সামাজিক খেদমতে আল্লামা ফুলতলী (রহ.)

কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পরস্পর নির্ভরশীল ও সংগঠিত জনসমষ্টিই হলো সমাজ। মানুষ সামাজিক জীব। তাইতো সমাজবদ্ধ হয়ে জীবন কাটাতে হয়। মানুষ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। এই সমাজের মানুষ বিভিন্ন ধরণের, বিভিন্ন প্রকৃতির। কেউবা নিজের জন্য থাকে ব্যস্ত। কেউবা অন্যের অনিষ্ট করতে লেগে থাকে। আবার কেউ সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে নিয়ে ভাবে, কাজ করে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষদেরকে নিয়ে যারা বর্তমান শতাব্দীতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের মধ্যে যামানার মুজাদ্দিদ শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) অন্যতম। তিনি সমাজের মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে ব্যয় করে আজো অমর হয়ে আছেন দেশে-বিদেশে। যার উপকারে উপকৃত হচ্ছে ব্যক্তি, সমাজ, দেশ, জাতি সকলেই। প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে। তিনি নিরবে নিভৃতে আজীবন সৃষ্টির সেবায় প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন। কারণ তিনি জানতেন-উত্তম মানুষ সে, যে মানুষের উপকার করে।
হাদিস শরিফে এসেছে হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) হতে বর্ণিত ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন আমি এবং এতিমের অভিভাবক (লালন-পালনকারী) এইভাবে (একসাথে) জান্নাতে থাকব। তখন তিনি তর্জনী এবং মধ্যমাঙ্গুলীদ্বয়ের ইতি ইঙ্গিত করেন।-(বোখারী)। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) এতিমদের পাশে থেকে তাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৭২ সালে নিজ বাড়ি ফুলতলী-তে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি তাঁরই নামে নামকরণ করা হয় ‘লতিফিয়া এতিমখানা’। এতে হাজার হাজার এতিম সন্তানরা সঠিক অভিভাবকত্বের সৌভাগ্য লাভ করে দৈন্যদশা হতে বেরিয়ে আসছে। বর্তমানে প্রায় ২০০০ এতিম অবস্থান করে জীবনের গ্লানি দূর করার পাশাপাশি সুশিক্ষিত হচ্ছে।

গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, নলকূপ স্থাপন, বৃক্ষরোপন এগুলো শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর ছিল নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। আর্তমানবতার সেবায় তিনি ছিলেন সচেষ্ট, নিবেদিত প্রাণ। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘মুসলিম হ্যান্ডস্ বাংলাদেশ’। যার অধীনে গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ, এতিমদের বৃত্তি প্রদান, বৃক্ষরোপন, অন্ধ-প্রতিবন্ধীদের সাহায্য প্রদান, নূলকূপ স্থাপন, বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাসহ নানাবিধ কার্যাবলী পরিচালিত হয়ে থাকে। এর অধীনে ফুলতলী ছাহেব বাড়িতেও একটি ডিসপেনসারী আছে।
ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রেও শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর অবদান কোনো অংশে কম নয়। সামাজিক শৃঙ্খলা ও মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় স্থানীয় বিচার-সালিশে ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে লোকজন তাঁর নিকটস্থ হতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর জোরালো ভূমিকা। চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, খুন-রাহাজানি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর অগ্রণী ভূমিকায় সামাজিক শান্তি, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থাৎ স্থানীয় হিন্দুরাও তাঁর ন্যায় বিচার, সামাজিক নিরাপত্তা, সাহায্য সহযোগিতায় উপকৃত হয়েছে। তাঁর ভূমিকা ছিল ঐ হাদিসের মতোই-রাসুল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন-এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার প্রতি জুলুম করে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে সাড়া দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার প্রয়োজনে সাড়া দেন। আর যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের একটি বিপদ দূর করবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার একটি বিপদ দূর করবেন। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) অত্র হাদিসের আলোকে নিজের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে সাজিয়েছিলেন।
হাদিস শরীফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্ল­াহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একটি ঘর (মসজিদ) নির্মাণ করল, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করবেন। আল্লামা ফুলতলী (রহ.) সামাজিক ও দ্বীনি খেদমত হিসেবে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণসহ পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন আজীবন। যেগুলো আজ সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে অতুলনীয় ভূমিকা রাখছে।
ছাত্রসমাজ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। এরাই দেশকে আগামী দিনে নেতৃত্ব দিবে। তাদের সঠিক লালন-পালন ও পরিচর্যার মাধ্যমে সুফল ভোগ সহজতর হবে। এই ছাত্র ও যুব সমাজকে ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালনা করা অত্যাবশ্যক। তারই প্রেক্ষিতে যামানার মুজাদ্দিদ, শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ১৯৮০ ইং সনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’। যার মাধ্যমে বর্তমান ছাত্র সমাজ সামাজিক অবনতি ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করছে। দেশ, জাতি ও মুসলমানদের ক্রান্তিলগ্নে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ, অন্যায় কাজের বিরোধীতাসহ সমাজের উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে।
এসকল সামাজিক খেদমত ছাড়াও যামানার মুজাদ্দিদ, শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) অসংখ্য খেদমত করে গেছেন। তিনি গরিব, দরিদ্র, ও অভাবী মানুষকে উদারহস্তে সাহায্য করতেন। দূর্দিনে, বিপদে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। বিশেষ করে বন্যা ও দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে গরিবদের মাঝে চাল, ডাল, কাপড়সহ নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিস বিতরণ করে মানুষদের মুখে অনেকটা হাসি ফুটানোর চেষ্টা করতেন। মাদরাসা, মক্তব, মসজিদ, স্কুল প্রতিষ্ঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদিতেও ভূমি প্রদান করে এলাকার উন্নয়নে অভূতপূর্ণ কাজ করে গেছেন। সময়ে সময়ে তাঁর সময়োপযোগী পদক্ষেপে বড়ো বড়ো সমস্যার সমাধান হয়েছে। সংকট-সংঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে মানুষের জান-মাল। তিনি সমাজ সেবায় সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এই মহান মনীষী প্রায় বলতেন-
তরীকত বজুয খিদমতে
খাল্কে নেস্ত
বসুজ্জাদা তাসবীহ ওয়া
দালকে নেস্ত ॥

Comments

comments

About

Check Also

নালায়ে কলন্দর : পূত হৃদয়ের নান্দনিক ছন্দবদ্ধ অভিব্যক্তি

মাহবুবুর রহীম আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) রচিত উর্দুভাষার কাব্যগ্রন্থ ‘নালায়ে কলন্দর’। ‘কলন্দর’ হচ্ছে কাব্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *