নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

(পূর্ব প্রকাশের পর)
পাঁচ.
দিন চলিয়া যায়। সে কাহারও জন্য অপেক্ষা করে না। অপেক্ষা করিবার সময় ও ধৈর্য্য স্থৈর্য্য তাহার নাই। তাই কবি বলিয়াছেন-
‘দিন যায় ক্ষণ যায় সময় কাহারও নয়
বেগে ধায়, নাহি রয় স্থির।’
তোমার বিপদ-বাধা যাহাই থাকুক না কেন, তোমার সুখ-শান্তি হইল কিনা, তাহাতে সময়ের কিছু আসিয়া যাইবে না। সেজন্য তাহার গতি শ্লথ হইবে না। মাসুদার সময়ও কাটিতেছে।
প্রকৃতির বুকে গ্রীষ্মের পরে বর্ষা আসে তাহার সুশীতল বারিধারা লইয়া, শীতের পরে বসন্ত আসে বনে-বনে পুষ্পসমারোহ আর পাখির সুমধুর কুজনমুখরিত হইয়া। প্রকৃতির সকল সময়টাই তো এক রূপ যায় না! তাহারও পরিবর্তন আছে। সুখের পরে যদি দুঃখ আসে, তবে দুঃখের পরে সুখও আসিবে। প্রকৃতির নিয়ম এটা। এর ব্যতিক্রম কদাচ হয় না। কিন্তু মাসুদার জীবনে কী ঘটিল?
আজ বৎসর অতীত হইয়া গেল মাসুদার বিবাহ হইয়াছে। এই একটা বৎসর সে স্বামীগৃহে কোনো সুখ-শান্তি পায় নাই। স্বামীর সংগে নিজেকে খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। চেষ্টা করিয়াছে, কিন্তু ফলোদয় হয় নাই। একতরফা প্রচেষ্টা কখনও ফলবতী হয় না। একের চেষ্টায় প্রেম সার্থক হয় না। উভয়েরই মন থাকা চাই। সে স্বামীকে ভালোবাসিয়া, অতীতকে ভুলিয়া চাহিয়াছে। আর, স্বামী, ঔদাসীন্যে, রূঢ় ব্যবহারে, অবহেলার কক্ষাঘাতে তাহার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিয়াছে। ঐক্য না থাকিলে কাহারও সহিত মনের মিলন সম্ভবপর নহে। রূচিগত বৈষ্ণ থাকিলে কেহ কাহারও প্রিয় হইতে পারে না। তথাকথিত কারণেই সফি তাহার প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিতে পারিল না।
ধন-রতœ সকলেরই প্রচুর থাকে না। সবাই স্ত্রীকে টাংগাইল বেনারসী-জর্জেট পরাইতে পারে না, স্বর্ণ-মুক্তা-মণি-মানিক্যের অলংকারে সাজাইতে পারে না। বউকে বাঁদী-দাসী রাখিয়া দিবে, তেতালা-চৌতালায় খাট-পালংকে শোয়াইবে, প্রসাধনের হিমালয় পর্বত তাহার পদতলে গড়িয়া তুলিবে, এমন সাধ্য কয়জন পুরুষের থাকে? থাকে না বলিয়াই কি বউয়ের মন পাওয়া যাইবে না? স্ত্রীর প্রীতি এবং ঐকান্তিকতা লাভের উপায় তবে কী? উপায়-মনের ঐশ্বর্য্য।

বাইরের চাকচিক্য দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সক্ষম। সোনা-দানায় মন ভুলাইতে পারে, তাহাও মানি। কিন্তু মন বাঁধিতে পারে না। যতœ সহকারে শাকান্নভোজন করাইয়াও সকলকেই তৃপ্তি দেওয়া যায়। কিন্তু অযতেœ পলান্ন আহার করাইলেও, মানসিক তৃপ্তি তাহাতে হয় না। মেয়েরা কেবল পুরুষের ধন-রতœ, দৈহিক রূপ এবং অসুর-শক্তির কাছেই পরাভব স্বীকার করিতে বাধ্য নয়। তাহা থাকে তো ভালোই, কিন্তু আরও একটি জিনিস চাই আর সেটাই সবচেয়ে কাম্য। সেটি হইল মধুর ব্যবহার-দরদপূর্ণ আদর-সোহাগ। তাহা না হইলে সকল কিছু ব্যর্থ হইতে বাধ্য। রূপবল, স্বাস্থ্য বল, সম্পদ বল-কিছুতেই স্ত্রীকে পরিতৃপ্ত করিতে পারিবে না, যদি তোমার অই তহবিলটি শূন্য থাকে। তাই বলি-
‘দিবা যেন আলোহীনা অই দুটি কথা বিনা
‘তুমি ভালো আছ কিনা, আমি ভালো আছি।’
একটি মধুর বচন-হাজার টাকার হারের চাইতেও দামী। ইহার দ্বারা যতটা খুশি করা যায় মানুষের মন, ততটা আর কিছুতেই সম্ভবপর নয়।
স্বামীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি স্ত্রীর লক্ষ্য রাখিতে হইবে। তাহাকে খুশি রাখিবার জন্য সদা-সচেষ্ট থাকিতে হইবে। কাজে, কথায় ব্যবহারে তাহাকে আঘাত দিবে না। তাহার রূচির সহিত নিজের রূচির ঐক্য সংরক্ষণের দিকে খেয়াল রাখিবে। বুঝিলাম। উহাতো পুরুষের তরফের কথা। উহা শুধু মেয়েদের করণীয় নয়-পুরুষদেরও। পক্ষান্তরে তাহাদেরও উহা অনুসরণ করিয়া চলা কর্তব্য। একজন কেবল সকল দূরত্ব ঘুচাইয়া অপরের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করিতে চেষ্টা করিবে, আর অপরজন ক্রমে বাঁকাইয়া দূরত্ব বজায় রাখিয়া চলিতে থাকিলে কেমন করিয়া অন্তর-রাজ্যে অধিপত্য বিস্তার করা যায়? তাহা সম্ভব নহে। উভয়েরই প্রতি সহানুভূতিশীল হইয়া, একে অপরকে সুখ-শান্তি-স্বাচ্ছন্দ্য দেবার জন্য সচেষ্ট থাকা একান্তই উচিৎ। তাহা হইলে দাম্পত্য প্রণয় গড়িয়া উঠিবে। সুখ পাইবে, শান্তি আসিবে। সংসারে কলহ-কোন্দল সৃষ্টি হইবে না। আর, তখনই সংসার চির-সুখময় নন্দন কাননে পরিণত হইবে।
কিন্তু আমাদের সমাজে এমনি ভ্রান্ত ধারণা বদ্ধমূল হইয়া আছে যে, নারীকেই কেবল পুরুষের মন যোগাইয়া চলিতে হইবে। তাহাকে খুশি করিবার, আনন্দ দিবার জন্য প্রাণপাত করিতে হইবে। পুরুষের যেন কোনো কর্তব্য নাই নারীর প্রতি। এই ভ্রান্তির জন্যই সংসারে প্রায়শ: নারী পরিপূর্ণ সুখের অধিকারিণী হইতে পারে না। পুরুষের ধারণা-বিবাহ করিলেই যে কোনো রমণী তাহার একান্ত আপনার হইয়া গেল। সে তাহার সমগ্র দেহ-মনের অধিকারী হইয়া গেল। রমণীরও কর্তব্য শুধু তাহাকে তুষ্ট করা। সত্যি কি তাই? না তাহা নহে। বিবাহের বাঁধনে বাঁধিয়াই কাহাকেও আপনার করা যায় না। অধিকার বিস্তার সম্ভব হয় না। দেহের উপর আধিপত্য খাটানো হয়ত সহজ হয়। কিন্তু মনের উপর জোর খাটে না। মন জয় করা অতো কি সহজ? বল প্রয়োগও সেখানে অচল। কেননা, মনটা ধরা-ছোঁয়ার বাইরের বস্তু। শক্তি প্রয়োগে শুধু দেহটাই হাতে আসে। মনটা থাকিয়া যায় কোথায় কোন রূপকথার অচিনপুরীতে যে, শতচেষ্টায়ও তাহার নাগাল পাওয়া যায় না।
‘শুধু মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভিজে না’ কথাটা লোকে প্রায়শ: বলিয়া থাকে। কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে, মনরূপ চিড়া যদি ভিজাইবার আবশ্যক হয়, তবে অই মিষ্টি কথারই আবশ্যক। উহা ব্যতীত ভিজাইতে পারিবে না। কিন্তু আন্তরিকতা থাকা চাই, সারল্য থাকা চাই। মিষ্টি কথা যেন শুধু বাক্য বা প্রতারণামূলক না হয়। যদি আন্তরিকতাপূর্ণ মিষ্টি কথা প্রয়োগ কর, তবে মন, যতোই কঠিন হউক না কেন, ভিজিবে, তরল হইবে। কেননা-
মিষ্টি কথায় সৃষ্টি টলে-
টল্বেনা মন ভেবো নাকো,
মিষ্টি তোমার খাঁটি কিনা
সেদিক শুধু লক্ষ্য রেখো।
মিষ্টি কথা মাসুদা কখনো পায় নাই। এই একটা বৎসর গেল, স্বামী-গৃহে সে একদিনের তরেও সুখ লাভ করে নাই। স্বামীর আদর-সোহাগ পাইল না। সে যেন উহা বুঝেই না। কর্কশ কণ্ঠ, ইতর ব্যবহার লাগিয়াই আছে। শাশুড়ি-ননদ আর যাহারা আছে, তাহারাও কথায়-কথায় গঞ্জনা দ্যায়। তাহার চাল-চলন, কথা-বার্তা, কাজ-কর্ম, খাওয়া-শোয়া ইত্যাকারে কিছুই তাহাদের পছন্দনীয় নয়। সে যেন ইহাদের সংসারের শনি-মহা ব্যতিক্রম। তাই পদে-পদে কথা শুনিতে হয়, গালাগালি হজম করিতে হয়। কথায় বলে-‘ভাতজ্বালা সয়তো দাঁতজ্বালা সয় না।’ মাসুদারও ক্রমে অসহ্য হইয়া পড়িল। প্রথম প্রথম মুখ বুঝিয়া সহিয়াছে। তারপর সফির কাছে জানাইয়াছে, প্রতিকার আশা করিয়াছে। কিন্তু ফল ফলিয়াছে উল্টা। সফি বলিয়াছে-দোষ না থাকিলে কেউ কাউকে গাল দিতে পারে না। প্রতিকারের আশা নাই। তাই সে নিজেই দু-এক কথার প্রতিবাদ দিতে শুরু করিল। ফলে শাশুড়ি-ননদ আরও খড়গহস্ত, আরো নির্মম হইয়া উঠিল তাহার উপর।
কাজীর গাঁয়ের একদিন। নানা কারণে মাসুদার শরীর মন ভালো ছিলো না। দ্বিপ্রহরের আহারান্তে সফি জমির কাজে গেল। এই অবসরে সে অবসন্ন দেহ-মন লইয়া শয্যার আশ্রয় নিল। সহসা বজ্রপাতের মতো ভীষণ শব্দে তাহার ঘুম টটিয়া গেল। ধড়মড় করিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিল। দেখিল, দোর গোড়ায় রক্তচক্ষে দাঁড়াইয়া আছেন তাহার শ্বাশুড়ি যেন দশ প্রহরণ ধারিণী অসুর নাশিনী মূর্তি। ময়নাবিবি ঝংকার দিয়া চ্যাঁচাইয়া আকাশ ফাটাইয়া বলিলেন-বলি হ্যাগা বউ, তোমার আক্কেল হান কী? এহনও ঘুমাইয়া আছ, সোম্সারে কি কাজ-কাম নাই? আমি বুড়া মানুষ তমু এট্টু ঘুমাইতে পারি না। তোমাগো এই যুয়ানকী বয়সে দিনে ঘুমান লাগে কিতে?
মাসুদা ধীর কণ্ঠে বলিল-আজ শরীরটা খারাপ লাগছিল। তাই একটু ঘুমাচ্ছিলাম। বেলা তো ঢের আছে। ক্ষতি কী হলো তাতে?
ময়না বিবি রাগিয়াই কহিলেন-তোমাগো লেহাপড়া জানা মাইয়াগো অই হুনি ক্যাবল শরীর খারাপ। অমন ধুমরসী মাগীর আবার শরীর খারাপ অয় কিতে? আমাগোও অমন বয়স একদিন ছেলো। কই, শরীল খারাপতো কেনো সময় অয় নাই? গায় যার অতো গোস্ত-তিন শকুনেও খাইয়া ছাড়াইতে পারে না, হ্যার আবার অসুখ! আসলে গইররাগরুর স্বভাবই অই রহম।
মাসুদা ধীর-স্থির ভাবেই কহিল-মিছামিছি কি কেউ ভান করে? খামাখা যা-তা বলছেন কেনো?
ময়না বিবি ঝগড়াটে মেয়েলোক। তদুপরি তাঁহার মেজাজও খুব কড়া। শুনা যায়, এক সময়ে তিনি স্বামী, শ্বাশুড়িকে এই রূপ ভাজিয়া খাইয়াছেন। ছাড়িবার পাত্রী তিনি নন। এক কথা কহিলে দশ কথা শুনাইয়া দিতে দক্ষতা তাঁহার আছে, হন না তিনি লেখাপড়া না জানা সেকেলে মেয়ে। তাহাতে কী? বউয়ের উত্তর শুনিয়া তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন অথবা যেন ভাজা তেলে ফোড়ন পরিয়াছে। স্বরগ্রাম খুব উচ্চে তুলিয়া এবার তিনি কহিলেন-মা-তাড়া কইলাম কী, হুনি? চউক্কে আংগুল দিতে চাও এহনি? কাজ-কাম পইর‌্যা রইছে, তুমি এদিগ্ নবাবজাদির নাহান ঘুমাইয়া আছ। আমি জাগাইয়া দেলাম, হ্যাতে কও যা-তা কইছি? ছোবাহান-আল্লা। চউক্কের উপর মিত্যা কতা? তয় পাছে বইয়া পোলাড্ডে কদ্দুর লাগাইতে পার, এহন সে বুঝলাম।
মাসুদা এবার বিরক্ত হইল। তাহার শাশুড়ি এ কী বলিতেছেন? গাল-মন্দও দিতেছেন আবার নিজে নিজেই সাফাই গাহিতেছেন। এর কথায় উত্তর দিবারও যে উপায় নাই। এর যে দুদিকেই ধার-যেতেও কাটে, আসতেও কাটে। রাগ হইল, কিন্তু কড়া কথা বলিতে সাহস হইল না। কেননা, কড়া কথা না বলাতেই তিনি দোষারোপ করিতেছেন। সে এবারও ধীরভাবে কহিল-চিল্লাচিল্লি করেন কেনো? যাই, এখনই কাজ করবো গিয়ে। কী কী কাজ করবো বলুন?
ময়না বিবি মুখ ভ্যাংচাইয়া কহিলেন-ওহ! কতো এট্টা কাজের লোক অইয়া পড়ছে আইজকাইল। কী কী করোন লাগবে হেডাও কইয়া দেওন লাগবে? চউক্কে দ্যাহোনা? চউক্কের মাথা খাইছ? কতায় দেহি কতো চক, হ্যারে কইয়া কাম করাইতে অইবে ক্যা? এছনো পাউটার, সাবান ঘসোন দেহি কতন লাগে না। হেডা দেহি মানা কইর‌্যাও ফিরান যায় না। এতো কই-এছনো-পাউটার, বাসের ত্যাল, গন্ধ-আলা সাবান বিডিগো মাহোন ভালো না। ওতে কাল্-নিশায় পায়। তমুনি হুনাইতে পাল্লাম? অতো ফস্টি-ফুডানী লাগে কিতে? মোরা সোয়ামীর ঘর করি নাই? আমাগোতো ও-সব লাগলে না! এইসব কইর‌্যা পোলাডারে ভুলাইতে চাও, ক্যামন? আমার প্যাডে অইছে-হেডা অতো সোজা না।… … … হাত দুলাইয়া, মুখ নাড়িয়া এমনি বচন বর্ঘন করিয়া যাইতে লাগিলেন অবিশ্রান্ত ধারায়। মাসুদা মরীয়া হইয়া তাঁহাকে কহিল-আপনার পায়ে পড়ি? এবার থামুন। শুধু-শুধু অতো কতা কেনো বলছেন? বললাম তো, আমি এখনই কাজে যাবো।
ময়না বিবি থামিলেন। যেন উৎসাহিত হইলেন। আবার পুরাদমে শুরু করিলেন-হুদাহুদি কেউরে কেউ কিছু কইতে পারে? আমি পাগল অইছি নাহি যে, তোমারে হুদাহুদি কতা হুনামু? তোমার কাজ-কাম কোনডা ভালো? চলন-ফেরন ঝি-বউর নাহান অয়? লাজ-শরমনি আছে? কতায় কয়-দুধ দেউন্যা গাইর লাতীডাও ভালো। কাম-কাইজেও যদি খেয়াল থাকতে হেরহম, তয় হেসব কইতাম না। আমি যদি না খাইতাম, সোম্সার এদ্দিন ভাডীতে যাইতে!
শাশুড়ির অহেকুক গাল-মন্দ শুনিয়া মাসুদা মনে-মনে বিরক্ত এবং অসন্তুষ্ট হইল। কিন্তু তাহাকে থামাইবার উপায় কী? প্রশংসাসূচক কিছু বলিলে যদি বুড়ির রাগ পড়ে এবং কতা বন্ধ হয়, ক্ষতি কী? এইরূপ ভাবিয়া সে স্মিতকণ্ঠে বলিল-তা’ ঠিকই বলেছেন, আম্মা। বুড়ো মানুষ সংসারে আছে, তাই সংসার ঠিকঠাক মতো চলছে। আপনারা আগের যামানার লোক, কাজ-কামের দিকে আপনাদের কতো নজর। কাজও আপনারা এখনও আমাদের চাইতে বেশি করতে পারেন, মানি। তাইতো আমাদের ভাবনা-চিন্তা কম।
ময়নাবিবি ইহাতেও রাগিয়া গেলেন। আত্মপ্রশংসা শুনিয়াও তাহার মন নরম হইল না। বলিতে লাগিলেন রাগত কণ্ঠে-বান্দি-দাসি পাইয়া লইয়া নাকি যে, এহনও খাড়াইয়া লইতে চাও? ঠ্যাংগের উপর ট্যাং থুইয়া খাবা? হের লইগ্যা পোলা বিয়া দি’নাই। রূপ ধুইয়া পানি খাওনের দরকারও নাই। অমন রূপের কপালে পিছামারি। আউক আজ সফি বাড়িতে। জিগামু যে এহনও কি আমার বউর বান্দীগিরি খাডোন লাগবে? পন্ডিতের ঝি পন্ডিত বইয়া-বইয়া গতর পালবে, আর মুই খাই্ড্যা মরমু? হেডা ফোড়বে না।
মাসুদা বুঝিল, শাশুড়িকে কোনো কথাতেই তুষ্ট করা যাইবে না। যাহা বলিবে, তাহাতেই চটিবে এবং বকবক করিতে থাকিবে। অগত্যা, মৌনতা শ্রেয়: ভাবিয়া নীরবে কার্য্যান্তরে চলিয়া গেল। শাশুড়ি বুড়ি আরো কিছুক্ষণ একা-একা বক্বক্ করিয়া প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে ক্ষুণœ-ক্রুব্ধ মনে স্থানান্তরে যাইতে বাধ্য হইলেন।
সন্ধ্যায় সফি গৃহে ফিরিল। রাত্রে সে খাইতে বসিয়াছে। ময়না বিবি পরিবেশন করিতেছিলেন। প্রসংগত প্রকাশ থাকে যে, রান্নার কার্য মাসুদা করিলেও, স্বামীকে পরিবেশন করিয়া আহার করাইবার উপায় তাহার নাই। পাশে বসিয়া বউ স্বামীকে খাওয়াইবে, ইহা দৃষ্টিকটু বেহায়াপনা। ময়না বিবি তাহা আদৌ পছন্দ করেন না। তাই রান্না শেষ হইলেই সে খালাস। দেওয়া-থোওয়া করিবার অধিকার তাহার নাই। সফিও তাহা কামনা করে না। স্বামীকে স্বহস্তে পরিবেশন করিয়া আহার করাইবার মধ্যে যে কী সুখ এবং ভোক্তার কী যে তৃপ্তি; তাহা উহারা বুঝিবে কী?
সফি আহার করিতেছিল। ময়না বিবি ইনাইয়া-বিনাইয়া নানা কথা কহিয়া ছেলের কান ভারী করিতে প্রয়াস পাইতে ছিলেন। তিনি একসময় কহিলেন-না বাপু, আমি অতো খাইড্যা মরতে পারমুনা এহনও। দিন নাই, রাইত নাই, বউ যে কেবল ঘুমাইয়া কাডাইবে, আর মুই যে সোম্সার ঠিক রাথমু, হেডা পারমু না। হ্যার, বিহিত কি কিচ্ছু করবি না?
সফি রাগত: স্বরে কহিল-ক্যা ঘুমাইয়া থাকে? কাজ-কাম কিচ্ছু কি নাই। এটা তার বাপের বাড়ি না যে, কেনা চাউলের ভাত খাবে আর গায় বাতাস লাগাবে। এটা গিরাস্তের সংসার। বাবু গিরি এখানে চলবে না।
ময়না বিবি কহিলেন-বাবুগিরির আর দেখনি কী। বাড়িতে কত্কুন থাহো যে দেখবি?: হ্যার এসনো-পাউডার-সাবান মাহোন দ্যাখলে গা জ্বইল্যা যায়। গিরাস্ত ঘরের ঝি-বউর অতো ফুডানী লাগে কিতে হেইডা বুঝি না।
সফি কহিল-বাপের বাড়িতে থাইক্যা অইসব নাগরামী কইর‌্যা মান্ষের মন মজাইয়া আইছে তো, স্বভাব ছাড়তে পারে না। মানা কইর‌্যা দিয়ো। আমার বাড়িতে ওসব লাগবে না।
ময়না বিবি কপালে করাঘাত করিয়া কহিল-অ আমার পোড়া কপাল! আমি করমু মানা? আমার কতা হে শুনে নাহি? এক কথা কইলে তিন কাত হুনাইয়া দ্যায়। দুফাইর‌্যাকালে আইজ ঘুম ছেলে আর বেউল শ্যাষ তমুজাগোনের নাম নাই। আমি জাগাইয়া দেলাম। হ্যাতে আমারে কতো কতা হুনাইয়া দেলে। আমি আবার যামু হ্যারে মানা করতে?
সফি রাগিয়া কহিল-কী, তোমার লগে আবার মুখ বাজায়? আচ্ছা দ্যাখা যাবে। হারামজাদীর মুখ আইজ ছ্যাচা কইর‌্যা দিমু।
(চার)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *