আমরা রোজাদার হই

আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র রামাদ্বান। রহমত, মাগফিরাত, আর নাজাতের স্রোতদ্বারা বয়ে যাবে এ মাসে। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাঁর অসংখ্য পাপী বান্দাকে এ মাসে ক্ষমা করে দেবেন। প্রত্যেক মুসলমানের মনেই একটা আমেজ সৃষ্টি হয় এ মাস কেন্দ্রীক। এ মাসের গুরুত্ব ও ফজিলত অত্যধিক। প্রত্যেক মুসলমানের উপর এ মাসের রোজা রাখা ফরজ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেভাবে ফরজ করা হয়োছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর।’ (আল কুরআন)।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকেই মূলত সাওম বা রোজা বলে। সাওম শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজলে পাওয়া যায় এর অর্থ হলো বিরত থাকা। শুধুমাত্রই পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকাই কি রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য?
রোজা রাখা হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর রোজা তারাই রাখতে পারে যাদের আল্লাহ রহম করেন, কারণ আমরা সমাজে অনেক মানুষ দেখি যাদের শারীরিক সামর্থ্য থাকা সত্বেও রোজা রাখতে পারে না আবার অনেক রুগ্ন,দুর্বল মানুষও ঠিকই রোজা রাখতে পারে।
রামাদ্বান মাসের গুরুত্ব অত্যধিক। আল্লাহ তা’আলার নিকট এ মাস অত্যন্ত প্রিয়।রামাদান মাস আল্লাহর কাছে কতোটা প্রিয় তা বর্ণনা করতে গিয়ে সুন্দর একটি উপমা দিয়েছেন ইবনুল জাওযী। তিনি বলেছেন, ‘বছরের বারো মাস হলো ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বারোজন পুত্রের মতো। এই বারোজনের মধ্যে ইউসুফ আলাইহিস সালাম যেমন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে সবচাইতে প্রিয় ছিলেন, ঠিক সেভাবে বারো মাসের মধ্যে রামাদান মাস হলো আল্লাহর কাছে সবচাইতে প্রিয় মাস। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের বারোজন পুত্রের মধ্যে ইউসুফ আলাইহিস সালামের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ যেভাবে বাকি এগারোজনকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, ঠিক সেভাবে বারো মাসের মধ্যে রামাদান মাসের দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহও ক্ষমা করে দেন’। এ মাসে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সকল দুষ্টু শয়তান কে শিকল পড়িয়ে রাখেন। জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। জান্নাতের সকল দ্বার খুলে দেয়া হয় উম্মতে মুহাম্মদির জন্য। চারিদিকে জান্নাতি আমেজ সৃষ্টি হয়। এ মাসে নেক আমল করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যায় সকল মানুষের জন্য এবং সকল অন্যায় কাজ করা থেকে বিরত থাকাও সহজ হয়ে যায়। এ মাসেই নাজিল হয় পবিত্র কুরআনুল কারীম। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ মাসেই হেরা পর্বতের গুহায় প্রথম ওহি প্রাপ্ত হন। এ মাসে এমন এক রজনী রয়েছে যে রজনী হাজার বছরের চেয়েও উত্তম। আমাদের জন্য আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যে কয়েকটা শ্রেষ্ট রাত দিয়েছেন যেমন, বরাতের রাত,শুক্রবারের রাত,দুই ঈদের রাত ইত্যাদি তার মধ্যে শ্রেষ্ট হলো কদরের রাত।কুরআনে পাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এ রাতের মর্যাদা বর্ণনা করে পূর্ণ একটি সূরা নাজিল করেছেন। এ রাতে যদি আল্লাহর কোন বান্দা যে কোন ভাবে মালিক কে খুশি করাতে পারে তাহলে তার থেকে উত্তম মানুষ এ ধারার বুকে আর কেউ হতে পারে না। এত গুরুত্ব এত মর্যাদা যে মাসের সে মাস কি আমরা এমনিতেই যেতে দিতে পারি? নিশ্চয়ই না। এ মাস আসার পূর্বেই এ মাসের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে যাতে এ মাসের কোন অমর্যাদা না হয়। হয়ত হতে পারে এটাই আমাদের জীবনের শেষ রামাদ্বান।
রামাদ্বান মাস হলো আমাদের জন্য প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসে আমরা অনেক প্রশিক্ষণ লাভ করি। কীভাবে সারা বছর চলব সে শিক্ষাই আমরা লাভ করি। শুধুমাত্র পানাহার থেকে বিরত থাকলেই রোজার প্রকৃত উদ্দ্যেশ্য কখনই বাস্তবায়ন হবে না। একজন রোজাদার সে যেমন পানাহার থেকে বিরত থাকে ঠিক তেমনি থাকে তার সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গকেও রোজাদার বানিয়ে নেয়াই হলো রোজার প্রকৃত শিক্ষা। একজন মানুষ রোজা রাখল অথচ তার মুখ দিয়ে অশ্লীল বাক্য বের হতে থাকল সে কখনই প্রকৃত রোজাদার নয়। রোজাদার ব্যাক্তিকে যদি অপর কেউ গালিও দেয় তাহলে তার উচিৎ হলো সে এর জবাব দেয়া ‘আমি রোজাদার’ বলে। এটা রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখিয়ে দেয়া। একজন রোজাদার কে তার মুখ নিয়ন্ত্রণ করার প্রশিক্ষণ দেয় রোজা খুব গোপনে।

ramadan wallpapers

তাছাড়াও মুখ দিয়ে যত ধরনের নিষিদ্ধ কাজ রয়েছে তা পরিহার করাও রোজার শিক্ষা।
রোজাদার ব্যাক্তি কখনোই কোন মানুষকে হাত বা পা দ্বারা আঘাত করতে পারে না। একজন প্রকৃত রোজাদার সে পনাহার থেকেই শুধু বিরত থাকে না বরং সে তার হাত-পা দ্বারা যত ধরনের অন্যায় করা যায় তা থেকেও বিরত থাকে। প্রকৃত পক্ষে রোজা তো তাই। যে রোজাদার পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকেই শুধু ক্ষান্ত থাকে কিন্তু তার মাধ্যমে অন্যান্য সকল অপরাধ সংঘটিত হয় সে কখনোই রামাদ্বান মাসের ফজিলত লাভ করতে পারবে না। তার এ রোজা শুধুমাত্র ফরজ আদায় হবে কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি তাতে লাভ করতে পারবে না। এ রকম রোজাদারের রোজা শুধু উপবাস থাকাই হয় প্রকৃত রোজা হয় না: যে রোজার প্রতিদান আল্লাহ নিজেই।
আমাদের সমাজ মারত্মকভাবে ধ্বংসের সম্মুখীন। চুরি, ছিনতাই, খুনাখুনি, ধর্ষণ সহ আরো যত ধরনের অন্যায় আছে সব অন্যায় আমাদের সমাজে সংঘটিত হচ্ছে। এসব অন্যায় কাজ আমাদের সমাজে এক্কেবারে শিকড় গেড়ে রয়েছে। আমাদের নৈতিক, ধর্মীয় অধঃপতনই এর জন্য প্রকটভাবে দায়ী। সমাজ থেকে এসব অপরাধ দূর করার জন্য আমাদের রোজার শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে। আমরা যদি রোজার প্রকৃত শিক্ষা আমাদের সমাজে প্রয়োগ করতে পারি তাহলে আমাদের সমাজে হত্যা, চুরি, ডাকাতি, দুর্ণীতি, ধোকাবাজী, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটত না। রোজা আমাদের কি অদ্ভুত ভাবে সকল গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে। আমাদের জীবনটাকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসে। ঠিক সময়ে সাহরি, ইফতার এমন কি যারা সারা বছর তাহাজ্জুদ পড়তে পারি না তাদের জন্য তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার এক অপূর্ব সুযোগ আল্লাহ পাক দিয়ে দেন। রোজার মাধ্যমে আমরা যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি তা যেন রামাদ্বান মাসের পরেও আমরা আমাদের প্রায়োগিক জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। আমরা যেন বাহ্যিক রোজাদার না হই। আমরা প্রকৃত রোজাদার হয়ে আমাদের সব প্রত্যঙ্গকেও রোজার মধ্যে শামিল করি।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *