সেরা বিস্ময়

স্থান, কুড়িগ্রাম। চুন সুরকি উঠে যাওয়া দ্বিতল বাড়ির সামনে উঠোনে বসা চশমাপরা ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ। হাতে ইয়া লম্বা জোড়াবেত। বেতের পুরত্বও মন্দ নয়। এই বেত কারো পিঠে পড়লে চোখের অশ্র“ সংবরণ হবে এটা এক প্রকার অসম্ভব বলা যায়। বৃদ্ধের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বছর দশের এক বালক। চোখেমুখে রাজ্যের ভীতি যেন কোন পুলিশ ইন্সপেক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বৃদ্ধ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। গোটা কয়েকবার পায়চারি করলেন উঠোনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত। তারপর আবার চেয়ারে এসে বসলেন। ছেলেটার শুকনো মুখ আরো শুকিয়ে গেলো।
-বল, তোর এত্তো বড় সাহস ক্যামনে হইল?
ছেলে নিরুত্তর।
-আদনাইন্না, আমি তোরে জিগাইতাছি। বেত দেখছস? কতা ক, নাইলে এই বেত দিয়া পিঠের ছাল উঠাই দিমু।
-ভুল হইয়া গেছে, মিয়াদাদু।
পুরনো সম্ভ্রান্ত মিয়াবাড়ির একাদশ প্রজন্মের ফসল মিয়া রহিম উদ্দিন ঝান্টু এলাকায় বড় মিয়াসাব হিসেবেই পরিচিত। বাচ্চারা তাকে ডাকে মিয়াদাদু বলে। মিয়াদাদু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ঠিক এমন সময় প্রধান ফটক ঠেলে দুজন মানুষের অনুপ্রবেশ ঘটলো। ছেলেটা একটু আশার আলো খুঁজে পেলো।
-মিয়াসাব, আছছালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুমুসসালাম।
এদের একজন বড় মিয়াসাবের পরিচিত, আনিস সওদাগর। আরেকজন অচেনা। মিয়াসাব খুব ভালো করে লোকটাকে আপাদমস্তক দেখে নিলেন। তার কৌতুহলী দৃষ্টি এবার গিয়ে পড়লো আনিস সওদাগরের চোখে।
-ইনি ঢাকা থেইকা আইছেন। গরীব প্রতিবন্ধী বাচ্চাগো লাইগা একটা স্কুল করবার চাইতাছেন।
মিয়াসাবের চোখ এবার আনুমানিক বছর ত্রিশের ওই লোকটির দিকে।
-আমি সোহান চৌধুরী। বাড্ডায় থাকি। গরীর অসহায় প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করাটা আমার নেশা বলতে পারেন। আমি চাই এদের একটা সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে। আর আপনার সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।
মিয়াসাবের চেহারা দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ফিরে বললেন, “আনিস, উনি আমাদের গ্রামের মেহমান। ওনারে তোমার বাড়িতে লইয়া যাও। “বলে ভেতরবাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলেন। সোহান অবাক হয়ে গেলো মিয়াসাবের আচরণ দেখে। মনে মনে ভাবতে লাগলো, “লোকটা কী! নূন্যতম ভদ্রতাটুকুও জানে না নাকি!”
মিয়াসাব ছোট ছেলেটার সামনে গিয়ে থেমে গেলেন। হাতের বেত উঁচিয়ে বললেন, “কানে ধর। ”
ছেলেটা অচেনা লোকদের সামনে ভয়ে লজ্জায় কান ধরল।
-এক হাতে ধর। এক ঠ্যাং উপ্রে উঠা।
ছেলেটা তাই করলো। এইবার সূর্যের দিকে তাকাই এইভাবে খাড়াই থাক।
সোহান আর চুপ থাকতে পারলো না। আরে আপনি কি মানুষ!! আপনি তো শিশু অধিকার খর্ব করছেন।
মিয়াসাব মাথা ঘুরিয়ে এমনভাবে তাকালেন যে সেই চাহনি দেখে সোহানই ঘাবড়ে গেলো।
-কার কাছে আসলাম!! বলে সোহান দ্রুত বেরিয়ে গেলো।
পরদিন দুপুর তিনটা। মিয়াসাবের বৈঠকখানায় বসে আছে আনিস। সাথে সোহানও।
-এই আপনার জন্যে আবার আমাকে আসতে হলো। এমন নির্দয় লোকের বাড়িতে দ্বিতীয়বার আমি এসেছি ভাবতেই আমার ঘৃণা হয়।
-মিয়াসাব খুব ভালা মানুষ ভাই। তয় মিয়ার বেটা তো! মেজাজটা একটু কড়া এই আর কী! ব্যাপার না!
-ছিঃ ছিঃ, অমন ছোট্ট একটা ছেলের সাথে অতো বড় নিষ্ঠুরতা! ভাবা যায়! আর আপনি বলছেন, ভালো মানুষ! ছিঃ ছিঃ।
-না মানে….
এমন সময়ে মিয়াসাব প্রবেশ করলেন। সাথে আরো দুজন।
আজ আর সোহান মিয়াসাবের দিকে তাকাতে পারছে না ঘৃণায়। মিয়াসাব সোফায় বসতে বসতে সোহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। ইশারায় ওদের বসতে বললেন।
তারপর আনিসকে বললেন, “আনিস ওনারে বলো উনি স্কুলটা করতে পারে। ওনারে অনুমতি দেওয়া হইল। ”
সোহান কিছুটা বিস্মিত হলো। কিন্তু তার ঘৃণার পরিমাণ তার বিস্ময়ের পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি। নেহায়েত এই মিয়ার বেটার অনুমতি ছাড়া কিছু করা এখানে সম্ভব নয়, নাহলে এমন নিকৃষ্ট লোকের কাছে কে আসতো।
-কি যেন নাম?
সোহান চৌধুরী, আনিস উত্তর দিলো।
মুখে বিরক্তি নিয়ে মিয়াসাব ধমকের সুরে বললেন, “মিয়া তোমারে জিগাইছি। তার মুখ নাই!”
-সোহান এবার অনিচ্ছাসত্ত্বেও উত্তর দিতে বাধ্য হলো। জ্বী, সোহান চৌধুরী।
-কাছে আহেন।
-জ্বী।
-হ, কাছে আহেন।
সোহান তিন কদম সামনে এলো। কেন যে ওর হাঁটু কাঁপছে, বুক ধুঁকধুঁক করছে সে বুঝতে পারছে না।
এবার মিয়াসাব ডাকলেন, “আদনাইন্না এদিক আয়। ”
বাড়ির ভেতর থেকে আদনান বেরিয়ে এসে ভয়ে ভয়ে দাঁড়ালো। সোহান আবার অবাক হলো।
মিয়াসাব শুরু করলেন, “আমি চক্ষু দেখলে মানুষের মন পড়তে পারি। চুলগুলি বাতাসে পাকে নাই। এই পোলায় রাস্তায় দুইডা মাইয়ারে হেগো স্কুলে যাওনের পথে বাজে কতা কইছে। আমি নিজের কানে শুনছি। এল্লাইগা তার শাস্তি পাওয়াডা জরুরি ছিল যেন আর কোনদিন কোন মেয়েরে অসম্মান না করে।
-কি, আর করবি?
-না মিয়াদাদু।
সোহান হা করে তাকিয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
-যা ভাগ এখান থেইকা।
এবার আবার মিয়াসাবের তীক্ষèদৃষ্টি সোহানের দিকে।
-মানুষ যা দেখে তাই ঠিক না। চামড়ার চক্ষু দিয়া সব দেহা যায় না। মনের চক্ষু দিয়া দুইন্নাডারে দেখবেন। জোয়ান মাইনসের রক্ত সবসময় বেশি গরম থাহে। আবেগ বেশি। মাথা স্থির না। বাচ্চাগো নিয়া কাজ করতে আইছেন। মাথা যেন সবসময় ঠান্ডা থাহে। চক্ষু খোলা থাহে। আপনে বুদ্ধিমান। আমি আশা করি, আপনে সফল হন। আমারে যে কোন দরকারে স্মরণ কইরেন।
সোহান অবাক বিস্ময়ে হা করে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছে। তার অপলক দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে মিয়াসাবের চোখের দিকে। এই প্রথম ও সেই চোখে আবিষ্কার করলো একইসাথে দয়া এবং প্রত্যয়। সেখানে কোন নিষ্ঠুরতার ছাপ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে আরো অবাক করে দিয়ে পাশের লোকটার হাত থেকে নিয়ে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন মিয়াসাব
-এটা কী?
-খুইলা দেহেন।
সোহান খাম খুলল। সাদা কাগজের ওপর স্ট্যাম্প আর লেখা। ওর চোখগুলো ছলছলিয়ে উঠলো। বিস্ময়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, বিশ একর!!!
-হ। স্কুলডা স্কুলের মতো কইরেন না। একটা স্বপ্নপুরীর মতো কইরা কইরেন। যেহানে বাচ্চারা মনের আনন্দে ভুইলা যাইব যে তারা প্রতিবন্ধী, সমাজে অবহেলিত। অনেক গাছ লাগাইবেন। ফুলের গাছ, ফলের গাছ। শিশুপার্ক। একটা বড় লাইব্রেরি আর যা যা দরকার সব, সবকিছু। মিয়াসাবের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে।
মিয়াসাব বাম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে ইশারা দিলো। সে গিয়ে ভেতর থেকে হুইল চেয়ারে বসা একটা বছর সাতের ছেলেকে নিয়ে আসলো।
-আমার নাতি। লিমন। কথা বলেন। আমি আসি।
বলে মিয়াসাব দ্রুত চলে গেলেন বাড়ির ভেতরে। সোহান কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে গেলো। এমন বিস্ময়কর মানুষও এ জীবনে দেখেনি। মিয়াসাব আজ ওর চোখে ওর জীবনের সেরা বিস্ময় হয়ে ধরা দিচ্ছে, যে বিস্ময়ের কাছে হার মানছে পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য।

Comments

comments

About

Check Also

ইমাম সাব

ইমাম সাবের চেহারা দেখে টাসকি খেয়ে গেল হাসান। ‘ইহাও দেখার বাকি ছিল!’ ঝরে যাওয়া ঝাড়–র …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *