সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী : তাসাউফের খানকায় বেড়ে উঠা এক বীর সেনানী

(পূর্ব প্রকাশের পর)
সালাহুদ্দীনের মূল শক্তি ছিল তাঁর ঈমান ও তাকওয়া। দীর্ঘ ৮৮ বছর ক্রুসেডাররা বাইতুল মুকাদ্দাস কেবল নিজেদের শক্তি বলেই দখল করে রাখেনি। বিভক্ত মুসলিম বিশ্বের কতিপয় লোভি শাসককে নারী, মদ ও ঐশ্বর্যের টোপ দিয়ে অক্ষম করে রেখেছিল খ্রিস্টানরা। কিন্তু এসব আবর্জনার একটি ছিটাও আল্লাহর ওলী সালাহুদ্দীনের পদতল স্পর্শ করতে পারেনি। ১১৭০ সালে দারুম অবরোধ ও বিজয়ের মাধ্যমে সালাহুদ্দীনের ফিলিস্তিন অভিযানের সূচনা হয়। ১১৭১ সালে নুরউদ্দীন জংগীর পরামর্শে সালাহুদ্দীন মিশরকে আব্বাসি খেলাফতের অধীনস্থ করেন। এরপর কেরাক ও মন্ট্রিয়াল অভিযানে বের হন। ১১৭৪ সালে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সুলতান নুরউদ্দীন জংগী (র.) শাহাদাত বরণ করলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন সালাহুদ্দীন। সে বছরই ক্রুসেডারদের দখলকৃত সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে তিনি বিজয় লাভ করেন। কুচক্রী মহল নুরউদ্দীন জংগীর বালক-পুত্রকে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলেও জনগণ সালাহুদ্দীনকেই সুলতান বলে গ্রহণ করে। কৌশলে জংগী বংশের সাথে সংঘাত এড়িয়ে মিশরে ফিরে এসে সালাহুদ্দীন মিশরের উন্নয়নে হাত দেন। ১১৭৭ সালে ক্রুসেডাররা যখন সিরিয়া পুনর্দখলে ব্যস্ত, তখন সালাহুদ্দীন আসকালানে অভিযান করে ক্রুসেডারদের ভীত কাঁপিয়ে দেন। একদিকে তাঁকে সামলাতে হচ্ছিল ক্রুসেডারদের, অন্যদিকে দমিয়ে রাখতে হচ্ছিল লোভি শাসকদেরকে। হাজারো প্রতিকূলতা মাড়িয়ে সালাহুদ্দীনের বাহিনী ১১৮২ সালে আইন জালুতে হাজির হয়। ওদিকে ক্রুসেড নেতা গাই অব লুসিগনান তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসে। কৌশলে তার পথ রুদ্ধ করে সালাহুদ্দীন ক্রুসেডারদেরকে দুটি শিবিরে ভাগ করে ফেলেন। বিভক্ত ক্রুসেডাররা সহজেই পরাভূত হয়। সালাহুদ্দীনের বাহিনী সামনে এগিয়ে গিয়ে মুখামুখি হয় রেনাল্ড অব শালিটনের। এই রেনাল্ড সর্বদা হজযাত্রীদের আক্রমণ করত এবং রাসুলুল্লাহ (স.)-কে অকথ্য গালিগালাজ করত। সালাহুদ্দীন তাকে হত্যা করার শপথ করেছিলেন। কিন্তু অসুস্থ সালাহুদ্দীন এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেননি। বড় বিজয়ের পূর্বে এই ছোট ধাক্কাটি মুসলিম বাহিনীর জন্য একটি পরীক্ষা ছিল।
১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস। মাহে রামাদ্বানের শেষ রাত। দুনিয়া বেঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। সালাহুদ্দীন তাঁর বাহিনী নিয়ে সারাটি রাত সালাতুত তারাবীহ ও কিয়ামুল লাইলে কাটিয়ে দিলেন। মালিকের দরবারে ফরিয়াদ করলেন- আল্লাহ, আজ যদি আমাদের জীবনের শেষ তারাবীহ হয়ে থাকে, তবে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে এটুকু প্রার্থণা করছি মাবুদ, বাইতুল মুকাদ্দাসকে তুমি জয় করে দাও। ৩০ রামাদ্বান সকালে গাই অব লুসিগনান এবং রেনাল্ড অব শালিটনের সম্মিলিত বাহিনীর বিপক্ষে চুড়ান্ত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় সালাহুদ্দীনের মুসলিম বাহিনী। সংঘটিত হয় সাহাবায়ে কেরাম-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ যুদ্ধ- জঙ্গে হিত্তিন। রক্তক্ষয়ী এ লড়াইয়ে সালাহুদ্দীনের বীরত্বগাঁথা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। ইনি কি সত্যিই সালাহুদ্দীন ছিলেন? নাকি অবসর ভেঙ্গে উঠে এসেছিলেন খালিদ ইবনে ওয়ালিদ? ইতিহাস আজো দ্বিধান্বিত! বুকে দুর্দম তেজ নিয়ে শাহাদাতের সেহরা মাথায় পরে হাজার হাজার মুসলিম সৈন্য। অবশেষে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিজয় আসে। ক্রুসেড বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গাইকে মুক্তি দেয়া হয়। শপথ অনুযায়ী রেনাল্ডকে নিজ হাতে হত্যা করেন সালাহুদ্দীন। সামনেই জেরুজালেম। ২রা অক্টোবর রাজা বেলিয়ানকে সহজেই অবরুদ্ধ করে মুসলিম বাহিনী। জেরুজালেমের রাজতোরণ উন্মোচিত করে বিজয়ীর বেশে মাসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন বীর মুজাহিদ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী। সেজদায় লুটিয়ে পড়েন মহান রবের সামনে। সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় ক্রুসেড। আমাদের প্রথম কিবলা আমাদের হাতে ফিরে আসে।

পরাজিত সব খ্রিস্টান রাজাদেরকে বিনা বিচারে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন সালাহুদ্দীন। যুদ্ধের ময়দান ব্যতীত ইউরোপের কোন রাজা (রেনাল্ড ব্যতীত), কোন সামরিক-বেসামরিক লোককে তিনি হত্যা করেননি, করতেও দেননি। ৮৮ বছর আগে এই ক্রুসেডারদের হাতে ঝরা ৭০ হাজার মুসলমানের সমুদ্রসম রক্তের কোন প্রতিশোধ নেননি সালাহুদ্দীন। রাহমাতুল্লিল আলামিন (স.)-এর মক্কা বিজয়ের অনুপম আদর্শ তাঁর হৃদয়পটে জ্বলজ্বল করছিল। ত্যাগ ও বদান্যতার দরূণ তিনি শত্রুশিবিরেও সমাদ্রিত ছিলেন। আজো ইউরোপে তিনি ঞযব এৎবধঃ ঝধষধফরহ নামে প্রশংসিত। ১১৯১ সালে গাই অব লুসিগনান ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড দ্য লায়নহার্টকে সঙ্গে নিয়ে তৃতীয় ক্রুসেড পরিচালনা করে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সালাহুদ্দীন তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়। দামেস্কে ফিরে গিয়েই সালাহুদ্দীন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্লান্ত দেহখানি আর সঙ্গ দিচ্ছেনা। ইবনে শাদ্দাদের মতে- কারী জাফর সালাহুদ্দীনের শিয়রের পাশে তিনদিন ধরে তিলাওয়াত করেছিলেন সুরা হাশরের শেষ তিনটি আয়াত। বারবার যে সালাহুদ্দীনকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন রাব্বুল আলামিন, সেই সালাহুদ্দীন তাঁর দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। এবার গোলামকে মালিকের কাছে ফিরিয়ে নেয়ার পালা। ১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ মুসলিম জাহানকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে ইন্তেকাল করেন ইমামুল মুজাহিদীন সুলতান আবু নাসির সালাহুদ্দীন ইউসুফ আইয়ুবী (র.)। ইবনে শাদ্দাদ বলেন- মৃত্যুকালে তাঁর সম্পদের পরিমান ছিল মোটে এক দিনার ও ৫০টি দিরহাম। দাফনের জন্য ঋণ করতে হয়েছিল। পরদিন ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক জানাযা শেষে দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে সমাহিত হন সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী (রহ.)। কিছুটা দূরে, হোমস শহরেই শায়িত আছেন তাঁর পূর্বসূরি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)। পরবর্তী দুটি সপ্তাহ শোকার্ত মুসলমানরা তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে- উঠো সালাহুদ্দীন, উঠো! সালাহুদ্দীনের জিহাদ আমাদেরকে দেখিয়েছে যে, আমরা যখন নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকি; আল্লাহর ওলীরা তখন মশগুল থাকেন আল্লাহর যিকরে। আর সেই ওলী-আউলিয়া যখন খানকা ছেড়ে ময়দানে এসে তরবারি হাতে নেন; তখন সারা বিশ্বের দর্শক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা। আজ সালাহুদ্দীন নেই, তাই নব্য-ক্রুসেডারদের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মুসলিম উম্মাহ পালহীন নৌকার মতো অথৈ সাগরে দুলছে। নেতার অভাব আজ বড় বেশি অনুভূত হচ্ছে।
সেনাপতি, আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আর আপনার ত্যাগের মহিমা প্রজ্বলিত করুন আমাদের মৃত অন্তরে। আসসালামু আলাইকা ইয়া সায়্যিদী।

Comments

comments

About

Check Also

আল্লামা ছাহেব কিবলার সামাজিক খেদমত

এম এ বাসিত আশরাফ ফার্সী কবি বলেছেন:তরীকত বজুয খেদমতে খালক্বে নেসতবসুজ্জাদা তাসবীহ ওয়া দালকে নেসত।ভাবানুবাদ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *