আলিয়া মাদরাসার খেদমতে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর অবিস্মরণীয় ভূমিকা

হজরত আল্লামা মো. আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. এক মশহুর অলি-আল্লাহর নাম। তাঁর কর্মজীবন দীনের বহুমুখী খিদমতে নিবেদিত ছিল। তিনি প্রায় সত্তর বছরকাল একনিষ্ঠভাবে খিদমত করেছেন দীনের। পবিত্র কোরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের শিক্ষা দান, হাদিস শরিফের দারস প্রদান, ইলমে তরীকতের তা’লিম-তরবিয়ত ও আর্তমানবতার সেবা প্রদান ইত্যাদি আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর নানাবিধ খিদমতের অন্যতম। আলিয়া মাদরাসার খিদমতে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা তাঁর রয়েছে তা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করলে বুঝা যাবে তাকে ছেড়ে আলিয়া মাদরাসার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা অসম্ভব।
আলিয়া মাদরাসার উৎপত্তিগত ইতিহাস পড়লে জানা যায়, ১৭৫৭ সালে বাংলার শাসন ক্ষমতা ইংরেজদের কাছে চলে যাওয়ার পর এ অঞ্চলের মুসলমানদের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অধঃপতন শুরু হয়। শিক্ষা, তাহজিব-তামাদ্দুন, রাজনীতি, অর্থনীতি সকল বিষয়ে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়তে থাকে। তখন কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট মুসলমান তৎকালীন বাংলার শাসনকর্তা লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলামি ও যুগোপযোগী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৭৮০ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতার শিয়ালদা স্টেশনের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে প্রস্তাবিত মাদরাসার উদ্বোধন করা হয়। এটি পরবর্তীতে ‘আলিয়া মাদরাসা’ নামে পরিচিত হয়। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলিয়া মাদরাসার বৃহত্তর অংশ কলকাতা হতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। প্রথমদিকে সদরঘাট এলাকায় ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে ইসলামিয়া কলেজের একটি অংশে অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম চালানোর পর ১৯৬০ সালের জুলাই মাস থেকে বখশিবাজারস্থ নিজস্ব ভবনে স্থিত হয়। গোটা মুসলিম জাতির শিক্ষা, মর্যাদা এবং আপন বৈশিষ্ট্য রক্ষার সংগ্রামে এ প্রতিষ্ঠানের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অবিস্বরণীয় কীর্তি অবদানের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক মহৎপ্রাণ ব্যক্তির নাম। যার অন্যতম হলেন হজরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.। আলিয়া মাদরাসাবিদ্বেষী একটি মহল এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটনা, অপপ্রচার এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে সবসময় তৎপর ছিল। আলিয়া বিদ্বেষীদের সক্রিয় সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছেন এবং এখনও করছেন বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিগণ ও তদসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো। কোন কোন মহল অভিযোগ করেন যে, আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল ভিন্ন। ওয়ারেন হেষ্টিংস ইংরেজদের মতলব হাসিলের উদ্দেশ্যে আলীয়া মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। এই ধারণা নিতান্তই অমূলক। এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সাথে তৎকালীন মুসলিম সমাজের স্বার্থ নানাভাবে জড়িত ছিল। বিশেষকরে মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত বেশি। মুসলমানদের দাবি পূরণ করতে গিয়ে ইংরেজদেরও কিছু বাড়তি উপকার সাধিত হয়েছিল, এই কথাও সত্য। কিন্তু আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজরা নিজেদের কাক্সিক্ষত ফল ভোগ করতে সক্ষম হয়নি। তাই তারা মাদরাসাটি বন্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও করেছিল।
বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ম্যাক্স মুলার সরকারী সাক্ষ্য প্রমাণ এবং মিশনারীদের রিপোর্টের ভিত্তিতে লিখেছেন:-
ইংরেজি আমলদারির পূর্বে কেবল বাঙলায় আশি (৮০,০০০) হাজার মকতব ছিল। ইংরেজদের আগমণের পর এগুলোর অধিকাংশই বন্ধ করে দেয়া হয়। বিভিন্ন রিপোর্ট হতেও প্রমাণিত হয় যে, যে সব মকতব মাদরাসা এবং মসজিদ মুসলমানদের ওয়াকফ ও অছিয়তের ভিত্তিতে চালু হয়েছিল। ইংরেজরা সেগুলোর অধিকাংশ বাজেয়াপ্ত করে সম্পত্তিগুলো দখল করে। এমতাবস্থায় মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে যে চরম ও শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়, ইংরেজরা তা ভালোভাবেই অনুভব করতো। মুসলমান প্রতিনিধিগণ শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের দুর্দশার কথা এবং মুসলিম সন্তানদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান কায়েম করার আবেদন যে জানান, তাতে এ দুর্দশার জন্য সৃষ্ট ইংরেজ কর্তৃক সৃষ্ট উপরে বর্ণিত কারণগুলোর কথা তারা উল্লেখ না করলেও গভর্ণরের আবেদন পত্রে বর্ণিত দাবিগুলোর যৌক্তিকতাও অস্বীকার করার উপায় ছিল না। সুতরাং মুসলমানদের আবেদন গৃহীত হয়।
আলিয়া মাদরাসাকে কেন্দ্র করে ইসলামি শিক্ষার বহু প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সংস্থা এবং ছাত্র সংগঠন ইত্যাদি জন্ম লাভ করে। সেগুলো সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ও বেসরকারী হলেও প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য। উদাহরণস্বরূপ বেসরকারী আলিয়া মাদরাসাসমূহের (আলিম ও ফাযিল) কথাও উল্লেখ করা যায়। কামিল টাইটেল পর্যায়ের বহু মাদরাসা আলিয়া নামে খ্যাত। ইবতেদায়ি, দাখিলসহ আলিয়া মাদরাসার সংখ্যা বিপুল। পূর্বে যে দেশে একটি মহিলা মাদরাসাও ছিল না, বর্তমানে সেদেশে সহস্রাধিক মহিলা মাদরাসা এবং কিছু মহিলা আলিয়া মাদরাসাও রয়েছে। কামিল বা টাইটেল মাদরাসাগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের সমপর্যায়ের বলে গণ্য করা হয় এখন। আলিয়া নেসাবের এসব মাদরাসা পরিচালনার সরকার অনুমোদিত সংস্থা বা একটি স্বতন্ত্র বোর্ড রয়েছে, যা বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নামে পরিচিত। এ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে রয়েছে হাজার হাজার মাদরাসা।
প্রসঙ্গ উল্লেখ্য যে, ইলমে হাদিসের ন্যায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. ইলমে কিরাতেরও সনদ প্রদান করেন। ১৯৫০ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত উত্তীর্ণ ক্বারীগণকে ২০০২ সালের ৩১ মার্চ একটি বৃহৎ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনদ ও পাগড়ি প্রদান করা হয়। ৩য় বিভাগ ব্যতীত এবং সঠিক সময়ে আবেদন করতে না পারা, বিদেশে অবস্থান, পরকাল গমনকারী ইত্যাদিগণ ছাড়া সনদ গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল চার হাজার। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়া অসংখ্য দারুল কেরাতের শাখা এবং ইলমে কেরাতের এতো সংখ্যক শাগরেদগণ সমস্তকিছুই আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর জন্য ছিল মহান আল্লাহ প্রদত্ত মহা নেয়ামত। প্রাপ্ত এই নেয়ামতকেও আলিয়া মাদরাসার খিদমতে কাজে লাগাতে পিছপা হননি তিনি। দেখা যায়, শুধু রামাদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত দারুল কেরাতের এসব শাখার জন্য কোন কোন স্থানে স্থানীয় শাগরিদ, মুরিদ এবং মুহিব্বিনগণের আন্তরিক উদ্যোগে স্থায়ীভাবে ভূমি ক্রয় করতঃ ঘর নির্মাণও সম্পন্ন হয়েছে। অনুকূল পরিস্থিতিতে ক্ষেত্রবিশেষে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর পরামর্শ, নির্দেশ, তত্ত্বাবধান, ও পৃষ্ঠপোষকতায় দারুল কেরাতের উক্ত ধরণের শাখায় সারাবছর লেখাপড়ার উপযোগী হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে এসব প্রতিষ্ঠান কোথাও ইবতেদায়ি, কোথাও দাখিল, আলিম, কোথাও-বা ফাজিল ইত্যাদি স্তরে উন্নিত হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী আলিয়া মাদরাসাভূক্তি লাভ করে। অপরদিকে প্রতি রামাদানে অনুষ্ঠিত কেরাত শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি বরং আলিয়া মাদরাসার সুবাদে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী প্রাপ্ত হচ্ছে। এহেন প্রেক্ষাপটেও অসংখ্য আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষকের গৌরব অর্জনে সক্ষম হন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.। সুতরাং বলা যায়, ইলমে কেরাতের খিদমতের সুবাদে ইহকালীন অর্জনকেও আলিয়া মাদরাসার খিদমতে নিবেদিত করে তিনি কিংবদন্তিতুল্য মনিষী হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন।
আলিয়া মাদরাসা শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন ও স্বকীয়তা রক্ষার কাজকে অবিচল এবং তরান্বিত করার লক্ষ্যে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে মাদারিছে আরাবিয়া’। আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট এ সংস্থাটি মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীসহ মাদরাসা সমূহের স্বার্থ রক্ষায় সবসময় প্রভূত ভূমিকা পালন করেছে। এছাড়া মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছিন’-এর অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে যেসব অবদান রেখেছেন তা আলিয়া মাদরাসার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এরও পূর্বে ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী তখন নিউস্কীম মাদরাসা বিলোপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা হাইকোর্ট বারে অনুষ্ঠিত এক সভায় ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ এ সম্পর্কিত সরকারি অর্ডারের কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আন্দোলনের ঘোষণা দেন। প্রকৃতপক্ষে এ মহান ব্যক্তি ছিলেন আলিয়া মাদরাসা তথা দীনের একনিষ্ঠ খাদেম।
বাংলাদেশে মুসলিম জনতার আকিদাকে সিরাতাল মুস্তাকিমের অন্তর্ভুক্ত করতে এবং এতে অটল রাখার তাগিদে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. ১৯৭৯ সালের ১ মার্চ প্রতিষ্ঠা করেন গণসংগঠন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ’। প্রয়োজনের তাগিদে ১৯৮০ সালের ১৮ মার্চ প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’। উক্ত সংগঠন দুটি রাজনৈতিক কার্যক্রমের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হলেও আলিয়া মাদরাসার উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখে।
১৯৮৮ সালে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে তৎকালীন সরকার। ইনকিলাব আলিয়া মাদরাসার স্বার্থসংশ্লিষ্ট একমাত্র মুখপত্র। তাই ইনকিলাব পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধের প্রতিবাদে এবং বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর নির্দেশে আনজুমানে আল ইসলাহ ও আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার উদ্যোগে সিলেট রেজিস্টারী ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সমাবেশ। ধীরে ধীরে এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। দৈনিক ইনকিলাব বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারে বাধ্য হয় সরকার। এভাবে আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীর সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদাররিছিন ভেঙ্গে দেয়ার ষড়যন্ত্র হলে ঢাকার বিজয় সরণিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলনে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর বীরত্বপূর্ণ হুমকি ষড়যন্ত্রকারীদের ভীত কাঁপিয়ে তুলে।
আলিয়া মাদরাসার ষড়যন্ত্রকারীদের পূর্বপ্রোথিত ষড়যন্ত্রের বীজ ২০০৬ সালে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে ফাযিল ও কামিল জামাতকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যস্তসহ মাদরাসায় ৩০% মহিলা শিক্ষিকা নিয়োগের সিদ্ধান্তের সকল আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়ে যায়। দেশের ইসলামি চিন্তাবিদ তথা আলিয়া মাদরাসা প্রেমিকদের মনে আশংকা দেখা দেয় যে, এবার ঠিকই তলিয়ে যেতে বসেছে মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন দেশের আলেম-উলামা, পীর মাশায়েখসহ প্রকৃত ইসলামি নেতৃবৃন্দ। আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. ঘোষণা করেন বিভিন্ন কর্মসূচি। এর চূড়ান্ত অংশ হিসেবে সিলেট থেকে সাত শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে লংমার্চ করেন ঢাকা অভিমুখে। স্মরণ কালের শ্রেষ্ঠ উক্ত লংমার্চ পরবর্তী বায়তুল মুকাররাম মসজিদের উত্তর গেটে অনুষ্ঠিত জনসমুদ্রে তার সাহসী হুংকার স্তব্ধ করে দেয় এহেন ঘৃন্য সব আয়োজন, স্থিমিত হয় ষড়যন্ত্র। এর পর ২০১২ সালের ৬ আগস্ট ‘ইসলামি আরবী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১২’ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা কমিটি। মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ এবং ফাজিল (স্নাতক) ও কামিল (স্নাতকোত্তর) পর্যায়ের পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির আধুনিকীকরণ ও উন্নতিসাধন, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা বৃদ্ধিসহ মাদরাসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ন্যস্ত করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয় ইত্যাদি বিবেচনায় ২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়। পাসকৃত আইনের আওতায় ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন উক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার কথা উঠলে আরও দুজন সাহসী নেতার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অবদান সামনে চলে আসে। চর্বিতচর্বন হলেও বলতে হচ্ছে যে, ‘জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বাংলাদেশ’ মুসলিম বিশ্বে মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের একটি সর্ববৃহৎ সংগঠন হিসেবে খ্যাতি পায়। এর উন্নয়ন বিস্তারে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে হজরত মাওলানা আলহাজ্ব এম.এ মান্নান র. এবং আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর অনন্য ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬ সাল থেকে ইন্তেকালের পূর্বপর্যন্ত মাওলানা এম.এ মান্নান র. ছিলেন এই ঐতিহ্যমন্ডিত সংগঠনের লাগাতার সভাপতি এবং আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. ছিলেন উপদেষ্টা। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ দুই মহান ব্যক্তিত্বের দক্ষ ও গতিশীল নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে আলিয়া মাদরাসার যে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করেছে, তা আরেক স্বতন্ত্র ইতিহাস। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এবং মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবনমান উন্নয়নে এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তারা। এছাড়া একটি স্বতন্ত্র আরবী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় কায়েম করার পূর্বসূরিদের সুদীর্ঘকালের স্বপ্নকে বাস্তব রূপদানে সদা তৎপর ছিলেন। তাদের ইন্তেকালের পর এসব অসমাপ্ত নেক উদ্যোগসমূহকে পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হাল ধরেন হজরত মাওলানা এম.এ মান্নান র.-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী, দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ্ব এ. এম. এম বাহাউদ্দীন এবং আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর সুযোগ্য সন্তান মাসিক পরওয়ানা সম্পাদক হজরত মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী। মহান ও গুরুদাযি ত্বপ্রাপ্ত হয়ে এ দুই উত্তরসূরী অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে থাকেন। ফলস্রুতিতে তাঁরা সফলতা লাভ করেন। শতাব্দী পুরাতন দাবি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রেই আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. আকাশচুম্বী অবদানের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এগুলি বিশদভাবে সমাজ ও জাতির কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমানে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলিয়া মাদরাসার কৃতি সন্তানদের পদচারণা উল্লেখযোগ্য হারে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং বহির্বিশ্বেও তাদের নানামুখী ভূমিকা দেশ ও জাতির মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আর এর বিরাট একটি অংশ আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর অনুসারী।
একথা সুবিদিত যে, ইলমে তাসাওউফ বা তরীকতের সূত্রেও আলিয়া মাদরাসার খিদমতে নিজেকে নিয়োজিত করতে তাওফিক হয়েছিল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর। ১৯১৩ সালে জন্মগ্রহণ করে তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ছাত্রাবস্থায় খিলাফত লাভ করেন। খিলাফত লাভের পর তাঁর মুর্শিদের অনুমতি ও তাগিদে তাসাওউফ দায়িত্ব সাধ্যানুযায়ী আন্তরিকভাবে আঞ্জাম দিতে থাকেন। দীনের খেদমতে সর্বদা নানাবিধ তৎপরতার ফলে তাঁর মুরিদীন, মুহিব্বিন, খলিফাগণ এবং শাগরিদগণ তথা ইলমে কেরাত, ইলমে হাদিস, ইলমে ফিকহ, ইলমে তাফসীরের সাগরিদ সবাই মিলে অলৌকিক ধরনের বিশাল এক অনুসারী দল গড়ে উঠে। এ দলের সবাই আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর আদেশ-নির্দেশ পালনে সদা তৎপর ও নিবেদিত প্রাণ। যার প্রেক্ষিতে এ দলের মাধ্যমে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র.-এর নেতৃত্বে দেশে-বিদেশে আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ভিত্তিস্থাপন, সার্বিক পরিকল্পনা, সহযোগিতা, পরিচালনা, পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদিতে তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে যেভাবে এই দীনি খেদমত আঞ্জাম হয়েছিল সেভাবে এখনও হচ্ছে। উপরোল্লিখিত আলোচনার ভিত্তিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় শামসুল উলামা, অলিয়ে কামিল, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ র. আলিয়া মাদরাসার খিদমতে নিজেকে নিবেদিতপ্রাণ করে রেখেছিলেন। মাদরাসার জন্য তাঁর অবিস্মরণীয় ভূমিকা ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *