আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ হৃদয় ছোঁয়া ফুল (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)
কোন কাননের ফুল
জন্ম আমার সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) তারাপুর গ্রামে। কয়েক শতাব্দী আগে আমার পূর্ব পুরুষগণ এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। তাঁদেরই একজন সাদ মুহাম্মদ এই অঞ্চলে নিজের নেতৃত্ব ও প্রতিপত্তির জন্য বিখ্যাত হন। তিনি ছিলেন আরব বণিক পরিবারের সন্তান। তাঁর পুত্র দানিস মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্র জামশীদ মুহাম্মদ এবং তাঁর পুত্রত্রয় হলেন নাসির আহমদ চৌধুরী, শাহ আহমদ চৌধুরী এবং নাহার আহমদ চৌধুরী আমার তিন পরদাদা (প্রপিতামহগণ)। আমার পরদাদা নাহার আহমদ চৌধুরী কলকাতা আলিয়ার ফাজিল ছিলেন। মা মৃত্যুশয্যায়, টেলিগ্রাম পেয়ে তিনি বাড়িতে আসেন। মায়ের ইন্তেকাল হয়, এর দশ দিনের মাথায় তাঁর বড় ভাই শাহ আহমদ চৌধুরীও ইন্তেকাল করেন, যিনি ছিলেন যৌথ পরিবারের কর্তা ও পরিচালক। নাহার আহমদ সাহেবের আর কলকাতা ফিরে যাওয়া হয়নি। পরিবারের দায়িত্ব তাঁকে বহন করতে হয়। তাঁর বাকী জীবন পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয়। তাঁর সমাজ কল্যাণের গল্প মানুষের মুখে মুখে ছিল। তিনি এক সময় লকালবোর্ড সদস্য নির্বাচিত হন (একই সময়ে লকালবোর্ড সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন দেওয়ান হাসন রাজার জামাতা, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের পিতা দোহালিয়ার দেওয়ান মোহাম্মদ আসফ)। আমাদের অঞ্চলে তাঁর জনকল্যাণের স্বীকৃতি বা স্মারক স্বরূপ মুরব্বী-বয়স্কদের কাছে ‘নার মামন্দর সড়ক’(নাহার আহমদের সড়ক), ‘নার মামন্দর পুকুর’(নাহার আহমদের পুকুর), ইত্যাদি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
আমার দাদা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম চৌধুরী হলেন শাহ আহমদ চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সন্তান। পরিবারের প্রধান, চাচা নাহার আহমদ চৌধুরীর ইন্তেকালের পর যৌথ পরিবারের পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর উপর পড়ে। তিনি তাঁর বাবার একমাত্র (পুত্র) উত্তরাধিকারী হিসাবে সংগত কারণেই তাঁর অন্যান্য চাচাত ভাইদের তুলনায় বেশী সম্পত্তির মালিক হন। বাড়ির অংশ, জমির অংশ এবং জলমহালের অংশ সব দিক থেকেই তাঁর ভাগে বেশী সম্পত্তি ছিল। এই জন্য দাদার চাচাত ভাইদের মনে তাঁর প্রতি হিংসা ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে সেই হিংসার শিকার হওয়ার স্বাদ আমার পিতা গ্রহণ করেছেন এবং আমরাও করছি। আমার দাদা আব্দুর রহীম চৌধুরী সাহেব অধিনস্থদের প্রতি ছিলেন খুবই উদার। সাধারণত: জমিদার-মিরাসদারগণের মেজাজ ও মর্জির শিকার হতেন অধিনস্থরা এবং এক্ষেত্রে ন্যায় ও সুবিচার পাওয়াও হতো তাদের জন্য কঠিন। কিন্তু আমার দাদা আব্দুর রহীম চৌধুরী সাহেব তাঁর নিজের পরিবারের মানুষের অবিচার (কোন কোন ক্ষেত্রে হিংস্রতা) থেকে অধিনস্থদের রক্ষা করতেন। তিনি দীর্ঘ কয়েক টার্ম সরপঞ্চ ছিলেন। তিনি তাঁর সম্পদ মানুষের জন্য ব্যয় করতেন। সমাজসেবী-পৃষ্টপোষক, আলেম-বান্ধব ও পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। আমার ছোটকালে আমি তাঁকে আলেম পরিবেষ্টিত দেখেছি। তাঁর পৃষ্টপোষকতায় সেকালে ভারত ও পাকিস্তানের বিখ্যাত দ্বীনী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিয়েছেন এমন আলেম হযরাতের সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছে। আমার স্মৃতিতে আছে, আমাদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিলে অনেক আলেম অংশ নিতেন। যিনি মিলাদ শরীফে নেতৃত্ব দিতেন তিনি খুবই সুন্দর সুরে পড়তেন। দাদাজী তাঁর নাতিকে আলেম বানাতে আব্বাকে অসিয়ত করে যান। দাদাজীর এই অসিয়ত-নসিহতই হলো আমার মাদ্রাসায় পড়ার মূল কারণ। দাদার এই অসিয়ত-নসিহতের কথা ছোটকাল থেকেই আমাকে বলা হতো। আমার মনে আছে, হলদিপুর প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ফাইভে পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েক দিন পর আব্বা আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য যান। দাদা (আব্বার মামা মরহুম দলীল উদ্দীন চৌধুরী) আব্বাকে বলেন, ‘হে তো পড়াত ভালা আছে, স্কুলো পড়লে জজ ব্যারিস্টার না অউক, উকিল মুক্তার কিচ্ছু অইত পারত’। আব্বা বললেন, ‘বাবার অসিয়ত তারে যেনো মাদ্রাসাত পড়াইয়া আলিম বানাই।’ দাদাজীর ইন্তেকালের সময় আমি পাঁচ-ছয় বছরের ছিলাম। আমার সকল দোয়াতেই দাদাজীকে স্মরণ করি। মনে জাগে তাঁর হাত ধরে মসজিদে যাওয়ার স্মৃতি, তাঁর সকালের কুরআন তেলাওয়াতের সুর, বিছানার কোনায় বসে তাঁর শখের বন্দুকটি মোছা-মাছার দৃশ্য; মনে পড়ে তাঁর বানানো ‘আল্লাহ রহম শিন্নী’র কথা।


আমার সাত বছর বয়সে আমি খুব অসুস্থ হই। আমার টাইফয়েড হয়েছিল। শরীর জুড়ে বসন্তও বের হয়েছিল। জ্বরের প্রভাবে আমি নাকি অজ্ঞান হয়ে যেতাম। হাঁস, মুরগি, ছাগল সাদকা করা হয়েছে। আম্মা বলেছেন, আমার দাদীকে ঐ সময় তিনি দোয়া করে করে খুব কাঁদতে দেখেছেন। আব্বার অবস্থা কি হয়েছিল জানার সুযোগ হয়নি। আব্বাদের স্নেহ-মায়ার বিষয়গুলি সব সময় নেপথ্যেই থেকে যায়। আম্মা নিজের কান্নার কথা বলেননি তবে তাঁর একটি স্বপ্নের কথা বলেছেন। আমার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ব্যথায় কাতর মা একদিন স্বপ্নে দেখেন, তিনি আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি আছেন, আর ওখানে এক বুজুর্গ দেখতে তাঁর বাবার মত ফর্সা; পাগড়ী পরিহিত ঘন দাড়ির শুভ্র-সুন্দর বুজুর্গ হাতের ইশারায় তাঁকে ডাকছেন। তিনি এই বুজুর্গের সামনে গিয়ে দাঁড়ান, আমি মায়ের হাত ধরে আছি। এই বুজুর্গ তাঁকে বলেন, তোমার বাচ্চাটি আমার কাছে দিয়ে দাও। আমার আম্মা খুবই অবাক হয়ে বুজুর্গকে জিজ্ঞাসু সুরে বলেন, আমার ছেলেটি আপনাকে দিয়ে দিব? বুজুর্গ বলেন, একেবারের (চিরদিনের) জন্য নয়, কিছু দিনের জন্য। আম্মা হাত ছাড়িয়ে আমাকে বুজুর্গের দিকে ঠেলে দেন, আমি যেতে থাকি, মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। এই স্বপ্ন দেখার পর থেকে আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। আম্মা মাঝে-মধ্যেই এই স্বপ্নের কথা বলতেন। আমরা উভয়েই চিন্তা করতাম- কে এই বুজুর্গ! আম্মা এবং আমার এক রকমের নিশ্চিত ধারনা ছিল, স্বপ্নে দেখা এই বুজুর্গ আমার নানার (শাহ আবুল মুনয়ীম মুহাম্মদ আব্দুস সুবহান) বংশের কেউ হবেন। কারণ, আম্মা স্বপ্নে দেখা ঐ বুজুর্গকে নানাবাড়িতে দেখেছেন এবং আমার নানার বংশে অনেক আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ গত হয়েছেন। আমার নানার কুল হযরত শাহজালাল মুজার্রাদে ইয়ামনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র সংগীয় দরবেশ হযরত শাহ বন্দেআলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র বংশধর। যাই হোক, বড় হওয়ার পর দীর্ঘ দিন ঐ স্বপ্নের কথা আমরা কেউই তেমন আলোচনায় আনিনি। ফুলতলীতে লেখা-পড়া ও ছাহেব ক্বিবলাহ’র স্নেহছায়ায় বড় হওয়া কালে আম্মার ঐ স্বপ্নের কথা কোন কোন সময় আমার মনের মধ্যে উদয় হত। আমি যখন ফুলতলী আলিয়া মাদ্রাসায় আলিম জামাতে পড়ি, প্রায় এক যুগের পর এই সময়ে আম্মা আমাকে নিশ্চিত করেন তাঁর স্বপ্নে দেখা সেই বুজুর্গ ছিলেন (হযরত শাহজালাল মুজার্রাদে ইয়ামনী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র সংগীয় অপর দরবেশ হযরত শাহ কামাল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র বংশের উত্তরপুরুষ) হযরত ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ। ঐ সময়ে ছাহেব ক্বিবলাহ তাঁর সুনামগঞ্জ সফরের অংশ হিসাবে আমাদের বাড়িতেও তাশরিফ এনেছিলেন।
আমার আম্মার অনেকগুলো স্বপ্নের মধ্যে এটিও এমন এক স্বপ্ন যা ছিল একেবারে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। আম্মা আমার সাথে তাঁর স্বপ্নের বিষয়গুলো শেয়ার করতেন। বর্ণনার স্পষ্টতা এমন ছিল যে, তাঁর স্বপ্নের বিষয়গুলো আমার কাছে চোখে দেখা বিষয়ের মতো ধরা দিত। তাঁর দেখা ‘সবচেয়ে পবিত্রতম স্বপ্নটি’ যা আমার পরিণত বয়সে ইমাম তিরমিযী’র ‘শামাইলে মুহাম্মাদিয়া’র (শামাইলে তিরমিযী) বর্ণনার সাথে মিল পেয়েছি।
আমি আমার মা’কে তাঁর মৃত্যুর সময় দেখিনি। আমি তখন ঢাকায় ফুলতলী ভবনে তাঁকে স্বপ্নে দেখছিলাম। দেখি আমার কালো রংগের ট্রাভেল ব্যাগটি কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়িতে ফিরেছি। আম্মা চিন্তিত অথচ ছেলের বাড়ি ফেরাতে আনন্দিত এমনি মিশ্র চেহারা নিয়ে উঠানের কোনায় পেয়ারা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। বললেন, ‘বাবা তোমার লাগি বারছাইয়ার, তোমার গেছতাকি বিদায় নিতাম’। একেবারে দিনের আলোর মত স্পষ্ট স্বপন। খুব কাঁদলাম। ঐ দিন ফুলতলী ভবনে আমি একাই ছিলাম। দিনের সূর্য উজ্জ্বল হতে থাকলো, এ দিকে আমার মায়ার বাঁধন ছিড়ে গিয়েছে। মমতার আঁচল উঠে গিয়ে আমার স্বপ্নেরা শিকারির জালে আটকে পড়া বন্য হরিণের মত ছটফট করে করে একরাশ যন্ত্রণা শুধু অশ্র“র ধারায় ব্যক্ত করছে। আমি একা, বড় একা! আমার স্বপ্নেরা ঝরে ঐ চেনা মেঠোপথে একা!
বাড়ি থেকে আম্মার মৃত্যুর (১৯৯৯) সংবাদ সিলেটে ছাহেব ক্বিবলাহ’র কাছে পৌঁছানো হয়। ছাহেব পরিবারের সম্মানিতগণ আমাকে বলেছেন, খবরটি পাওয়ার পর ছাহেব ক্বিবলাহ বার বার এই কথাটি বলতে থাকেন, ‘তারে আমি এই খবরখান কিলান কইতাম!’ হায়! তারে আমি এই খবরখান কিলান কইতাম!’
পথ চেয়ে বসে নেই মা !
ফুলপুর স্টেশনে বেশ দেরীকরে ট্রেন পৌঁছল আজ
আষাঢ় রাতের মেঘ দখল করেছে পুরো আকাশ
বৃষ্টি ঝরেছে কিছু আগে, হয়তো ঝরবে এখনই আবার
ঘরে ফেরার তাড়া ভ্রমণশ্রান্ত মানুষের পায়;
আমার স্বপ্নেরা ঝরে এই চেনা মেঠোপথে একা:
তাড়া নেই, সন্ধ্যে হলে হোক, পথ চেয়ে বসে নেই মা!
চোখের সামনে এই পাখিডাকা ভোর আজ হয়না জানা
ঘটে সব যার মতো যেমনটি কথা ছিল আগে আর পরে
মনোজ্ঞ জলসায় অনাহূত কাক এক বিরক্তির কারণ
মায়ার আঁচল গেলে সরে এমনই হয় বুঝি সময়-চাবুক;
মমতানদী এযে শুকনো উঠোন এই ভরা বরষায়:
তাড়া নেই, সন্ধ্যে হলে হোক, পথ চেয়ে বসে নেই মা!

চলবে

আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষ হৃদয় ছোঁয়া ফুল ১ম পর্ব

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *