যা সত্য তা স্বীকার করতেই হবে। কি সেই সত্য, যে সত্য আমাকে মুক্তি দিতে পারে? কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী- সত্য মুক্তি দেয়। সত্য শুধু বলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, মেনে নেওয়াটাও এর অন্তর্ভুক্ত। তাই সত্য মেনে নেওয়াও মুক্তি। উম্মাতে মুহাম্মাদীর অন্তর্ভুক্ত হতে পেরে হৃদয়ের গভীর থেকে শুকরিয়া জ্ঞাপনের পর আমার প্রথম কাজ প্রথম সত্য হলো পড়া। পৃথিবীতে আল্লাহর সেরা সৃষ্টি ‘মানুষ’ প্রেরণের আগেই যে জিনিসের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হলো জ্ঞান। যার জ্ঞান যতবেশী, সে তত মর্যাদাবান। হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির পর আল্লাহ তাআলা তাঁর সীনায় জ্ঞানের ভাণ্ডার ঢেলে দেওয়ার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সোহবতে জ্ঞান মিলে এবং সেইসাথে রবের অনুগ্রহ। আর দুনিয়াতে নবী-রসুলদের কাছে সহীফা বা আসমানী কিতাব প্রেরণের দ্বারা বুঝালেন পড়ার মাধ্যমেও জ্ঞান অর্জন করা যায় এবং দলীল হিসেবেও ফায়েদা লাভ করা যায়। ফিতরাতে রাসুল বা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের পর বহু শতাব্দীকাল ধরে রসূল প্রেরণ স্থগিত ছিলো। ফলে মানুষের শোচনীয় অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। বিভিন্ন বর্ণনা আছে, একটি বর্ণনা হলো- ব্যবধান ছিলো প্রায় ৬০০ বছরের। এরপরই- সর্বশেষ প্রেরিত আমাদের নবী দোজাহানের সর্দার রাসুলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহ তাআলা যখন কুরআন নাজিল করলেন, তখন বিস্মৃত মানুষদের প্রথমেই পড়ার আদেশ করে জানিয়ে দেওয়া হলো পড়তে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তাহলে মুক্তির উপায় হবে। আর পড়তে হবে সেই রবের নামে, যিনি আমাদেরকে পড়তে বলেছেন, সৃষ্টি করেছেন।
তাহলে সংক্ষেপেই বুঝা গেলো যে, পড়ার প্রথম এবং প্রধান মাধ্যম হলো বই। আর সর্বোত্তম মাধ্যম হলো ব্যক্তিকে অধ্যয়ন করা। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি অবশ্যই নববী আদর্শের হুবহু নমুনা হতে হবে। ব্যক্তিকে পড়া আবার কি! ব্যক্তিকে অধ্যয়ন বলতে ব্যক্তির চরিত্রকে অধ্যয়ন অর্থাৎ ব্যক্তির সাথে মিশে যেতে পারলে বা লেগে থাকতে পারলে যেমন অনেক কিছু জানা হয়, সেইসাথে চরিত্রগুলো আপনাআপনি এসে যায় নিজের ভিতরে। হ্যাঁ, এটাই যারা সবচে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেন, তাদের কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে থাকবে, কতটা ফলদায়ক এই পদ্ধতিটা।
এখন কথা হলো, অনলাইনে ঢুকে পড়াশুনা বা ছাত্রদের জন্য অনলাইনে সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারটা। এখানে উপকারিতার পাশাপাশি অপকারিতার কথাও উল্লেখ করার সুযোগ রয়েছে। উপকারিতা নিয়ে আগে কথা বলা যাক। কোন সন্দেহ নেই ইন্টারনেট বা অনলাইন সিস্টেম আমাদের আধুনিক জীবনে অনেক উপকার বয়ে আনছে। যেমন- চাহিদামতো যে কোন তথ্য গুগলে সার্চ দিলেই তৎসংশ্লিষ্ট অনেক তথ্য খুব সহজেই চলে আসে। অনায়াসেই যেকোন বইয়ের পিডিএফ পাওয়া যায়। পিডিএফ করা যায়। পিডিএফ পড়া যায়। বিভিন্ন ভাষার যেকোন বই, তথ্য, ফরম বা ইনফরমেশন জানতে পারা যায়, ডাউনলোড করা যায়। ফাইলগুলো হারিয়ে না যায়, সেজন্য গুগলে সেভ রাখা যায়, শেয়ার করা যায়। এমনকি একসাথে সকল দিকের কাজের আঞ্জাম দেওয়া যায়Ñ বই পড়া হোক, টাইপ করা হোক- এখনতো ভয়েস রেকর্ডের টাইপিংও মুহুর্তেই হয়ে যায়, গজল শুনা হোক বা পিডিএফ সংক্রান্ত যেকোন কাজই হোক। পাশাপাশি আরো বিরাট যে সুবিধাগুলো- ইউটিউব ব্যবহার করা। এখানে রয়েছে আরো চমকপ্রদ কিছু। ধরা যাক, লেকচার শুনা, ওয়াজ শুনা, বিভিন্ন শিক্ষণীয় দৃশ্য, চিত্র, সংলাপ দেখা বা রাষ্ট্রীয় যে কোন লাইভ তথ্য সংগ্রহ করা। আরেকটা হলো অনলাইনে লেখালেখি। হতে পারে সেটা ব্লগ বা ফেসবুকের মাধ্যমে। যেকোন ধরণের তথ্য মুহুর্তের মধ্যেই অনেকের কাছে আদান-প্রদান হয়ে যায়। এরপর জিমেইল, টুইটার ইত্যাদি ইত্যাদিও আছে, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কমুউনিকেশন খুব সহজলভ্য।
এবার আসি অপকারিতার দিকে। বলা চলে অপকারিতাই বেশী। প্রথম অপকারিতা হলো মূল্যবান সময় অপচয়। এরপর আরো যা যাÑ মেধার কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়, বই পড়ার মানসিকতা লোপ পায়, নির্ভেজাল তথ্য পেতে বেগ পেতে হয়, অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের চাহিদা লোপ পায়, নেক আমল করতে এবং সচ্চরিত্রের আদলে গড়ে উঠতে যে চেষ্টা সাধনা ও সময়ের প্রয়োজন হয়, তা আর হয়ে ওঠে না। তারপর আরো মারাত্মক যে ব্যাপারগুলো- গেম খেলায় বুদ হয়ে থাকা, জুয়া খেলায় মেতে ওঠা, নাটক-মুভি, সিনেমা, এমনকি পর্ণগ্রাফি দেখতে দেখতে এমন একটা অবস্থা হয় যে, তখন মনে হয়- এগুলো তেমন কিছু না, ক্ষতির কিছু নাই বা খারাপের তেমন কি আর! ধীরে ধীরে অধঃপতনের মাত্রা বাড়তে থাকে, যা তার ধারণারও বাইরে গিয়ে ঠেকে। আগে যে বলা হলো, বই পড়ার মানসিকতা নষ্ট হয়। পিডিএফ পিডিএফ বলে মুখে যারা ফেনা তোলে, আসলে তারা পিডিএফ পড়ে না। পড়লেও ১/২ পাতা। অথচ ফাইলে বা মোবাইলে পিডিএফে ভরা। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, পিডিএফ জমা করার অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো, যেকোন সময় তথ্য আহরণ করা যেতে পারে। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি, যারা ইন্টারনেট ঘেটে বা অনলাইনে পিডিএফ অথবা ইউটিউব মাধ্যমে গিয়ে বুদ হয়ে থাকতে থাকতে যেমন বই পড়ার মানসিকতা হারিয়ে ফেলে তেমনি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য যা করা দরকার, তাতে ভাটা পড়ে চরম আকারে। কারণ ইন্টারনেটে থাকতে থাকতে পারিপার্শ্বিক আরো অনেক সুবিধা সে অনায়াসেই ভোগ করতে পারে। যেমন- গেম, ভিডিও, ফেসবুকে অযথা শেয়ারিং-এ ব্যস্ত থাকা আর চ্যাটিং তো আছেই।
আজ আধুনিকতার নামে গা ভাসিয়ে দিয়ে এসবকে সহজে মেনে নেওয়া হলো মানসিক রোগের আলামত। বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। বই পড়ার মাধ্যমে যেকোন বিষয় হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হয়, ভাবতে সুবিধা হয়, তুষ্টি লাভ করা যায়, বই নাড়াচাড়া করলে জ্ঞানের ঘ্রাণ অনুভব করা যায়। বই পড়লে মনে হবে, যেন স্বয়ং লেখকের সাথে কথা বলছি। তাছাড়া প্রথমেই বলে এসেছি, আল্লাহ তাআলা কুরআন তেলাওয়াত করতে বলেছেন। আরেকটু মজাদার কথা হলো, ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে লাখ টাকার ফার্নিচার দরকার নেই, সেলফ বানিয়ে বই যেভাবেই হোক সাজিয়ে রাখেন, দেখবেন- ঘরের সৌন্দর্য কেমনে তরতর করে বেড়ে যায়!
যাহোক, উত্তোরণের বিষয়ে আলোকপাত করতে গেলে খোলাসা করে বলা উচিত। কিন্তু এখানে তা সম্ভব না। কলেবর বৃদ্ধির আশংকা। তবে সংক্ষেপে এভাবে বলা যেতে পারে-
১. আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করা, আল্লাহর কথা স্মরণ করা।
২. মন-মানসিকতা শক্ত রাখা।
৩. প্রয়োজনাতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।
৪. নেককার বা ভালো, বিদ্যান মানুষের সোহবত নেওয়া।
৫. বেশি বেশি বই কেনা, বই কেনার জন্য মনকে জোর করা।
৬. বাড়িতে বা রুমে পড়ার পরিবেশ তৈরি করে রাখা।
৭. উস্তাদ, মা-বাবার পরামর্শ নেওয়া।
৮. নেক আমল করা বিশেষ করে কুরআন তেলাওয়াত, নামাজ, দরুদ পড়া।
৯. ভালো ভালো বা শিক্ষণীয় গল্প বা উপন্যাসের বই পড়া। ইত্যাদি।
১০. সর্বোপরি, আল্লাহর কাছে জ্ঞানবৃদ্ধির দুআ করা। রহমত কামনা করা। আল্লাহু মুয়াফফিক।