নির্বাচিত আয়াত
অর্থ: জেনে রাখ, আল্লাহর ওলিদের১ কোন ভয় নাই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও২ হবে না। ওলি হচ্ছে তারা৩ যারা ইমান৪ আনে এবং তাকওয়া৫ অবলম্বন করে। এমন লোকদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া৬ এবং আখেরাতে। আল্লাহর বাণীর কোন পরিবর্তন নাই। ওটাই হচ্ছে মহাসাফল্য। সূরা ইউনুস ১০:৬২-৬৪
আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা, শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা
১. মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বেলায়েত বা আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করে আল্লাহর ওলি হওয়া।
২. ইমান আনার মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষ আল্লাহর সাধারণ ওলি হিসেবে গৃহীত হয়; তবে পারিভাষিক ওলি হওয়ার জন্যে তাকে তাকওয়া বা আল্লাহর ভয়ে তাঁর আনুগত্যের পথে হাঁটতে হয়। এই পথচলায় যে যতটুকু এগিয়ে যায় সে ততটুকু বেলায়েত অর্জন করে আল্লাহর ওলি হিসেবে গণ্য হয়। অর্থাৎ, আল্লাহর ওলি হতে হলে দু’টি শর্ত পূরণ করতে হয়, ইমান আনয়ন, দ্বিতীয়তঃ তাকওয়া অবলম্বন।
৩. তাকওয়ার প্রধান দিক হচ্ছে, হারাম বর্জন। তাকওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে হারামে পতিত হওয়ার ভয়ে সন্দেহের জিনিস বর্জন। -বুখারি
৪. আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন এবং যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয় বর্জন করার নামই তাকওয়া। কিন্তু কাজটি যেহেতু মহাসমূদ্র পাড়ি দেওয়ার মত কঠিন তাই এটিকে সহজ করার জন্যে আল্লাহ কুরআনে সহজ কিছু কৌশল৭ নির্দেশ করেছেন।
৫. সেসব সহজ কৌশলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ (১) আল্লাহর নেকবান্দা বা ভাল মানুষদের সাথে বেআদবি না করা বরং তাঁদেরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা৮, (২) সর্বদা সত্যকে আঁকড়ে ধরা৯ এবং উচিত কথা বলা, যদি তা নিজের বিরুদ্ধেও যায়১০, (৩) সত্যবাদী ও সৎ মানুষের সাহচর্যে জীবন কাটানো১১, (৪-৫) পরকাল ও মৃত্যুর কথা স্মরণ করা এবং নিজের কাজের হিসেব নেয়া; আর আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং দেখেন, একথা মাথায় রেখে তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর জিকির করা১২, (৬) চাল-চলনে কিংবা ধর্মীয় বিষয়ে কাফির ও মুনাফিকদের অনুকরণ না করা১৩, (৭) বেশি-বেশি দান-সদকা করা১৪, (৮-৯) অসিলা১৫ তালাশ করা এবং জিহাদ-মুজাহাদা১৬ করা, (১০) সর্বোপরি, ওলি-আল্লাহ হওয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে কাতরভাবে দুআ করা১৭।
১ ওলি = আল্লাহর বন্ধু।
২ দুনিয়া এবং আখেরাতের ভয় কিংবা দুশ্চিন্তার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। বিশেষতঃ পরকালের ঘাঁটিসমূহ, যেমন কবর, হাশর, মিজান, সিরাত, হাওজে কাওসার, শাফাআত, আমলনামা ইত্যাদি পর্বগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার মহাদুশ্চিন্তা ও পেরেশানকালীন সময়ে তারা নিরাপদ থাকবে।
৩ ওলি = ওলি হওয়ার জন্য দু’টি শর্ত: বিশুদ্ধ ইমান বা ইসলামি আকিদা-বিশ্বাস এবং তাকওয়া বা যথার্থ আল্লাহভীতি, যা তাকে গোনাহ থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
৪ ইমান = দ্বীন ইসলামের ৩টি দিক: (১) ইসলামি বিশ্বাসমালা, যাকে ইমান কিংবা আকিদা বা আকাইদ বলা হয়, (২) কর্ম বা আমলি দিক, যাকে ফিকাহ/শরিআত/ইবাদাত বা ইসলামও বলা হয়, (৩) আমলের ভেতরে এখলাস তথা আল্লাহর ভয় ও ভক্তি জাগ্রত রাখা, যাকে হাদিসের ভাষায় ইহসান বলা হয়। এর অন্য নাম তাসাও্ওফ। অর্থাৎ, ইমান, আমল ও ইখলাসের সমন্বিত রূপই হচ্ছে দ্বীন ইসলাম বা ইসলামি জীবনব্যবস্থা। এর কোন একটি বাদ পড়লে পরিপূর্ণ দ্বীন হবে না। হাদিসে জিবরাইল নামক প্রসিদ্ধ হাদিসের মর্ম তা-ই।
৫ তাকওয়া = আল্লাহর আদেশগুলো মান্য করা এবং নিষেধগুলো বর্জন করা। তবে হারাম কাজ বর্জনই তাকওয়ার প্রধান অঙ্গ।
৬ দুনিয়ার সুসংবাদ বলতে আয়াতের বর্তমান সুসংবা ছাড়াও হাদিসে বর্ণিত ‘মুবাশশারাত’ বা সত্যস্বপ্নসমূহকে বোঝানো হতে পারে, যা ব্যক্তি নিজে নিজের সম্বন্ধে দেখে কিংবা তার সম্বন্ধে অন্য কেউ দেখে। অথবা আল-কুরআনের সেই সুসংবাদ যাতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, অতঃপর সে দাবির ওপর কার্যতই অবিচল থাকে, (মৃত্যুর সময়) তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা এবং বলে, ‘তোমরা ভীত হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না আর তোমাদেরকে যে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিলন তার জন্যে আনন্দিত হও।” -সূরা হা-মিম আস্-সাজদাহ ৪১:৩০। (দ্রষ্টব্য: তাফসিরে জালালাইন)
৭ সহজ কৌশল = এটা আল-কুরআনের বৈশিষ্ট্য তথা আল্লাহ তাআলার শান যে, তিনি যেখানে কঠিন বিধান দেন, সেখানে (পরক্ষণেই কিংবা পূর্বাংশে) তা পালনের সহজ কৌশলও বাতলে দেন। -দ্রষ্টব্য: তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন, আয়াত ৩৩:৬৯-৭১
৮ এ দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, অর্থ: “হে মুমিনগণ, মূসাকে যারা কষ্ট দিয়েছিল তোমরা তাদের মত হওয়া না।” -সূরা আহজাব ৩৩:৬৯
৯ আল্লাহ তাআলা বলেন, অর্থ: “হে ইমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য-সঠিক কথা বল। তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের আমলকে সংশোধন করে দেবেন, তোমাদের গোনাহরাশি মাফ করবেন।” -সূরা আহজাব ৩৩:৭০-৭১
১০ আল্লাহ বলেন,“অর্থ: “হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর সাক্ষী হিসেবে (সমস্ত কথায় ও কাজে) ন্যায়বিচারে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ থাক,; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।” -সূরা নিসা ৪:১৩৫
১১ এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, (১১৯) অর্থ: “হে ইমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর এবং (এ উদ্দেশ্যে) সত্যবাদীদের সাথী হও।” Ñসূরা তাওবা ৯:১১৯
১২ আল্লাহ বলেন,(১৮) (১৯) অর্থ: “হে মুমিনগণ, তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নজর করে দেখে, আগামী দিনের জন্যে সে কী পেশ করেছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের আমলসমূহের সম্যক খবর রাখেন। তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে আছে বিধায় আল্লাহও তাদের নিজেদেরকে (নিজেদের পরিণাম ও প্রকৃত কল্যাণ সম্বন্ধে) ভুলিয়ে দিয়েছেন। ওরাই হচ্ছে পাপিষ্ঠ/ফাসিক।” -সূরা হাশর ৫৯:১৮-১৯
১৩ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবিকে বলে নবির উম্মাতদেরকে শেখাচ্ছেন,(১) অর্থ: “হে নবি, আল্লাহকে ভয় কর আর কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য কর না। (করলে) আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” -সূরা আহজাব ৩৩:১
১৪ আল্লাহ বলেন, (১৭) (১৮) অর্থ: “আর লেলিহান আগুন থেকে দূরে রাখা হবে সেসব পরম মুত্তাকিদেরকে যারা শুদ্ধ মানুষ হওয়ার জন্য নিজের মাল-সম্পদ দান করে থাকে।” -সূরা লাইল ৯২:১৭-১৮
১৫ অসিলা/ওসিলা = অসিলা নবিজি স.-এর জন্যে নির্ধারিত পরকালের একটি সম্মান। এর শাব্দিক অর্থ উপায় বা মাধ্যম। এখানে অসিলা বলতে বোঝানো হয়েছে, আত্মিক ও বাহ্যিক প্রতিটি নেক আমলকে। একজন দ্বীনি মুরব্বি যেহেতু অগণিত নেক আমলের কারণ হয়ে থাকেন, সে কারণে নিঃসন্দেহে একজন আধ্যাত্মিক গুরু, দ্বীনদার আলেম, দ্বীনি পথপ্রদর্শককে ‘আল্লাহপ্রাপ্তির অসিলা বা মাধ্যম ও উপায়’ হিসেবে গ্রহণ করলে সেটা অবশ্যই নিম্বলিখিত আয়াতের অনুসরণ বলেই গণ্য হবেÑ (৩৫) অর্থ: “হে ইমানদারগণ, তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর এবং (এ উদ্দেশ্যে) আল্লাহর কাছে যাওয়ার অসিলা তালাশ কর এবং আল্লাহর রাস্তায় প্রাণপণ চেষ্টা বা জিহাদ কর যাতে তোমরা সফল হতে পার।” -সূরা মায়িদাহ ৫:৩৫
১৬ জিহাদ/মুজাহাদা = ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’র সরল অর্থ কাফিরদের মোকাবালায় সশস্ত্র সংগ্রাম করা। এটি ইসলামি রাষ্ট্র থাকলে, সঠিক নেতৃত্বও প্রস্তুতি থাকলে করতে হয়। জিহাদ-এর আরেকটি অর্থ সর্বাবস্থায় গ্রহণ করা যায়। তা হল, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের সাধনা করা, প্রাণপণ চেষ্টা করা। তা আত্মশুদ্ধিমূলক আমল যেমন হতে পারে, তেমনি তা ব্যক্তিগত পরিম-লে, পারিবারিক পরিম-লেও হতে পারে; হতে পারে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লেও। সশস্ত্র সংগ্রামের বাইরে এ ধরনের দাওয়াত, তাবলিগ, তালিম, তারবিয়াত ও ইসলাহ-মূলক কাজ অগণিত ও অপরিমেয়। জিহাদকে এমন ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করলে সশস্ত্র সংগ্রামসহ যে কোন পরিস্থিতিতে দ্বীনি কর্মক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া সহজ হয় বলেই মনে হয়। প্রবন্ধকার
১৭ আল্লাহ প্রতি নামাজে আমাদেরকে দুআ করতে শিখিয়েছেন,(৫)(৬) (৭) অর্থ: হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকে সিরাতুল মুসতাকিম দেখিয়ে দেন, যে পথ হচ্ছে আপনার নিআমাতপ্রাপ্ত (নবি, সিদ্দিক, শহিদ ও নেকবান্দা)-দের পথ, তাদের পথ নয় যারা আপনার গজবের শিকার হয়েছে, আর তাদের পথও নয় যারা সঠিক পথ ছেড়ে বিভ্রান্তি অবলম্বন করেছে।” সূরা ফাতিহা ১:৫-৭