আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) : ইলমে হাদিসের জন্য নিবেদিত প্রাণপুরুষ

সমকালীন বিশ্বে যে কজন ইসলামী ব্যক্তিত্ব আল্লাহর দ্বীনের প্রচার প্রসার কার্যে একনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন শামছুল উলামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী (র.) (ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী) তাদের মধ্যে অন্যতম। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) এক মহান ব্যক্তিত্বের নাম, আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও আধ্যাত্মিক সম্রাট, পবিত্র কোরআনের একনিষ্ট খাদিম, ইসলামী চিন্তাবিদ, গণমুখী রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত বলিষ্ঠ কণ্ঠ, সুনিপুণ বক্তা, সুলেখক এবং একজন মহান মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও পরিচয় হচ্ছে তিনি ছিলেন হাদিস শাস্ত্রের একজন ওস্তাদ। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় তিনি অতিবাহিত করছেন দারসে হাদিস প্রচারের মধ্য দিয়ে। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। ব্যাপক বিস্তৃত ছিল তার খেদমতের ময়দান। দারস ও তাদরিস থেকে শুরু করে বয়ান, তাসনিফ, রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব, সমাজ সংস্কারের উদ্যোগ, বাতিলের অসারতা প্রমাণের জন্য গবেষণা ও রচনা, বিশ্ব মুসলিমের দুর্দশা লাগবের আহ্বান ও পদক্ষেপ, ইসলামের ঐতিহ্য ও নিদর্শন রক্ষায় সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এসবই তাঁর কর্ম তৎপরতার তালিকাভূক্ত। অনেক আন্দোলন ও সংগ্রামে তাঁর সাফল্য উজ্জ্বল। তেমনি দ্বীনি শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলা, সাগরেদদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকি ও পরামর্শ ছিল তাঁর নৈমিত্তিক ব্যস্ততা। কোরআন সুন্নাহর সাথে সম্পর্কহীন ও সঙ্গতহীন কর্মকাণ্ড ও প্রবণতার ব্যাপারে তাঁর আপসহীনতা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ইলমে দ্বীন বিশেষ করে ইলমে হাদিসের দারস ও মোতালায়, তাহকিক তাঁর উজ্জ্বলতম কর্মক্ষেত্র। অন্য সব ব্যস্ততা ও নিবিষ্টতার মধ্যেই এই দিকটির বিশিষ্টতা ও অনন্যতায় তিনি বৈশিষ্ট মণ্ডিত। যেন এতেই তার প্রশান্তি ও স্বস্তি, এতেই তাঁর অন্তরের খোরাক, তাঁর ভাবনা ও মননের ক্ষেত্র এটিই, এ জন্যই তিনি উস্তাজুল মুহাদ্দিসীন।
আরবী ভাষাও সাহিত্য, নাহু সরফ, বালাগাত, মানতিক, ফিকহ উসুলে ফিকাহ, তাফসীর, উসুলে তাফসীরে ইসলামী রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতি কোন শাখায় তিনি বিশেষজ্ঞ নন? তাঁর সাগরেদরা জানেন যেকোন বিষয়ে তার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা ঈর্ষণীয়। এমন সামগ্রিক ও বিস্তৃতি পাওয়া যায় পৃথিবীতে সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে কিন্তু তার সব শাস্ত্রের ও শাখার জ্ঞান যেন চাপা পড়ে থাকে ইলমে হাদিসের নীচে। সমকালিন ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকাল দারসে হাদিসের মশগুল থাকা ব্যক্তি হিসাবে তাঁর তুলনা বিরল। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারতের বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সিলেটের ঐতিহ্যবাহী গাছবাড়ী জামেউল উলুম আলিয়া মাদরাসায় ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সিলেটের সৎপুর আলিয়া মাদরাসায় আশির দশকের পুরো অংশে ইছামতি আলিয়া মাদরাসায় এবং পরবর্তীতে ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত সপ্তাহে ২দিন তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থিত বাদে দেওরাইল ফুলতলী আলিয়া মাদরাসায় অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, নাসাই শরীফ সহ তাফসীরে জালালাইন, আল ইতকান, নুরুল আনোয়ার, তাফসীরে কাশশাফ, হেদায়া প্রভৃতি কিতাবাদি পাঠদান করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের বাইরে বিভিন্ন সময়ে তিনি যেমন অনেক আলেম উলামাকে হাদিসের দারস প্রদান করেছেন তেমনি প্রতিষ্ঠাও করে গেছেন ইলমে হাদীস চর্চার অগণিত প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ে হাদিসের শিক্ষকতার জীবনে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছেন অগণিত শিক্ষার্থী। তাঁর সঠিক শিক্ষায় তারা খুঁজে পেয়েছেন জীবনের সঠিক দিশা।
১৩৫৫ হিজরি সনে তিনি ভারতের মাতলাউল উলুম মাদরাসা থেকে কামিল চুড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে হাদীস শাস্ত্রের উপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। ভারতবর্ষের খ্যাতনামা মোহাদ্দিস আল্লামা খলিলুল্লাহ রামপুরী (র.) ও আল্লামা ওয়াজিহ উদ্দিন রামপুরী (র.)-এর কাছ থেকে তিনি হাদিসের সনদ লাভ করেন। তাঁর এই সিলসিলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। নিম্নে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.)-এর দুই সিলসিলার হাদিসের সনদ উল্লেখ করা হলো-
১. হযরত ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.), ২. মাওলানা খলিলুল্লাহ রামপুরী (র.), ৩. মাওলানা মনোওর আলী রামপুরী (র.), ৪.সাইয়্যেদ মোহাম্মদ শাহ (র.), ৫. সাইয়েদ হাসান শাহ (র.), ৬. শায়খ আলম আলী আল নাকিনাওয়ী (র.), ৭. শাহ মোহাম্মদ ইসহাক দেহলভী (র.), ৮. শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.), ৯. শাহ ওয়ালী উল্লাহ আল উমরী আল দেহলভী (র.), ১০. শায়খ আলহাজ মোহাম্মদ আফজল (র.), ১১. শায়খ আব্দুল আহাদ (র.), ১২. শায়খ মোহাম্মদ সাঈদ (র.), ১৩. শায়খ আহমদ সিরহিন্দ (র.) (মোজাদ্দিদে আলফে সানী), ১৪. শায়খ মোহাম্মদ ইয়াকুব কাশ্মিরী (র.), ১৫. শায়খ আহমদ বিন হজর আল মক্কী (র.), ১৬. শায়খ জইনুদ্দীন জাকারিয়া আল আনসারী (র.), ১৭. শায়খ ইবনে হাজর আসকালানী (র.), ১৮. সিরাজুল হুসাইন ইবনুল মোবারক আজজুবায়েদী (র.), ১৯. আবুল হাছান বিন আব্দুর রহমান বিন মোজাফ্ফর দাউদী (র.), ২০. আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিন আহমদ সারাখসী (র.), ২১. আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বিন ইউসুফ বিন মাতার ফিরাবরী (র.) (সানাদুল আহাদীস আননাবাবিয়াহ, ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ প্রদত্ত সনদ)।
উল্লেখ্য যে, ইমাম বুখারী (র.) হইতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত প্রতিটি হাদিসের সনদ প্রসিদ্ধ থাকায় উল্লেখ করা প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয়ত-
১. হযরত ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.), হযরত মাওলানা অজিহ উদ্দিন রামপুরী (র.), ২. হযরত আবু ছাইদ আল মুজাদ্দেদী (র.), ৩. শাহ মোহাম্মদ ইসহাক দেহলভী (র.), ৪. শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.), ৫. শাহ ওয়ালী উল্লাহ আল উমরী আল দেহলভী (র.), ৬. শায়খ আলহাজ মোহাম্মদ আফজল (র.), ৭. শায়খ আব্দুল আহাদ (র.), ৮. শায়খ মোহাম্মদ সাঈদ (র.), ৯. শায়খ আহমদ সিরহিন্দ (র.) (মোজাদ্দিদে আলফে সানী), ১০. শায়খ মোহাম্মদ ইয়াকুব কাশ্মিরী (র.), ১১. শায়খ আহমদ বিন হজর আল মক্কী (র.), ১২. শায়খ জইনুদ্দীন জাকারিয়া আল আনসারী (র.), ১৩. শায়খ ইবনে হাজর আসকালানী (র.), ১৪. সিরাজুল হুসাইন ইবনুল মোবারক আজজুবায়েদী (র.), ১৫. আবুল হাছান বিন আব্দুর রহমান বিন মোজাফ্ফর দাউদী (র.), ১৬. আবু মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বিন আহমদ সারাখসী (র.), ১৭. আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ বিন ইউসুফ বিন মাতার ফিরাবরী (র.)।
আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) সে সব খ্যাতনামা মোহাদ্দিসগণের তালিকায় স্থান পেয়েছেন যারা বুখারী ও মুসলিম শরীফের সাথে নিজেদের জীবনকে আবদ্ধ করেছেন। এটি শুধু তার বৈশিষ্ট্য নয়, মকবুলিয়তের দলিলও বটে। বর্তমানে কয়েক হাজার মোহাদ্দিস তাকে মাধ্যম করে হাদিসের সনদ বর্ণনা করেন তাঁকে উদ্ধৃত করে হাদিসের মর্ম উল্লেখ করেন। কাজেই নিঃসন্দেহে আমরা বলতে পারি আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) ছিলেন ইলমে হাদিসের জন্য এক নিবেদিত প্রাণ পুরুষ।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *