নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

(পূর্বে প্রকাশের পর)
: শুধু শুধু গাল-মন্দ দেবে ক্যানো? তুমিই মেয়েকে ‘লাই’ দিয়ে খারাপ করছ। নইলে সে কলহ বাঁধাতে সাহস পায়?
: দ্যাখো, খামাখা আমাকে জড়িয়ো না। তোমার গুণবতী বেহাইনের আর দোষ কী? আমিই মেয়েকে যুক্তি দিয়ে খারাপ করছি, তাই না?
: যুক্তি দিচ্ছ, আমি বললাম নাকি? বলছিলাম, আস্কারা দিচ্ছ। মেয়েকে শাঁসিয়ে দিলে হয় যে, কারো সাথেই ঝগড়া করবিনে?
: মেয়ে এসে সে-সব আমাকে বলে কিনা যে, আমি জানব? লোকের মুখেই সব খবর পাই।
: লোকের কথায় কান দিয়ো না।
: লোকে মিথ্যা বলে নাকি? আরো শুনছি যে, জামাই ওকে মার-ধোরও করে।
: তা জামাইয়ের বিরুদ্ধাচারণ করলে, সে মার-ধোরও একটু-আধটু করতে পারে। তাতে আমাদের বলবার কী আছে?
: এই তোমার কথা নাকি?
: হ্যাঁ।
অতঃপর এ প্রসংগের এইখানেই ইতি হইল। জোহরা খাতুন আর কথা বাড়াইতে উৎসাহ পাইলেন না।

আট.
হালিমের কলেজ ছুটি। সে পাঠাগারে বসিয়া পড়াশুনা করিতেছিল। আয়েষা আসিল। আসিয়াই কহিল-হালিমভাই, গোটাকতক অংক কষে দাও-না?
পড়া বন্ধ করিয়া হালিম কহিল-অংক? দেখি দে বইটা এদিকে।… … … বই লইল এবং দেখিল। তারপর পুনঃ কহিল-এহে হে, সেইটে নিয়ে এসেছিস?
: বলো কী? সবাইতো বলে-বীজগণিতটাই সব চাইতে সোজা।
: সবাই বলে বলুক। আমার কাছে এটা খুব কঠিন। যাক গে, জধঃরড় চৎড়ঢ়ড়ৎঃরড়হ তো? পারব মনে হয়। আচ্ছা, এইতো-
গণিত লেখা হবে বুঝলে তো?
: বুজলাম। দাও-না আরো গোটাকয়েক কষে!
: বুঝলেতো নিজে-নিজেই কষতে পারতিস। আমাকে আবার কষে দিতে হবে কেনো? বুঝেছিস কচু! আর, মেয়েদের এ-সব না পড়া-ই ভালো। গার্হস্থ্যবিজ্ঞান নিলে পারতিস্?
: তোমরা তো কেবল অইসব পড়িয়ে আমাদেরকে গার্হস্থ করেই রাখতে চাইছো। সেইটেই বুঝি তোমাদের খুব লাভের, না? … … … একটু বাঁকা কৌতুকের হাসি হাসিল।
হালিমও হাসিয়া জবাব দিল-লাভ যা-ই হোক, যেখানে যাদের শোভা পায়, সেখানকার শিক্ষা-দীক্ষা তাদের পাওয়া উচিৎ।
কৃত্রিম বিরক্তির ভাব কণ্ঠে ফুটাইয়া আয়েষা কহিল-আমরা বুঝি শুধু গৃহেরই শোভা, অন্য কোথাও নয়?
হালিম মৃদু হাস্যে কহিল-শোভা যার থাকে সে সর্বত্রই শোভাময়। তবু শাস্ত্রে বলে-
বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
: অর্থাৎ?.. … … প্রশ্নপূর্ণ চোখে হালিমের মুখপানে তাকাইল।
: অর্থাৎ, গৃহে পাকা গৃহিনীপনায় মেয়েরা যতোটা শোভাময়, ততোটা আর কোথায়ও নয়।
: বুঝেছি তোমাদের ভিউ। আমরা সর্বশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করলে, তোমাদের বৈশিষ্ট্য এবং মাতুব্বরী যে আর কিছুই থাকে না। জ্ঞান-গরীমায় আমরা তোমাদের কাছে খাটো আছি, তাই বড়াই-বাহাদুরী করতে পারো। নইলে যে তোমাদের মান থাকে না পুরুষ হিসেবে, কেমন?
মৃদু হাসিয়া হালিম কহিল-যা’ বলিস তুই!
: আমি যা বলব তা-ই নয়। যা সত্যি তাই বলছি। তোমরা পুরুষেরা বড্ডো স্বার্থপর। তোমরাই মেয়েদেরকে নানানভাবে দাবিয়ে রাখবার ফিকিরে আছো। আজকাল চাকুরি যেরূপ দু®প্রাপ্য এবং মহার্ঘ হয়ে উঠেছে তাতে আমরা মেয়েরাও যদি সেখানে গিয়ে ভাগ বসাই, তাহলে তোমাদের অনেকেরই হয়তো হাড়ি শুকাবে! সে ভয়টাও কম নয়, কেমন?
হালিম একটু খানিক রগড় করিতে ছাড়িল না। কহিল-সে ভয় মোটেই নেই। হাড়ী-কুড়ী সব ভেংগে-চুরে ফেলে বানপ্রস্থ নেবো। কোনো ভয়-ভাবনার বালাই আর থাকবেই না! আর কারো কোনো অসুবিধে না হলেই হলো!
আয়েষা হালিমের রগড় বুঝিতে পারিল। মৃদু হাস্যে কহিল-সে জন্যে ভয় দেখাচ্ছে! আচ্ছা তবে দেখা যাবে-কারা হারে, কারা জেতে।
আয়েষা এবং হালিমের মধ্যে এইরূপ আলাপ যখন চলিতেছিল, তখন ওদের অলক্ষ্যে একটি মুখ বাঁকা হাসিতে উদ্ভাসিত হইয়া একটু উঁকি মারিল। তারপর চোরের মতো ফাঁকি দিয়া চলিয়া গেল। ওরা ইহার বিন্দু-বিসর্গও টের পায় নাই। আমরা সে মুখ চিনিয়াছি। সে মুখ আমাদের রহিমের।
সন্ধ্যা হব-হব করিতেছিল। এমন সময়ে আয়েষা গৃহে ফিরিল। তাহাকে দেখিয়াই তাহার ভাবী পিয়ারা কুটিল কটাক্ষ হানিয়া কহিল-কিগো, সাধ মিটেছেতো? না মিটে থাকে, আবার যাও। রান্না-বান্না সেরে রেখেছি। দুটো নাকে-মুখে গুঁজে নিলেই হলো!
আয়েষা বিরক্ত হইয়া কহিল-কী বাজে বকছো?
: বাজে!
: বাজে নয়তো কী?
: ও-সব ঢং আমরা বুঝি। আর বলতে হবে না।
: কোন-সব ঢং?
: অই যে সকাল-বিকাল অংক কষার ছুঁতো।
: সেটা আজ নতুন নয়। বরাবর গিয়েছি, আজও যাই।
: বরাবর আর লায়ে ছিলে না। এখন অমন ধাড়ী মেয়ের পরপুরুষের কাছে তারই বাড়িতে রোজ-রোজ অংক কষতে যাওয়া ভালো দেখায় না। তায় আবার নির্জনে তার পড়ার ঘর, অংক কষাতো নামে মাত্র, আসলে প্রেমালাপ!
: তুমি নিজে যেমনি ছিলে, দুনিয়ার সবাই তেমনিই ভাববে। এতে আর আশ্চর্য্য কী?
পিয়ারার কোনো দুর্বলস্থানে যেন আঘাত লাগিল। সে ফুঁপিয়া উঠিল। কহিল-দেখ, খোঁটা দিয়ে কথা বলো না। ভালো হবে না।
আয়েষা কহিল-তুমি যে খালি-খালি আমাকে অপবাদ দিলে, সেটা মুখ বুজে সইব কেমন?
বলে পিয়ারা-খালি-খালি হলো কোনটা, শুনি? তুমি না জানলেও পাড়াময় সবাই জানে তোমার কীর্তি। এই কিছুক্ষণ আগে ও-বাড়ির রহিম বলে গেছে আমার কাছে যে, তুমি অংক কষার ছলে বসে বসে হালিমের সাথে রংগ-রসের কথা কয়ে সময় কাটাচ্ছিলে। বলতে চাও-সে কি মিছে কথা বলেছে? আর, মিছে কথা বলবেই বা কেনো?
আয়েষা বুঝিল যে, রহিম তার পিছনে ফেউয়ের মতোই লেগে আছে। গ্রামময় তাহার অপবাদ প্রচার করিয়া তাহাকে ঘৃণিতা দুশ্চরিত্রা প্রতিপন্ন করিয়া স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির পথ প্রস্তুত করিতেছে। মনের ভাব গোপন রাখিয়া সে কহিল-লম্পটের কথায় কিছু যায়-আসে না। ও-সব লোকের কতায় যারা কান দ্যায়, তারাও বাজে লোক।
পিয়ারা রাগত: কন্ঠে কহিল-দুনিয়ার সবলোক বাজে, আর তুমি একাই খুব সতী-সাধ্বী নাকি?
আয়েষা কঠোর কণ্ঠে কহিল-হ্যাঁ। প্রেমালাপ করি, আর যা-ই করি না কেনো, অভিভাবকদের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন হবে না ইজ্জত রক্ষার জন্যে। বুঝলে?
পিয়ারা ইংগিতটা বুঝিল। ইহা তাহারই দিকে ফিরিয়া আসে। কিন্তু অস্বীকার করিবার সাধ্য নাই। একটু নীরব থাকিবার পর কহিল-তবু যাহোক মান রক্ষা হয়েছে। তোমার কপালে তাও নেই। হালিম শিক্ষিত এবং বড় ঘরের ছেলে। বিএ, এমএ পাসও করবে নিশ্চয়। তুমি শুধু ফাউ তার কাছে-দরে বিকোবে, ঘরে উঠবে গিয়ে, সেটা কল্পনাই করো না। মাঝখানে শুধু একটা কেলেংকারীই ঘটাবে।
আয়েষা ক্রোধকম্পিত কলেবরে কর্কশ ভাষায় কহিল-আমার ভালো-মন্দ আমিই বুঝতে পারি। তোমার মতো কুটনীর মুখে উপদেশ-ভূতের মুখে রামনাম আমি শুনতে চাইনে।… … …বলিয়াই স্থানান্থরে গেল।
পিয়ারা অতিশয় রাগান্বিতা হইয়া আয়েষার উদ্দেশ্যে কহিল-কী, আমি কুটনী, রান্না-বাড়া পাবে আর খাবে, তাছাড়া ইস্কুলে যাওয়া আর অন্য … আপন মনে গজগজ করিত লাগিল।

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *