আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ হৃদয় ছোঁয়া ফুল (৩য় পর্ব)

(পূর্বে প্রকাশের পর)
সৌভাগ্যের ‘জাবাল ই নূর’
আমার ফুলতলী জীবন শুরু হয়েছিল রামাদ্বান এবং দারুল কিরাত দিয়ে। আমার মনের অভাবনীয় উপভোগ্যের ও সৌভাগ্যের জরিয়া ছিল এটি। আমার কাছে এর ব্যবস্হাপনা এক অভিনব, উৎসাহপূর্ণ বিষয় হিসাবে ধরা দিল। এর রূহানী প্রভাব আমাকে মায়ের কথা, বাড়ির কথা সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দিয়ে সম্ভাবনার ‘জাবাল ই নূর’ শৃংগে আরোহণের পাথেয় সংগ্রহেই শুধু ব্যস্ত রাখলো। কালে, অতি ছোট্ট-কম বয়সের এই ছেলেটি ছাহেব ক্বিবলাহ ও ছাহেব পরিবারের প্রতিটি মানুষের থেকে স্নেহের মাল্যে শুধু সমৃদ্ধই হলো না অপার আনুকূল্যের সওগাতে নিজেকে চরম দায়গ্রস্তও করে ফেলল।

দারুল কিরাতের প্রথম জামাআত 
আউয়্যালে ভর্তি হই। মধ্য রামাদ্বানে সকল জামাআতের (ক্লাসের) ছাত্রদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। সে সময় বড়ছাহেব (ছাহেবজাদা হযরত আল্লামা ইমাদুদ্দীন চৌধুরী ছাহেব)-এর সকল কিছুর ব্যবস্থাপনা করতেন। তখনকার দিনে এই প্রতিযোগিতা ক্লাস ভিত্তিক ছিলনা। যারা অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারাই শুধু নাম লেখাতো। বিষয় ছিল ক্বিরাত, হামদ্-না’ত, আযান এবং নালায়ে কলন্দর। নালায়ে কলন্দর থেকে নির্ধারিত ছিল ‘তাওবাহ’(হাত জুড়ে আয় খোদা ময় হাজিরে দরবার হোঁ) মোনাজাতটি। কিরাতেও নির্ধারিত ছোট সূরাহ ছিল। আমি সবগুলোতেই অংশ নিলাম। ক্বিরাত, হামদ্-না’ত এবং নালায়ে কলন্দরে প্রথম হলাম। হামদ, না’ত ও আযান প্রতিযোগীদের বিচারক ছিলেন বড়ছাহেব এবং ক্বিরাত ও নালায়ে কলন্দরের প্রতিযোগীরা সূরাহ মাঊন ও ‘তাওবাহ’ মোনাজাতটি পরিবেশন করে শুনাচ্ছিলেন ছাহেব ক্বিবলাহকে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, যারা নালায়ে কলন্দরের প্রতিযোগী ছিলাম আমাদের প্রচুর ভুল হচ্ছিল। শব্দের উচ্চারণে ও হরফের উচ্চারণের ভুলকে ছাহেব ক্বিবলাহ বার বার শুধরে দিচ্ছিলেন। কোন কোন সময় অসন্তুষ্টও হচ্ছিলেন। সম্ভবত: আমার কম ভুল হয়েছিল কারণ ইতিপুর্বে আমি অন্যত্র সামান্য উর্দু চর্চা করেছিলাম এবং কিছুটা সুর করে পরিবেশনের চেষ্টা করছিলাম। অন্যান্য প্রতিযোগীরা বয়সে আমার থেকে বড় ছিলেন তবুও আমি প্রথম হয়েছিলাম। কেউ কেউ কিছুটা অবাক হয়েছিলেন সত্য কিন্তু ছাহেব ক্বিবলাহর বিচারে আমিই প্রথম স্থান অধিকার করি। পরবর্তীকালে এই ক্বিরাত, এই নালায়ে কলন্দরই হয়ে ওঠে আমাদের আত্মিক যোগসূত্রের ঐকান্তিক দৃড়তার এক অন্যতম মাধ্যম। 
প্রথমে নালায়ে কলন্দর প্রসঙ্গে বলে নিতে চাই। সে সময়ে নালায়ে কলন্দরের অন্তর্ভূক্ত হামদ্, না’ত ও নিবেদন মূলক গজলের সবগুলোই একে একে ছাহেব কিবলাহ আমাকে মাশক্ব দেন। বিকেল, সন্ধ্যা যখনই ডাক পড়ত হাজির হতাম। প্রতিটি গজল একাধিকবার গেয়ে গেয়ে শুনাতাম, তিনি শুধরাতেন।বিশেষত, শব্দ ও হরফের উচ্চারণ এবং একটি শব্দের সাথে পরবর্তী শব্দের সংযোগকালীন উচ্চারণ। নালায়ে কলন্দরের বেশ কিছু না’ত তাঁর পরবর্তী সময়ের রচনা যা নতুন সংস্করণের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি বাড়িতে বা সফরে যখনই কিছু লিখতেন আমাকে ডেকে নিয়ে প্রথমে পড়ে শুনাতেন, এর পর আমাকে দিয়ে পড়াতেন, আমি পড়তাম তিনি শুধরে দিতেন। এভাবে বার বার তাঁকে গেয়ে শুনাতাম একান্তে, মাহফিলে-মাজলিসে। আমি লক্ষ্য করেছি মাহফিলে হোক কী একান্তে হোক তাঁর অন্তরের আকুতির শব্দরূপ যখনই আমার উচ্চারণে ধ্বনীরূপ হয়ে পরিবেশিত হয়েছে, বিগলিত অশ্র“ধারায় তিনি সিক্ত হয়েছেন। সম্ভবত: ছাহেব ক্বিবলাহর শাগরিদ-শিষ্যদের মধ্যে আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবান, যাকে তিনি উর্দু ভাষায় রচিত তাঁর গীতিকাব্য-হামদ,না’তের অনুপম সওগাত ‘নালায়ে কলন্দর’ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মাশক্ব দিয়েছেন, অনুশীলন করিয়েছেন। আমি এই কাব্যের অনেকগুলো গজলেই সুরারূপ করেছি, নিজে গেয়েছি এবং নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ছাহেবজাদা হযরত মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী’র পৃষ্টপোষকতা ও ব্যবস্থাপনায় ‘পরওয়ানা প্রোডাকশন’ থেকে রেকর্ডও বের করেছি। এতে করে পরবর্তীদের জন্য এর অনুশীলনের দ্বার হয়েছে উন্মুক্ত এবং হৃদয়গ্রাহী এই সূফী কাব্যের অমিয় ঝর্ণায় সিক্ত হতে পেরেছে আল্লাহপ্রেমী রাসূলপ্রেমীদের অন্তর।
খোদা ছে ভীক লে কর হাম 
মদীনা জানেওয়ালা হায়,
দরে দওলত হাবীবুল্লাহ ছে 
আখের কুছ ভী লেনা হায়।

শরম যাতে খোদা হামকো 
বুলা কর খা-লি ফেরনা হায়,
দরে পাকে নবী ছে হাম 
জো হায় আরমা ও লেনা হায়।

মাক্বাম আরফা তাওয়াফ ইহরাম 
গুলামী কা নমুনা হায়,
হায় আ-খের মানযিলে মাক্বসুদ 
হামারা ত্বায়বাহ্ জা-না- হায়।’ 
(নালায়ে কলন্দর)

প্রাণের লওহে কুরআন লেখা
দারুল ক্বিরাতের প্রতিটি ক্লাসে আমার ভালো ফলাফল ছিল। ছাদিছ জামাতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হই। আমার উস্তাদ ছাহেব ক্বিবলাহ’র মাশক্ব (ক্বিরাতের অনুশীলন দেওয়া) আমি হৃদয়ে গেঁথে নেবার চেষ্টা করতাম। বিশেষত: হরফের উচ্চারণ যা তিনি গুরুত্বের সাথে তালাবাদের শিখে নেবার তাগিদ দিতেন। আমি মাশক্বের সময় এক-দু’টি করে হরফকে টার্গেট করতাম যে, আজ দেখবো (শুনবো) ছাহেব ক্বিবলাহ এই এই হরফকে কিভাবে উচ্চারণ করেন। পরবর্তীতে আমি যখন ফুলতলীতে দারুল কিরাতে শিক্ষকতা শুরু করি, আমার ছাত্রদেরকে এই কৌশল বলে দিতাম এবং ছাহেব ক্বিবলাহকে উস্তাদ হিসাবে পাওয়া যে কতবড় সৌভাগ্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত, সেই বিষয়টি তাদের মন-মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। 
ছাদিছ পাশ করার পরের বছরই দারুল ক্বিরাতের প্রধানকেন্দ্র ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে শিক্ষকতা শুরু করি। সম্ভবত ছাহেব ক্বিবলাহই দায়িত্বশীলগণকে বলে দেন, আমাকে যেন রাবে’ পর্যন্ত ক্লাস দেওয়া হয়। পরের বছর থেকে খামিছ পর্যন্ত পড়াবার সুযোগ হয়। এমনিভাবে চলতে থাকে। যে বছর থেকে ছাদিছ জামাতে পড়াবার সুযোগ পাই, তাও ছাহেব ক্বিবলাহর ইচ্ছায় ও নির্দেশে হয়েছে। ছাদিছস্তরের আরো উস্তাদের প্রয়োজন, তাই খামিছস্তরের কথেক উস্তাদকে দায়িত্বশীলগণ স্তর উন্নয়নের পরীক্ষার জন্য ছাহেব ক্বিবলাহর খেদমতে পেশ করেন। ছাহেব ক্বিবলাহ উনাদের কতিপয়ের ক্বিরাত শুনে খামিছ পর্যন্তই থাকতে বলেন। এ সময় ছাহেব ক্বিবলাহ আমার ব্যাপারে জানতে চান, আমি ছাদিছে পড়াচ্ছি কি না। যখন বলা হলো আমি খামিছ পর্যন্ত পড়াই, তখন বললেন, ‘সিদ্দীকুর রহমান তো ছাদিছর স্তরর, এনরে ছাদিছো পড়াইতে দেও।’ পরের দিন থেকে যথারীতি আমাকে ছাদিছের রুটিনে রাখা হচ্ছে, ক্লাস নিচ্ছি। যদিও ছাহেব ক্বিবলাহর নির্দেশেই এটা হয়েছে তবুও কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা লজ্জাবোধ কাজ করেছে, কারণ ছাহেব ক্বিবলাহকে যেভাবে সবাই ক্বিরাত শুনিয়ে ছাদিছ পড়ানোর স্তরে উন্নীত হন, আমারও এই নিয়মের মধ্য দিয়ে আসার কথা ছিল। 
ছাহেব ক্বিবলাহ আমার ক্বিরাতকে-তিলাওয়াতকে পছন্দ করতেন। যে কোন উস্তাদই ছাত্রের অনুকরণের পারদর্শিতা এবং শিখানো বিষয়ের প্রতি আন্তরিক অনুরাগকে তাঁর প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধাপূর্ণ আত্মনিবেদন হিসেবেই দেখেন। ছাহেব ক্বিবলাহ’র স্নেহধন্য সিদ্দীকুর রহমান হৃদয় দিয়ে তা অনুভব করত। অনেক সময় প্রবীণ উস্তাদগণের উপস্থিতিতেও আমাকেই তিলাওয়াত করতে বলতেন। অনেকেই ধরে নিবেন অল্পবয়সী নবীন ক্বারী হিসাবে সাহস বাড়ানো ও উৎসাহ দেওয়ার নিমিত্বে হয়তো এটা করা হয়ে থাকবে। হাঁ, প্রথমদিকে হয়তো এটা ছিল, কিন্তু যারা দেখেছেন ও অনুধাবন করেছেন তাঁরা অবশ্যই বুঝে থাকবেন, এর মাধ্যমে তিনি একটি বার্তা পৌঁছে দেবার কোশেশ করতেন। 
বাংলাদেশের স্বনামধন্য এক ক্বারী ছাহেব ঢাকায় এক ঘরোয়া অনুষ্টানে ছাহেব ক্বিবলাহ’র সাথে দেখা করতে আসেন। ছাহেব ক্বিবলাহ তাঁকে কিছু তিলাওয়াত করার জন্য বলেন। তিনি মাজুর ইত্যাদি বলে অপারগতা প্রকাশ করেন। ছাহেব ক্বিবলাহ আমাকে তিলাওয়াত করতে বললে আমি তিলাওয়াত করি। ছাহেব ক্বিবলাহ আমার দিকে ইশারা করে মেহমানের কাছে জানতে চান-কেমন হয়েছে তিলাওয়াত। 
ভারতের (করিমগঞ্জ,আসাম) আদমখাকি মোকামে ক্বিরাতের দরছের মাধ্যমে ছাহেব ক্বিবলাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি যে খেদমত শুরু করেছিলেন, ১৯৯৮ সনে তাঁর ইন্ডিয়া সফরকালীন সময়ে উলামা, মাশায়েখ, ইমাম-খতীবগণের অনুরুধক্রমে এই আদমখাকি মোকামেই এক বৃহত্তর ব্যবস্থাপনায় তিনি ঐতিহাসিক আ’ম মাশক্ব দেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এই সফরে ছাহেব ক্বিবলাহ’র সফরসংগী হয়ে অনেকের মত আমিও গৌরবান্বিত হই। ছাহেব ক্বিবলাহ’র বিভিন্ন মাহফিলগুলিতে তিলাওয়াত করি। সফর শেষে ছাহেব ক্বিবলাহ আমাকে আরও কিছু দিন থেকে যাবার নির্দেশ দেন। ইমাম ও মুয়াজ্জিনগণের যাদের ক্বিরাতে দুর্বলতা রয়েছে সপ্তাহে একদিন হলেও আমার কাছে ক্বিরাতের মশক্বে হাজির হতে নসিহত করেন। উজানডিহির ছাহেব হযরত সৈয়দ জুনাইদ আহমদ মাদানী মুদ্দাযিল্লুহুলআলী’র তত্বাবধানে ছাহেববাড়ি মসজিদে প্রতিদিন বাদ যুহর ক্বিরাতের মশক্ব দিতে থাকি। দু মাসের অধিক কাল ইন্ডিয়াতে অবস্থান কালে হযরত সৈয়দ জুনাইদ আহমদ মাদানী ও হযরত সৈয়দ মুস্তাক আহমদ মাদানী মুদ্দাযিল্লুহুলআলাইহিমা’র দোয়া ও স্নেহছায়ায় ধন্য হই।
(চলবে)

আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ হৃদয় ছোঁয়া ফুল (২য় পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *