়েছিল।
এই অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া আর অন্যদেরকে এটার প্রশিক্ষণ দেয়া ছাড়া মৌলভি শায়খদের অন্যান্য কার্যক্রম নীরবে নিভৃতে পরিচালিত হয়। তাঁদের জমায়েত হবার স্থানগুলো তুর্কির অন্যান্য সুফি তরিকার মতো শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। চিরাচরিত কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব এখন অনেকটাই দূর্বল, নিয়ম-শৃঙ্খলাও শিথিল হয়ে এসেছে, যেভাবে রক্ষা করা উচিত অনেক ঐতিহ্য যেভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না এবং তুর্কির ভেতর ও বাইরের গোষ্ঠীগুলো উৎকর্ষের মান বজায় রাখার বিবেচনায় ক্রমেই আরও বেশী মুক্ত ও তত্ত্বাবধায়কহীন হয়ে পড়েছে। আসলে মৌলভি ঐতিহ্য ভীষণভাবে দূর্বল হয়ে পড়েছে এবং তুর্কিতে সুফি সংগঠনগুলো কার্যত এখনও বেআইনি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *