পারিবারিক বোঝাপড়া জাঁতাকলে সন্তানরা

রিমা ৮ম শ্রেনীতে পড়ে। ওর বাবা একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদদের লাভ ক্ষতি সমুদ্রের গ্রোতের মতো। সেদিন ঘরে ঢুকেই বাবা ইলিয়াস মেয়েকে ডাকে, একটা চেক দেখিয়ে বলে-
দেখো মা! আমি একটা ব্যবসায় এই চেকটা লাভ করেছি।
বাবার মন খুব ভালো। রিমা কি এমন একটা দিনের অপেক্ষা করছিলো তা আমার, আপনার বা রিমার মায়ের এমনকি ইলিয়াস সাহেবেরও জানা নেই। বাবার মন ভালো দেখেই মেয়ে আবদার করে-
বাবা আমাকে একটা ট্যাব কিনে দাও, আমার কতদিনের সখ।
ইলিয়াস সাহেব মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি। ট্যাব কিনে দিবেন কথা দেন। এই বিষয়ে রিমার মা কিছুই জানেনা। মাত্র ৩/৪ দিন পরেই বাবা মেয়ে শপিং এ যায়, ঘরে ফিরে ট্যাব নিয়ে। রিমার মা আনিসা মেয়ের হাতে ট্যাব দেখে অবাক হন। আস্তে আস্তে রিমা ট্যাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। হওয়াটা স্বাভাবিক মনে করি আমি। কারণ এই বয়সটাই যে খুটিয়ে খুটিয়ে জানার, দেখার, শেখার। আনিসা ইলিয়াসকে বলে-
মেয়েকে এটা কিনে দিলে, অথচ আমায় বললেনা। মেয়ে এখন সারাক্ষণ ওটা নিয়েই পড়ে থাকে।
ইলিয়াস সাহেব কথাটা কানে নেয়নি। বরং জবাব দিয়েছে-
আমার মেয়েকে আমি দিয়েছি, তোমার সমস্যা কি?
রিমা কোচিং এ যায়, প্রাইভেট এ যায়। যাওয়ার সময় ট্যাব সাথে করে নিয়ে যায়। অন্য বান্ধবীরাও মোবাইল ট্যাব নিয়ে আসে। একজন অন্যজনের থেকে কত কি শেয়ার করে নিয়ে আসে আর বাসায় এসে রাতে চুপে চুপে সেগুলো দেখে। মা আনিসার চোখে পড়ে এসব। ইলিয়াসকে বললে সে বিশ্বাস করে না। উলটো আনিসাকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেয়। আনিসা এখন পড়লো বিপদে। সে বুঝছে মেয়ে অন্য পথে চলে যাচ্ছে। প্রথমে মেয়েকে বুঝাতে চেষ্টা করে, তাতে কাজ না হলে নিজেই রাতে মেয়ের সাথে ঘুমানো শুরু করে। মায়ের সাথে নিজের রুম শেয়ার করতে রাজি না রিমা। আনিসা মেয়ের রুমে ঘুমালে মেয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় ঘুমায়। এই নিয়েও শুরু হয় সমস্যা। আনিসা ট্যাব দেখতে চাইলে রিমা ট্যাবে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখে। মেয়ের পাশে ঘুমাতে গিয়ে কৌশলে পাসওয়ার্ডটা জেনে নেয়। ইলিয়াস বিশ্বাস করেনি বলে বাধ্য হয়ে ট্যাবে কি আছে মেয়ে কি দেখে তা ইলিয়াসকে দেখায়। এরপর ইলিয়াস বিশ্বাস করে। কিন্তু ততদিনে রিমা অনেকটাই আসক্ত হয়ে পড়ে। বাবা মা কারোই নিষেধ শুনে না। কিছু বললে তর্ক করে জেদ দেখায়। রিমা এখন নিজের ইচ্ছে মতোই চলে, কারো কথা শুনে না।
আনিসা অনেক আক্ষেপ করেই বলে-
ইলিয়াসের সাথে আমার সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো না। এইজন্যে মেয়ের কোন ব্যাপারে আমার মতামত সে নিতে চাইতো না। সম্পর্ক এখন আরো খারাপের দিকে। কিন্তু আমি কি করবো। মেয়ের পাশে আমি ঘুমাই এটা স্বামী চায়না। সে এটাও বুঝেনা সন্তানের ভালোর জন্যেই আমি সন্তানের পাশে থাকতে চেয়েছি।

লিয়াকত আর অদিতির সম্পর্ক তেমন ভালো না। লিয়াকত পরকিয়ায় জড়িত বলে প্রায় দুজনের কথা কাটাকাটি হয়। ঘরে আসলে তেমন কথা বলে না। ঘুমানো ছাড়া বাসায় তেমন থাকেও না। যখন তখন অদিতির দোষ ধরে বেড়ায়। ওদের ঘরে একমেয়ে দুই ছেলে। ছেলেরা ছোট হলেও মেয়ে সব বুঝে কারণ ও বড়।
লিয়াকত আগে সাধারণ মোবাইল ব্যবহার করতো, অদিতিও। লিয়াকত একটা লেটেস্ট মোবাইল কিনে। এখন আগের মোবাইলটা বাড়তি। ওদের মেয়ে অলি পড়ে মাত্র ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে। একদিন লিয়াকত বলে,
আমার আগের মোবাইলটা অলিকে দিয়ে দিব।
অদিতি বলে-
এই ছোট মেয়েকে মোবাইল দেয়ার দরকার নাই। বরং মোবাইলটা ঘরেই থাকুক। যখন আমি বাসার বাইরে যাব ওদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবো।
তার দরকার নেই। আমি এটা ওকেই দিব। অনেক বলে কয়ে মেয়েকে বুঝিয়ে অদিতি মোবাইলটা মেয়েকে না দিয়ে ঘরেই রাখে। মেয়ের যখন কথা বলার দরকার হয় মায়ের বা বাবার মোবাইল দিয়েই কথা বলে।
অদিতি মেয়েকে আগেই বলেছে তোমায় এখন মোবাইল দিব না। এখন তো আমিই তোমার সাথে স্কুলে যাই, প্রাইভেট এ যাই, যখন দরকার আমারটা ব্যবহার করবে। এইচএসসি পাশ করার পর তোমায় ভালো একটা সেট দিব। মেয়ে তেমন কিছুই বলেনি। বরং খুশি হয়েছে। সে ভাবেই মেয়েকে বড় করে। মেয়ে নিজেই বলে ছোট বেলায় মোবাইল দিলে ওর ক্ষতিই হতো।

দিপা এবার সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। ফলাফল ভালো করেছে। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ইভাও ভালো ফলাফল করে। ইভার বাবা ওকে ৩৫ হাজার টাকা দামের ট্যাব কিনে দেয়। সে অনেক খুশি। খবর আসে দিপার কানে। ছোট বেলায় অন্যদের হাতে ট্যাব দেখে নিজে চাইতো। ওর মা সালমা বলতো,
আমরা এমন পরিবারের নয়, যে খেলার জন্যে এত টাকা দিয়ে ট্যাব কিনে খেলবো।
এখন সমাপনী পাশ করার পর দিপা চায় ওকেও এমন একটা ট্যাব কিনে দেয়া হোক। বোনের আবদার বুঝে বড় বোন রিয়া ও চায় ওকে ট্যাব কিনে দিতে। এতে বাবা ও রাজি আছে। কিন্তু ওর মা সালমা রাজি নয়। বড় বোন রিয়া চেয়েছে দিপাকে একটা সাইকেল কিনে দিতে। এতে মা রাজি থাকলেও বাবা রাজি নেই। কথার ছলে বুঝা যায় ট্যাব কিনে দিতে রাজি আছে রিয়ার বাবা।
তাই অনেকদিন ট্যাব কেনা হয়নি। মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই দিপা বলতো। মা বুঝিয়ে বুঝিয়ে রাখতো। একদিন দিপা বুঝতে পারে বাবার পকেটে টাকা আছে, বাবার সাথে কথা বলতে বলতে রাজি করে ফেলে। বাবা বলে দিয়েছে দিপাকে ট্যাব কিনে দিবে। সালমা তেমন বাধা দিতে পারেনি। কিন্তু মেয়েকে বলেছে,
এটা আমার কাছেই থাকবে। অল্প সময়ের জন্যে পাবে। তবে সামনের পরীক্ষা খারাপ হলে ভাববো এটার জন্যেই খারাপ হয়েছে। তাহলে আর পাবেনা।
মেয়ে কথাটা মেনে নেয়। সে ভাবেই দিপাকে ট্যাব কিনে দেয়া হয়। পরের বার পরীক্ষায় সত্যি ও ভালো করেনা। এজন্যে সালমা ট্যাবটা সরিয়ে রাখে। নিজে সময় করে মাঝে মাঝে ১০/১৫ মিনিটের জন্যে দিত। ২য় পরীক্ষায় দিপা ভালো করে। সালমা মেয়েকে এগুলো বুঝিয়ে বলে। এই সময়টা এমনি যত দেখবে দেখতেই চাইবে, জানতে চাইবে। কিন্তু নিজের ক্ষতি করে নয়। দিপাও বুঝতে পারে বিষয়টা।
এক পর্যায়ে দিপা বুঝে আসলেই ওর ট্যাব কেনা ঠিক হয়নি।
আমাদের সমাজের অনেক পরিবারের বাবারা সন্তানের কিছু ক্ষেত্রে অতি উৎসাহী হয়ে থাকেন। এমনিতেই সন্তানদের শাসন বেশি করেন মায়েরা, কারণ ওদের ভালো মন্দ মায়েরাই বেশি দেখেন। সেখানে বাবারা একটু উৎসাহী হলে দেখালে সন্তানরা মায়ের চেয়ে বাবার পক্ষ নেয়। আর যে সব পরিবারে স্বামী স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক টানাপোড়নের হয় সে পরিবারের পরিবেশ অন্য রকম হয়। সন্তানরা কিছু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে, তখন রোজগার করা বাবা নিজের মতামতকে চাপিয়ে দেয় যা সন্তানের জন্যে ক্ষতিকর। সন্তান ভুল করতে পারে, কিন্তু সন্তানের ভালো মন্দটা বাবা মা দুজনকেই একসাথে ভাবতে হবে। পরামর্শ দিতে হবে, নিতে হবে। মনে রাখতে হবে বাবা মায়ের সম্পর্কের জাঁতাকলে যেনো সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ হারিয়ে না যায়।

Comments

comments

About

Check Also

ইমাম সাব

ইমাম সাবের চেহারা দেখে টাসকি খেয়ে গেল হাসান। ‘ইহাও দেখার বাকি ছিল!’ ঝরে যাওয়া ঝাড়–র …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *