বড়পীর মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (র.) (শেষ পর্ব)

গত সংখ্যার পর
এ্যাকশন নেই কেন
অনেকেই মনে করেন, আলেম ব্যক্তির জন্য পীর ধরতে হবে কেন? অথবা একজন জান্তা আলেমের কী-ই বা শেখার রয়েছে পীরের কাছে? এর একটি বাস্তব উত্তর নিচের ঘটনায়। বড়পীরের পুত্র আব্দুল ওয়াহহাব (র.) বড় আলেম। ওয়াজের জন্য বড়পীরের আগমনের পূর্বে তাঁর পুত্র বেশ সারগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। অবশ্য তাতে মানুষের অন্তরে খুব একটা আলোড়ন দেখা গেল না। এ বিষয়ে বড়পীর তাকে বললেন, তুমি তোমার এলমের জন্য গর্বিত; আমি যখন কথা বলি, তখন আল্লাহর তাজাল্লী প্রকাশিত হয়। আর সেটি পুত্রের চোখের সামনে ঘটল। পুত্র যখন তার ওয়াজের ক্রিয়া দেখতে না পেয়ে নেমে আসলেন, তখন বড়পীর মিম্বরে আরোহন করে বললেন, ‘গতকাল আমি রোযা রেখেছিলাম। উম্মে ইয়াহইয়া (স্ত্রী) ডিম রান্না করেছিল। বিড়াল এসে ডিমের পাতিলটি নিচে ফেললে তা ভেঙ্গে গেল। ডিমটি ধূলোতে মিশে গেল। এতটুকু বলতেই মজলিসে কান্নার রোল পড়ে গেল। বস্তুত : বড়পীরের ডিম ও পাতিলের কাহিনীতে পরম সত্ত্বা, কুপ্রবৃত্তি এবং শয়তানের প্রতি ইঙ্গিত ছিল। ভক্ত-হৃদয় খোদা প্রেমিকগণ তা বুঝতে পেরেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।

নিজ পীরের সাথে বড়পীরের ঘটনা
বড়পীরের মুরশিদ শায়খ আবু সাঈদ মাখযুমী (র.) সম্পর্কে তিনি বলেন, এক সময় আমার তীব্র ক্ষুধা অনুভব হলো। এমন সময় আমার শায়খ আমার নিকট তশ্রীফ এনে বললেন, আমার বাড়ি চলো। একথা বলেই তিনি চলে গেলেন। কিন্তু আমার একটু ইতস্তত: মনে হলো। ইতোমধ্যে হজরত খিযির (আ.) এসে আমাকে যেতে বললেন। আমি গিয়ে দেখি, শায়খ আমার জন্য প্রতীক্ষা করছেন। তিনি অনুযোগ করে বললেন, আমার বলা যথেষ্ট ছিল না যে, খিযিরের বলতে হলো। অতঃপর তিনি নিজ হাতে আমার মুখের খাদ্যের লোকমা তুলে দিলেন। তৃপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি খাওয়াতে থাকেন। বড়পীর বলেন, যে খাবারটি আমার মুখে যেত, তা আমার অভ্যন্তরে এক অপূর্ব নূরে ভরে দিত।
শায়খ আবু সাঈদ বড়পীরকে বেলায়েতের খেরকা প্রদান করে বললেন, এটি সেই খেরকা, যা মহানবী (স.) হজরত আলী (রা.) কে দিয়েছিলেন। হজরত হাসান বসরী (র.)-এর মাধ্যম হয়ে আমার নিকট এসেছিল।

শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও জয়
বাহজাতুল আসরার গ্রন্থে রয়েছে, বড়পীরকে সাধনার বিভিন্ন পর্যায়ে শয়তানের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। যেমন তিনি নিজেই বলেন, একবার এক কুৎসিত-কদাকার, কিম্ভূত কিমাকার, দুর্গন্ধময় লোক আমার নিকট এসে বলল, আমি ইবলিস। অতঃপর গায়েব হতে একটি হাত তার মস্তকে এমন জোরে থাপ্পড় মারল যে, সে জমিনে বসে গেল। এভাবে বহুবার লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে।

অন্য দেশ থেকে বক্তৃতা শ্রবণ
বড়পীরের এক ভক্ত ছিলেন আদী ইবনে মুসাফির (র.)। বাগদাদ থেকে সহস্র মাইল দূরে তার অবস্থান হওয়ায় তিনি ওয়াজ শুনতে আসতে পারতেন না। আর এজন্য তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে একটি বৃত্ত আঁকতেন। অতঃপর সেখানে বসে সঠিক তারিখ ও সময় সূচি অনুযায়ী বড়পীরের সব ওয়াজই তাঁরা সঠিকভাবে শুনতে পেতেন।
তারা সেই ওয়াজ লিখে রাখতেন এবং পরে তাদের লেখার সাথে মিলিয়ে দেখতেন, যারা সরাসরি শুনে লিখে রাখত। কয়েকশ লেখক এই লেখার কাজটি করতেন। সবার লেখাই মিলাতেন।
তাঁর ওয়াজে লক্ষাধিক শ্রোতার সমাগম হতো। আর খালিমুখে ওয়াজের শব্দ সর্বত্র সমান সুস্পষ্টভাবেই শোনা যেত। শায়খ আফীফুদ্দীন ইবনে মুবারক (র.) একাই বড়পীরের বাষট্টিখানা ওয়াজ কিতাব আকারে সংকলন করেন।

বড়পীরের একগুচ্ছ উপদেশ
১. প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমস্ত পাপ বাদ দিয়ে নিজের অঙ্গ অবয়র হেফাযত কর। তাহলে খুব শীঘ্রই তোমার অন্তরের মধ্যে তোমার অঙ্গ-প্রতঙ্গ এর সুন্দর প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠবে।
২. কোনো মুসলমানকে নিশ্চিতভাবে মুনাফিক বা কাফের বলবে না। এটাই সুন্নাত তরীকা। আল্লাহ ব্যতীত কে মুনাফিক! কে কাফির, কে মুশরিক, একথা (নিশ্চিতভাবে) কেউ জানে না।
৩. তোমরা নিজের জীবিকা সংস্থানের দায়িত্ব অন্য কারো ওপর ন্যস্ত করবে না। এটা আল্লাহর দায়িত্ব। তবে তুমি আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। এতে তোমার মর্যাদাও বৃদ্ধি পাবে; আত্মনির্ভরতাও সহজ হবে।
৪. আদব ও বিনয়ের মধ্যেই ধর্মভীরুতা ও অধিক মর্যাদা নিহিত রয়েছে। কারণ স্বভাব চরিত্র দ্বারা নেক লোকের মধ্যে গণ্য হওয়া যায়।
৫. কখনও মিথ্যা বলবে না। হাসি তামাশা বশতও মিথ্যার আশ্রয় নেবে না। যদি সত্য বলার অভ্যাস করতে পার, তাহলে আল্লাহ তোমাকে রূহানী দৃষ্টিশক্তি ও ইলম দান করবেন।
৬. মানুষের নিকট যে কোনো ক্ষুদ্র আশা করা হতে বিরত থাকবে। কারণ, এতে মর্যাদা, সম্মান, নির্ভরশীলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত থাকে। আর এর দ্বারা অনর্থক কথা, কাজ ও চিন্তা থেকে মুক্তি লাভ করতে পারবে।
৭. কোনো অবস্থায়ই কাউকে বদ দোয়া ও অভিশম্পাত করবে না। ধৈর্য ও সংযমের সাথে তোমার ওপর আপতিত অবিচার ও দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হবে। ফলে লোকজন তোমাকে মহব্বত করতে আরম্ভ করবে।
৮. প্রতিজ্ঞা ও শপথ করার চেষ্টা করবে না। সাবধান। তোমার জবানে যেন আল্লাহর নামে শপথ উচ্চারিত না হয়। এভাবে নিজের স্বভাব গঠন করতে পারলে তোমার অন্তরে আল্লাহর নূরের জ্যোতি প্রবেশ করবে। বরং তুমি উচ্চ মর্যাদায় আসীন হবে। সৎকাজের ইচ্ছা বেশি হবে।
৯. রিয়াকারগণ বাহ্যিকভাবে খুবই ধর্মভীরু হয়, কিন্তু ভিতরে তাদের অপবিত্রতা ও কলুষতা পরিপূর্ণ থাকে।
১০. পীরদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ভক্তদের অন্তরের রোগসমূহ নির্ধারণ পূর্বক তা দূর করার উপায় সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে হবে। নিজেকে অন্তরের রোগ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। আরামপ্রিয় হওয়া যাবে না।

বড়পীরের কয়েকটি কারামত
‘ওলিগণের কারামত সত্য’ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা এটি। যারা নবীগণের মুজিযা স্বীকার করে, তাদেরকে হক্কানী পীরগণের কারামতও বিশ্বাস করতে হবে। অলীর জন্য কারামত থাকতেই হবে, এমন নয়। তবে বড়পীরের অসংখ্য কারামতের নিদর্শন রয়েছে। তন্মধ্যে আরও কয়েকটি এই-
১. ইবনে ইসহাক হতে ‘জাওয়াহেরুল কাদেরী’ নামক গ্রন্থে লিখিত আছে যে, বড়পীর সাহেব (র.) বলেন-এক রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আকাশ থেকে কয়েকজন স্বর্গীয় দূত এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে মদীনা শরীফে হজরত আয়েশা (রা.)-এর নিকট রেখে চলে গেলেন। হজরত আয়েশা (রা.) অতিশয় øেহের সাথে কোলে নিলেন। তখন তার স্তনযুগল হতে ঝরনার মতো দুগ্ধ প্রবাহিত হতে লাগল। সেই পবিত্র দুগ্ধ আমি পেট ভরে পান করলাম। আমার প্রাণ শীতল হলো; আমি নিবিড়শান্তি অনুভব করলাম। অদৃশ্য শক্তির বলে আমি বলীয়ান হয়ে উঠলাম। আমার প্রতিটি লোমকূপ মা’রেফাতে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এ সময় হজরত মুহাম্মদ (স.) বললেন, হে আয়েশা। ইনি আমাদের সন্তান। আমাদের চোখের মনি। ইহকাল ও পরকালের জ্যোতি।
২. হজরত ইমাম শারানী (র.) বলেন, বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (র.)-এর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে বাগদাদের কয়েকজন আলেম হিংসাবশত: সিদ্ধান্ত নিল, তারা একশজন আলেম বড়পীরের দরবারে এসে জটিলসব প্রশ্ন করবে। তাই হলো। তারা এলো। বড়পীর কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে মোরাকাবায় থাকলেন। এ অবস্থায় তাঁর বুক হতে এক ঝলক নূরের জ্যোতি বেরিয়ে আলেমদের বুক বিদীর্ণ করে তাদের অন্তরে প্রবেশ করল। এতে তারা অচেতন হলো। এমনকি নিজেদের পোশাক পরিচ্ছদ ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। মাথার পাগড়ী দূরে নিক্ষেপ করল।
কিছুক্ষণ পর বড় পীর সাহেব (র.) তাদের শান্ত হতে বললে তারা স্থির হলো। কিন্তু যেন বেমালুম ভুলে গেল। অথচ আল্লাহর অসীম রহমতে বড়পীর প্রত্যেকের প্রশ্নসহ উত্তর জানিয়ে দিলেন, তারা লজ্জিত হয়ে দরবার ত্যাগ করল। সুবহানাল্লাহ।

উপসংহার
বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বেই মূলত: বড়পীরের ওপর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশে তার মৃত্যু দিবসে ‘ফাতেহা-ই ইয়াজদহমে’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি ছুটি দেয়া হয়। অনেকেই কাদরিয়া তরীকার সবক চর্চা করেন। অনেকে আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেন, তার নাম-উপাধি দিয়ে। সুযোগ পেলে কেউ কেউ বাগদাদে তাঁর মাজারও যিয়ারতে যান। তবে বিপরীত দিকে এটি খুবই ভয়াবহ যে, তাঁকে এতটা উচ্চ তোলা হয়, কেউ কেউ নবীর মতো মনে করেন। তাঁর অছিলা ব্যবহার করা তো যায়ই কিন্তু তাকে তো উলুহিয়াতের পর্যায়ে নেয়া যায় না। আমাদেরকে বড়পীরের প্রতি যেমন আগ্রহ রাখতে হবে, তেমনি তাঁকে নিয়ে যেন শিরক-বিদয়াত না হয়, তাও সতর্কতার সাথে ফেরাতে হবে। আমীন!

Comments

comments

About

Check Also

সলফে সালেহিনের সুযোগ্য উত্তরসূরী আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী র.

(প্রখ্যাত বুযুর্গ খলিফায়ে ফুলতলী আল্লামা মো. শুয়াইবুর রহমান বালাউটি ছাহেব (র.)-এর নিকট থেকে ২০০৯ সালের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *