ইসলামি আখলাক

আখলাক শব্দটি আরবি। খুলুক শব্দের বহুবচন। খুলুক শব্দের অর্থ-চরিত্র, স্বভাব, অভ্যাস, আচার, আচরণ ইত্যাদি। আর এসবের প্রতিফলন হয় কথা, কাজ, চেহারা, পোশাক, ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে। এসব মিলিয়ে আখলাক, যাকে আমরা আচরণ বলতে পারি। ঈমানদার ব্যক্তির ঈমান কতটুকু মজবুত তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। অন্যরা দেখে মুমিন ব্যক্তির আমল, আচরণ ও স্বভাব। ঈমানের বাহ্যিক রূপই হলো আখলাক বা আচরণ।
বান্দাহ যখন আল্লাহকে স্বীকার করে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে, সে স্বীকার বা ঈমান অনুসারে বান্দাহর আচরণ প্রভাবিত হয়। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) কে বিশ্বাস করে অন্য মানুষের প্রতি তার আচরণ হবে একরূপ, আর যারা আল্লাহ ও রাসুল (সা.) কে বিশ্বাস করে না তাদের আচরণ হবে অন্যরূপ।
উত্তম চরিত্র বা স্বভাব মানুষের একটি বিশেষ অলংকার। সততার সাথে ব্যবহারিক জীবন পরিচালনা করা এবং পূত ও পবিত্র জীবন যাপন করা। হাদিস শরীফে এসেছে-
হযরত নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি রাসুল (স.) কে পূণ্য ও পাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছি। তখন তিনি বললেন, পূণ্য হলো উত্তম স্বভাব। আর পাপ হলো যা তোমার অন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং তার উপর মানুষের অবগত হওয়াকে তুমি অপছন্দ করো। (মুসলিম)
অপর আরেক হাদিসে প্রিয়নবী (স.) বলেন, দুশ্চরিত্রবান ও কর্কষভাষী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
ঈমান আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক স্থাপন করে। আখলাক আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক কিরূপ হবে তা নির্দেশ করে। ঈমান আনয়নের পর আমাদের প্রথম কর্তব্য হলো, নামাজ পড়া, রোযার মাসে রোযা রাখা, হজ পালন করা, যাকাত প্রদান করা। এরপর আসে আরো অসংখ্য কর্তব্য। একজন মুমিনের আখলাক বা আচরণের শুরু হলো-অন্যকে তাজিম ও প্রীতির সাথে সালাম দেওয়ার মাধ্যমে। দায়সারা ভাবে সালাম দেওয়া ও নেওয়া উচিত নয়। আমরা একজন আরেকজন কে হৃদয়ের আন্তরিকতা দিয়ে, মুখে মৃদু হাসি রেখে সালাম দিতে হবে।

অফিস আদালতের বড় সাহেবরা নিম্নশ্রেণির কর্মচারী-কর্মকর্তাকে সালাম দেন না। কর্মচারীরা তোতা পাখির মত তাদেরকে সালাম দেয়। আর বড় সাহেবরা নিচের দিকে তাকিয়ে হুঁ হ্যাঁ করে বা মাথা নেড়ে সালামের জবাব দেন। এটা ভদ্রতা বা উত্তম আচরণের মধ্যে পড়ে না। এটা উত্তম আচরণ নয়। শিক্ষক মিলনায়তনে সকল শিক্ষক বসে আছেন। প্রধান শিক্ষক এসে প্রবেশ করবেন বটে কিন্তু তিনি সালাম দিবেন না। যন্ত্রচালিতের মতো সহকারীরা তাকে সালাম দিতে হবে। আর তিনি মনে মনে জবাব দিবেন। এটা কি সুন্দর আচরণের মধ্যে পড়ে? হাদিস শরিফে এসেছে নবী (স.) বলেন-তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তি উত্তম, যে প্রথমে সালাম দেয়। একজন আরেকজনকে দেখলে হাসিমুখে আন্তরিকতার সাথে সালাম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করবে। অনেকে সালাম দিতে এমন ভাব দেখাবে যে, দেখলে মনে হয় সালাম দিতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে।
অথচ হাদিসে এসেছে, একজন সাহাবি নবি করিম (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামের মধ্যে কোন কাজটি উত্তম? তখন নবি (স.) বললেন, তুমি অপরকে খাদ্য দিবে আর পরিচিত অপরিচিত সকলকে সালাম দিবে। (বুখারি ও মুসলিম)
অপর আরেকটি হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি (স.) ইরশাদ করেন, একজন মুমিনের জন্যে অপর মুমিনের প্রতি ছয়টি কর্তব্য রয়েছে। ১. যখন সে রোগাক্রান্ত হবে, তখন তার সেবা করবে। ২. যখন যে মৃত্যুবরণ করবে তখন তার জানাযায় উপস্থিত হবে। ৩. যখন সে আহ্বান করবে, তখন সাড়া দিবে। ৪. যখন তার সাথে সাক্ষাৎ হবে, তখন তাকে সালাম দিবে। ৫. যখন সে হাঁচি দেবে, তখন তার হাঁচির জবাব দিবে। ৬. উপস্থিত অনুপস্থিত সর্বাবস্থায় তার মঙ্গল কামনা করবে।
এভাবে বহু হাদিস রয়েছে সালামের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে। সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। শুধু যে ছোটরা বড়দেরকে সালাম দিবে, তা নয়। বরং বড়রাও ছোটদের কে সালাম দিবে। একদা নবি (স.) একদল বালকদের নিকট দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন, তখন তিনি তাদেরকে সালাম দিলেন।
উত্তম আচরণ তথা ইসলামি আচরণের মধ্যে একটি বিষয় হলো অনুমতি প্রার্থনা করা। কারো ঘরে প্রবেশের পূর্বে ওই ঘরের মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি না পেলে ফিরে আসাই ভদ্রতা। অনুমতি নিয়ে কারো গৃহে প্রবেশের উপকারিতা হলো, মানুষের স্বাধীনতায় বিঘœ সৃষ্টি ও কষ্টদান থেকে বিরত থাকা। বিনা অনুমতিতে কারো গৃহে প্রবেশ করলে মাহরাম নয়, এমন নারীর উপর দৃষ্টি পড়তে পারে, এতে মারাত্মক গুণাহ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, হে মুমিনগণ তোমরা তোমাদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত অনুমতি না লও এবং গৃহবাসীদের সালাম না করো।
অনুরূপ ভাবে হাদিস শরিফে এসেছে। হযরত কালাদাহ ইবনে হাম্বল (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হযরত সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া (রা.) আমাকে কিছু দুধ অথবা হরিণের বাচ্চা এবং একটি শসা দিয়ে নবি করিম (স.)-এর নিকট পাঠালেন। তখন নবি করিম (স.) মক্কার উঁচু ভূমিতে অবস্থান করছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি তাঁর নিকট প্রবেশ করলাম, কিন্তু আমি সালাম দেইনি এবং অনুমতিও নেইনি। তখন নবি করিম (স.) বললেন, তুমি ফিরে যাও এবং বল আস্সালামু আলাইকুম, আমি কি প্রবেশ করতে পারি? (তিরমিযি, আবু দাউদ)
এভাবে অসংখ্য হাদিস রয়েছে, কারো ঘরে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। এমনকি মায়ের ঘরেও ছেলে প্রবেশ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে।
(চলবে)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *