দার্জিলিংয়ের স্মৃতি

ছেলেবেলা থেকেই দুষ্টু ছিলাম। বুদ্ধি যা ছিল দুষ্টুমি না করে পড়ালেখার দিকে খাটালে স্কলারশীপ একটাও বাদ পড়তোনা এ আমি দিব্যি করে বলতে পারি। চঞ্চল ছিলাম যেমন ভ্রমণ করার শখও ছিল খু-উ-ব। মায়ের কাছে শুনেছি আমার এক মাসতুতো ভাই দার্জিলিং থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি মাসির বাড়ি।
শরতের কোন এক পড়ন্ত বিকালে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। মাসিকে বললাম-মাসিমা আমি দার্জিলিং যাবো।
শুনেছি সেখানে কত পাহাড় পর্বত যার ভেতর থাকে শ্বেতভল্লুক। শ্বেতভল্লুক দেখতে আমার ভীষণ ইচ্ছে। আরো আছে ফলমূল যা তোমাদের জন্য নিয়ে আসবো। ধমক দিয়ে ওঠেন মাসি – জানিস্ গোবিন্দ সেখানে শীত কত ! আর মানুষেরা শুধু ফলমুল খেয়েই বেঁচে থাকে। আমি বললাম- তাহলে মেজদা থাকে কেমন করে? আমিও নাছোড়, অবশেষে রাজি হলেন মাসিমা। মেজদার হ্যাটকোট আমাকে দিলেন আর মেজদাকেও জানিয়ে দিলেন আমার আগমন বার্তা। মেজদা ছিলেন স্টেশনমাস্টার। কাজেই আমার ট্রেনভাড়া হলো ফ্রি। এক সোনালী সকালে দার্জিলিংগামী ট্রেনে চেপে বসি। ফ্রি-অব্-কসট ফার্স্টক্লাস ঠেকায় কে? আমার পাশের সীটে সস্ত্রীক এক নেপালী ভদ্রলোক, সামনে একটি বাঙ্গালী পরিবার। সহযাত্রী নেপালী বাবুরা কী একটা ফল খাচ্ছিলেন যা আমাকেও দিলেন। জামের মতো দেখতে, আকারে একটু বড়। এমন সুস্বাদু ফল আগে কখনো দেখিনি।
ট্রেন চলছে ঝম্ ঝম্ ঝম্। পাহাড়ীপথ। বাঙালি মেয়েটিতো বাড়ি থেকে যা খেয়েছিলো ট্রেনের ঝাঁকুনিতে তা হজম করতে পারলোনা। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিলো ওর করুণ অবস্থা দেখে। পুরু কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। শুনলাম বাঘ-ভালুক লাফ দিয়ে এসে ট্রেন থেকে মানুষ ধরে নিয়ে যায়, তাই এ প্রোটেকশন। মানুষের ছায়া কোথাও নেই। হরিণগুলো ছুটোছুটি করছে। বাঘ, ভালুক বিচরণ করছে অবাধে। এ দৃশ্য অবর্ণনীয়। মাথা নুইয়ে আসে শ্রদ্ধায়। স্রষ্টার রাজ্য যে শুধু মানুষের জন্য নয়, সব জীবেরই সমান অধিকার প্রথম উপলব্ধি করলাম। কে বানিয়েছিল দুর্গম পাহাড়ে রেলপথ!
হুইসেল! কী হলো! সবাই আতঙ্কিত।

ট্রেনটা আরোও জোরে হুইসেল দিতে থাকলো। পাহাড়ের মতো জন্তুটা ট্রেনের পথ আগলে রেখেছে। হয়তো ওদের ভাষায় বলছে- দাঁড়াও যন্ত্র, এখনি তোমার ঘাড়মটকাবো। আমাদের রাজ্যে এসেছ কোন অধিকারে? বিশালাকার শুঁড় দিয়ে ট্রেনের গরম চিমনি যেইনা ধরেছে অমনি বনভূমি কাঁপানো বিকট চিৎকার। ভোঁদৌড়। পায়ের তলায় যা পড়লো দুমড়ে-মুষড়ে ভেঙ্গে চললো। এযাত্রায় রক্ষা পেয়ে মনে মনে স্রষ্টাকে বললাম, মানুষের এই ছোট্টমাথায় এত বুদ্ধি রেখেছ কোথায়!!
কার্শিয়াং স্টেশন পেরোতেই ঠাণ্ডা হাওয়া এসে সুঁচের মত গায়ে বিঁধলো। সহযাত্রীদের দেখাদেখি মেজদার হ্যাট-কোট গায়ে জড়ালাম। আমি হাড়সর্বস্ব কিশোর অমন স্বাস্হ্যওয়ালা মেজদার পোষাক গায়ে কেমন বেঢপ দেখাচ্ছে ভেবে হাসি পেল। অচেনা লোকগুলোর মাঝে আমি এক আজব জীব। দার্জিলিং যাচ্ছি এই আনন্দে লজ্জা অন্তর্হিত হলো। পাহাড় কেটে সুবিধামত জায়গা দিয়ে রেলপথ করা হয়েছে। অজগরের মতো এঁকেবেঁকে ট্রেন চলছে। পঙ্খীরাজ আর কোথায় পাবো, অজগরের পিঠে চড়েই দুলতে দুলতে চলেছি স্বপ্নপুরিতে।
সন্ধ্যানাগাদ পৌঁছে গেলাম কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। স্টেশন থেকে সিঁড়িভেঙ্গে নিচে নামার পথ। কাছেই মেজদার বাসা। দেরি হলোনা খুঁজে বের করতে। কলিংবেল টিপতেই বেরিয়ে এল ৮/১০বছরের একটি মেয়ে। হিন্দিতে কী যেন বললো সে। বাংলার মানুষ হিন্দি শিখব কোথায়? বাবার কাছে শুনেছি, বায়ান্ন সালে ভাষার জন্য ছোটকাকা প্রাণ দিয়েছিলেন। চটকরে পকেট থেকে মাসিমার দেয়া চিরকুটটা বের করে মেয়েটির হাতে দিলাম। ভেতর থেকে ঘুরে এসে আধোবাংলায় ও বলল- “আপনি বসুন, বাবা এখুনি এসে পড়বেন।” ঘরের ভেতর ঢুকে দেখি সামনে-পেছনে দেয়ালের সর্বত্র এমনকি মেঝেতেও কাঁচবিছানো। আমার তো জায়গা হতে পারে সামনের চেয়ারটাই কিন্তু কালোনাগরার স্থান কোথায়? পাছে কেউ দেখে ফেলে, তাই ওকে লুকালাম ব্যাগে। প্লেটভর্তি ফল দিয়েই রিসেপশন-পর্ব শেষ হলো। গলধঃকরণ করলাম যদিও পেঁপেছাড়া সবগুলোই অচেনা।
বাঙালি এসেছে, তাই রাতে ভাতের আয়োজন। খাবারটেবিলে ভাত দেয়া হলো কিন্তু তরকারি নেই। অগত্যা ভাবলাম, পোলাও যখন এমনিতেই খেয়ে নিই। কিন্তু ওমা, লবণ কই! হায়রে, ওরা জানেই না যে, আমি মাছে-ভাতে বাঙালি, ঘি-ভাতে নই। ইস, যদি একটু লবণ আনতাম সঙ্গে! কী আর করার, না খেলেও বলবে আনাড়ি। তাই অতিকষ্টে উদরপূর্ণ করলাম।
সূর্যোদয়ের অব্যবহিত পরই প্রাত:রাশ সেরে মেজদার সঙ্গে বেরোলাম। আকাশছোঁয়া পর্বতমালা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না। শুনেছিলাম বড়পাহাড়, কিন্তু এত্তবড়! মেজদা তার এক বন্ধুর দেখা পেয়ে দাঁড়ালেন। আমি কিন্তু আনমনে অনেকদূরেই চলে এসেছি। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আচমকা কোমর জাপটে ধরে। চমকে উঠি, ইয়ালম্বা শুঁড় দিয়ে আমাকে পেঁচিয়েধরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দিল দৌড়। তারপর আরকিছু মনে নেই আমার।
-এইযে খোকা, তোমার বাসা কোথায়? জ্ঞানফেরার পর মাহূতের ডাকশুনে আচমকা কেঁদে ফেলি। বেঁচে আছি তাহলে!
– এটা পোষাহাতি। বুনোহাতি হলে দশা বুঝতে।
-মার কাছে যাব, একথা মুখ থেকে বেরোতেই খেয়াল হলো, এসেছিতো মেজদার কাছে। অচেনা লোকটিকে মেজদার বাসার ঠিকানা দিলাম। অনেক আদর আপ্যায়নের পর লোকটি আমাকে মেজদার বাসায় রেখে গেল। পরদিন সকালে মেজদা আমাকে নিয়ে শিলিগুড়ি এলেন। মাসিমাকে বললেন, “দুষ্টু ছোঁড়াটার কী হয়েছিল, জানো? সবশুনে তিনি বললেন
– মায়ের ছেলে মায়ের কোলেই যাও।
কক্ষনো অমন দুষ্টুমি করোনা। মনে মনে বললাম-
স্বপ্নেঘেরা সোনার দেশে মায়ের সোনামুখ, আহা! সেইতো আমার সুখ।

Comments

comments

About

Check Also

জীবনের প্রথম ভারত সফর

(পূর্বে প্রকাশের পর)আজমীর থেকে ফেরার পথেখাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.) এর জিয়ারতে পবিত্র আজমীর শরীফে ২দিন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *