আল্লামা ফুলতলী র. ও তাঁর সাহিত্যকর্ম

আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী রহ. ১৯১৩ ইংরেজী সনে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলাধীন ফুলতলী নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হয়রত শাহজালাল ইয়ামনী রহ. সফরসঙ্গী হযরত শাহ কামাল রহ.’র বংশধর। তাঁর জালালী তবিয়ত সেই পবিত্র বংশধারার প্রতিফলন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই, তারপর হাইলাকান্দি রাঙাউটি মাদরাসা (আসাম), বদরপুর আলিয়া মাদরাসা, তারপর ভারতের বিখ্যাত রামপুর আলিয়া মাদরাসা, অতঃপর ভারতের ঐতিহ্যবাহী মাতলাউল উলূম মাদরাসা থেকে হাদীস শাস্ত্রে ১ম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে চূড়ান্ত সনদ লাভ করেন এবং ইলমে ক্বিরাত তিন ছিলছিলায় অর্জন করে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর স্থাপন করেন। বিশেষ করে রইছুল র্কুরা হযরত আহমদ আল হেজারী মক্কী রহ.’র নিকট থেকে পবিত্র কুরআন বিশুদ্ধ ভাবে পঠনের সূর লহরী বাংলার জমিনে সফলভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন আল্লামা ফুলতলী রহ.। তার জ্বলন্ত প্রমাণ‘দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাষ্ট’ এবং দেশ বিদেশে এর শাখা প্রশাখাগুলো। আল্লামা ফুলতলী রহ. শিক্ষাজীবনের মধ্যখানে ইলমে মারেফাত তথা তাসাউফ শাস্ত্রে আল্লামা শাহ ইয়াকুব বদরপুরী রহ.’র নিকট থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন।
আল্লামা ফুলতলী রহ.’ র ইলমে হাদীসের চর্চা, ইলমে তাফসীরের চর্চা, ইলমে ইলমে কিরাতের চর্চা, ইলমের তাসাউফের চর্চা, খেদমতে খলক বা সৃষ্টির সেবা, আর্তমানবতার সেবা ধর্মনীতি, অরাজনীতি, রাজনীতির চর্চার মত সাহিত্য চর্চায় ও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। সাহিত্যকর্মে তাঁর অবদান কোনো অংশে কম নয়। তাঁর লিখিত প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বহু গ্রন্থ সাহিত্যকর্মের স্বাক্ষর বহন করে। আল্লামা ছাহেব ক্বিবলা ফুলতলী রহ. বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলো নি¤œরূপ: ১. আল কাউলুছ ছাদীছ। এটি তাজবীদ বিষয়ে উচ্চস্তরের একখানা কিতাব। উর্দু ভাষায় রচিত এ কিতাবখানা বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাঁর বড় ছাহেবজাদা আমাদের বর্তমান পীর ও মুর্শিদ বহুগ্রন্থ প্রণেতা হাজার হাজার ইয়াতিম অসহায়দের আশ্রয়স্থল আল্লামা মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দিন ফুলতলী মাদ্দা জিল্লাহুল আলি। এ কিতাবখানা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে ঢাকার এমদাদিয়া প্রেস থেকে। ২. আত তানভীর আলাত তাফসীর। এটি পবিত্র কুরআনের প্রথম দুই পারার সুন্দর তাফসীর। এটিও উর্দু ভাষায় রচিত। বাংলায় পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেছেন তাঁর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী। ৩. আল মুন্তাখাবুছ ছিয়র। গ্রন্থখানা উর্দু ভাষায় রচিত। তিন খন্ডে প্রকাশিত সীরাত বিষয়ে একখানা মকবুল মূল্যবান গ্রন্থ। এটিও বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন হযরত মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী । ৪. আনওয়ারুছ ছালিকীন। উর্দু ভাষায় রচিত ইলমে তাসাউফ বিষয়ে মূল্যবান গ্রন্থ। বাংলায় অনুবাদ করেছেন আল্লামা মো. ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী। ৫. শাজরায়ে তায়্যিবা। উর্দু ভাষায় এটি তরিকতের ছিলছিলা পরিচিতিমূলক গ্রন্থ। ৬. নেক আমল এটি বাংলা ভাষায় রচিত। দৈনন্দিন জীবনে অতীব জরুরী দিক নির্দেশনা ও আমলিয়াতের কিতাব।৭. আজমতে সাহাবা (অপ্রকাশিত)। ৮. আলফরাইদ ফিল আকাঈদ (অপ্রকাশিত)। ৯. নালায়ে কলন্দর। এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। এ কাব্য গ্রন্থের মাধ্যমেই তাঁকে ‘বাংলার রুমী’ উপাধি প্রদান করা হয়েছে। হামদ, নাত, মুনাজাত ও আধ্যাত্ব্যিবাণী সম্বলিত একটি উচ্চাঙ্গের উর্দু কাব্যগ্রন্থ। আল্লামা ফুলতলী রহ. তিনি নিজেই নালায়ে কলন্দর কাব্যগ্রন্থের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন ,“আসলে সীরাত, তাফসীর, আকাঈদ, তাসাউক বিষয়ক লেখালেখি নিয়ে ব্যাপৃত থাকাকালীন একান্তে আমার হৃদয় কন্দরে যে ভাষাহীন আকুতি জেগেছে, তারই লিখিত রূপ “নালায়ে কলন্দর”। ‘নালায়ে কলন্দর’ কাব্যানুবাদ করেন সময়ের ফররুখ নামে খ্যাত শক্তিমান কবি জনাব মাওলানা রুহুল আমীন খান। তিনি অনুবাদকের নিবেদন, কলামে লিখেছেন “নালায়ে কলন্দর” এই মহান ওলীর জীবনের এক সংকটময় মুহুর্তের রচনা। আল্লাহর প্রেমে সমাহিত রাসূল প্রেমে নিমজ্জিত, আউলিয়া মোহাব্বাতে আপ্লুত, হাকীকাতের নূরে উদ্ভাসিত এ মহান তাপসের হৃদয়ের যে ভাব, যে অতিন্দ্রিয় অনুভূতি শব্দ ও ছন্দের অবয়বে ‘নালায়ে কলন্দর’ বিধৃত তার আমেজে কেবল আপ্লুত হওয়া যায়। তার তরজমা করা যায় না, বোধহয় তার তরজমা কেউ করতে পারে না, আমার মত নগন্য তো নয়ই।


প্রথিতযশা কবি সৈয়দ শামসুল হুদা কর্তৃক নালায়ে কলন্দর কাব্যানুবাদ প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় জাতীয় অধ্যাপক মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, “উর্দু ভাষায় রচিত এই অনুপম কাব্যগ্রন্থের হামদ, নাত ও গীতে কবিতাগুলো উদু কাব্য সাহিত্যে মানের দিক থেকে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর।”
সাহিত্য কর্মের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্বরূপ আল্লামা ফুলতলী রহ. ১৯৯০ সালের দিকে ঢাকায় “পরওয়ানা পাবলিকেশন্স” নামে একটি প্রকাশনী প্রতিষ্টা করেন। অধুনা বিলুপ্ত ‘পরওয়ানা’ নামক একটি মাসিক পত্রিকার তিনি ছিলেন পৃষ্ঠপোষক। কাব্যসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য বরেণ্য কবি সৈয়দ শামসুল হুদা আল্লামা ফুলতলী সাহেবকে নিবেদিত কবিতায় তাঁকে বাংলার রুমী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেন-ভাষায় আড়াল ভেঙে দেখি চেয়ে তুমি প্রেমিক জনের প্রিয় ‘বাংলার রুমী’।
আল্লামা ফুলতলী রহ. ছিলেন সাহিত্যমোদি। বিশেষ করে আরবি ও উর্দু কবিতার প্রতি ছিলো তাঁর বেশ আকর্ষণ। এজন্য নবীজির সীরাত বিষয়ক গ্রন্থ “আল মুন্তাখাবুছ ছিয়র” গ্রন্থের মাঝে মাঝে আরবি কবিতার উদ্ধৃতি লক্ষণীয়।
কবি কলন্দর আল্লামা ফুলতলী রহ.’র নিজের দেওয়া কবিতার একটি সংজ্ঞা নি¤œরূপ, “কাব্য কবিতা তো একটি বিশেষ মুহুর্তে হৃদয়ের বিশেষ ভাব অনুভূতির ভাষারূপ।” এজন্য এডভোকেট জিয়াউর রহিম শাহিন তার ‘ইতিহাসের দৃষ্টিতে আল্লামা ফুলতলী রহ. গ্রন্থে একস্থানে লিখেন,“শতাব্দির ইসলামী রেঁনেসা আন্দোলনের অন্যতম মর্যাদাবান মর্দে মুজাহিদ বীর সিপাহসালার ফুলতলী ছিলেন একজন বড় মাপের লেখক।”
আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলার বাড়িতে বিশাল লাইব্রেরি গড়ে তোলা। তাঁর সাহিত্যকর্মের আরেক উজ্জল নমুনা।
পরিশেষে আল্লামা ফুলতলী রহ.’র এই সাহিত্যসাধনা তাঁর মহান বংশধারায় জাগরুক থাকুক অনন্তকাল ব্যাপী এটাই আমার হৃদয়ের আরাধনা।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *