নোনাজল অথবা কষ্টের নদী

(পূর্বে প্রকাশের পর)
(চলবেবাহির হইতে কালি ছিটাইলে অন্তরে তাহার দাগ লাগে না সত্য, কিন্তু বাহিরের রূপটা কিন্তু তকিমাকার-দৃষ্টি কটু হইয়া যায়, তাহাতে বাধা কী? হইলও তাহাই। আয়েষা ভালো মেয়ে কিন্তু লোকে বলে সে নষ্টা। আমরা সার্টিফাই করিলে তাহাতে তাহার কী উপকার হইবে। গাঁয়ে দশজনে তাহাকে খারাপ জানে, অতএব, সে খারাপই। আর, সত্যিকারের খারাপকে যদি সকলে ভালো বলিয়া মনে করে, তবে সে ভালোই। আমরা শত কহিয়াও তাহাকে খারাপ প্রতিপন্ন করিতে পারিব না। গাঁয়ের সমাজ যাহার উপর ঈর্ষা পরায়ণ হইবে, যে আক্রোশ কবলে পতিত হইবে, তাহার খারাপ বলিয়া প্রতিপন্ন হওয়া ব্যতীত গত্যন্তর নাই। এ যেন হাসপাতালের মুমূর্ষুরোগীর শিয়রে ডেডসার্টিফিকেট টাংগানোর মতো!
যাহা হউক আয়েষা নবম শ্রেণি উত্তীর্ণ হইয়া দশম শ্রেণিতে উঠিল। পাড়ার লোকদের আক্রোশ বাড়িয়া গেল। রহিমের দলতো তাহার পিছনে লাগিয়াই আছে। একদিন বিকালবেলা মজিদের বাপ এবং রহিমের বাপ করিম মিয়া আয়েষাদের বাড়িতে আসিলেন। আয়েষার ভাই নূরুজ্জামান তখন বাড়িতেই ছিলো। প্রথমে করিম মিয়া নূরুকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন-বাবা নূরু, তোমরাতো শুইন্যাও শোন না, এদিকে তোমার বুইনের নামে গেরামে নানান কেলেংকারীর কতা অইতে আছে। মোরা কইতে আইনা যে, ভাববা মোরাই বদনাম কইছি। আসলে তোমার বাপকে বড় গলায় ভাই কইয়া ডাক দিছি বইল্যাই এটটু গায়বাজে, তাই কইতে আইলাম আইজ।
নূরু এই গাঁয়ের ছেলে। প্রতিবেশীরা কে কোন প্রকৃতির লোক, কে হিতাকাংখী, কে বদনাম রটায়, সেসব তাহার বুঝিতে বাকী নাই। এই করিম মিয়াই এবং তাঁহার স্ত্রী এবং ছেলে রহিম পাড়াময় আয়েষার কুৎসা ছড়াইয়াছে, তাহা কিছু-কিছু সে অবগত আছে। তবু মুখের উপর হক কথা বলিবার উপায় নাই। কেননা, তাহাতে কলহের সৃষ্টি হইবে এবং দুর্নাম আরও ছড়াইবে। তাই সহজভাবে কহিল-কী করব চাচা, বলুন? খামাখা লোক অপবাদ দিলে তার কী করতে পারি আমরা?
এবার মজিদের বাপ কথা কহিলেন। বলিলেন-কই কি বাছা, চাষা গেরাস্তের মাইয়া, ডাংগর কম অয়নাই, এহন পড়াইয়া কাম নাই। মানে-মানে বিয়াডা দিয়া ফ্যালাও।

নূরু কহিল-বিবাহ যে দেব, উপযুক্ত ছেলেও তো পাওয়া দরকার। ছেলেও পাইনা আর আয়েষারও পড়বার খুব ইচ্ছা, মাথাও আছে। ভাবলাম, নিজের কপালতো নিজেই পুড়িয়া খেলাম, এখন ওকে যদি একটু লেখাপড়া শেখাতে পারি, ক্ষতি কী?
করিম মিয়া কহিলেন-তোমার বাপ বাঁইচ্যা থাকলে আমাগো কওন লাগতো না। এদ্দিন বিয়া-সাদী অইয়া যাইত। তুমি পোলাপন মানুষ, বোঝো না কিছু। সমাজে মানডাই আগে। মান না থাকলে, তোমার বুইন মেট্রিক-আইএ পাস করলেই বা কী অইবে? কেলেংকারী কম অয় নাই। সবটা ট্যারও পাওনা।
মজিদের বাপ কহিলেন-হুনি বোলে হালিম ছোড়ার লগে তোমার বুইনের খুব মাহা-মাহিভাব। হে যে কয়দিন বাড়িতে থাকে। তোমার বুইনে নাহি হের বাড়ি কে হয় দিন পইর‌্যাই থাহে।
নূরুর এইসব কথা প্রীতিবাদ হইল না। সে রোষিয়া কহিল-এসব খবর আপনারা পান কোথা? সব বাজে কথা। আয়েষা মাঝে-মাঝে হালিমের কাছে পড়াশুনা নিয়ে যায় সত্যি। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? কারো কাছে গেলেই দোষ? হালিমের স্বভাব-চরিত্র কতো ভালো, তা আপনারা জানেন না?
করিম মিয়া মোলায়েম কণ্ঠে কহিলেন-আহা, রাগ করো ক্যান? আমি তো আগেই কইলাম যে, এই ভয়তেই মোরা এদ্দিন কইতে সাহস পাই নাই। নইলে অনেক কতাই হুনি। সব যদি কই, তবে ভাইংগা যায় দই। ধরলাম, তোমার বুইনও ভালো আর হালিমের মনেও কোনো দোষ নাই, কিন্তু মানষের মুখ চাইপ্যা রাখবা ক্যামনে?
এবার মজিদের বাপ কহিলেন-আর, এহন মোরা বুড়ার মইদ্দে গন্য অইছি কিন্তু যুয়ানও তো একদিন ছিলোম-বুঝতে পারি যে, আগুন আর বাতাস কতোক্ষণ এক জায়গায় চুপচাপ থাকতে পারে? হ্যার উপর শাস্তরে কয়-‘মানুষের মন আর আন্ধার রাই সমান।’ কার মনে কি আছে, হেডা তুমি আমি কী জানি?
নূরু কোনো কথা কহিল না। করিম মিয়া পুন: বলিতে লাগিলেন-ধরো, যদি একটা কেলেংকারী ঘইড্যাই যায়, তহন? হালিম শিক্ষিত ভদ্রঘরের ছেইলা, তারপর বিএ পড়ে। তোমার বইনেরে হে বিয়া করতে রাজি অইবে না। আর, অইলেও হের বাপ-ভাইর রাজি থাকবে না।
নূরু বুঝিল, করিম মিয়া এবার যা বলিয়াছেন, তা মিথ্যা নয়। কিন্তু সেটা তো সমস্যা নয়। বিবাহের চিন্তা পরে। সমূহ এইসব কুকথার কণ্ঠরোধ করা যায় কিভাবে? তাই হইয়াছে মস্ত বড় সমস্যা। সত্যই নূরু একটু দমিয়া গেল। অপমানকর কথা, বংশের ইজ্জৎহানীজনক ইংগিত, পথে-ঘাটে চোখ-ঠারিয়া-ঠোঠ বাঁকাইয়া তাকান, কে সইতে পারে, কাহার কাছে ইহা প্রীতিকর? কিন্তু সমাধান কিসে হয়, ভাবিয়া পাইল না। অবস্থা বুঝিয়া করিম মিয়া যেন জুৎ পাইলেন। পুন: কহিলেন-শোনো নূরু, তোমার মায়ের লগেও আলাপ কইরে‌্যা। সমাজে মাথা উঁচাইয়া থাকনডা ভালো, না বুইন ল্যাহাইয়া মাথা নীচু, মুখ-চুন করনডা ভালো-চিন্তা কইরে‌্যা এটটু। মাইয়ালোক লইয়া যায় পরে, টাহা খরচ কইর‌্যা হের জন্য মানষের কুকথা হোনলে লাভডা কী? তাই কই, ল্যাহানে আর কাম নাই। এহন বিয়ার যোগাড় করো।
নূরু মজিদের বাপ এবং করিম মিয়াকে লক্ষ্য করিয়া বলিল-আমার বোন, আমিতো আর তার জন্য ছেলের খোঁজে বের হতে পারি না। আপনারা যোগ্য মতো ছেলে যোগাড় করে দিন। বিয়েটা দিয়ে ফেলি-সকল ল্যাঠা চুকে যাক। পাড়ার মানুষের চোখের জ্বালা, মনের জ্বালার নিবারণ হোক।… … … বিরক্তিপূর্ণ উক্তি।
যথাসময়ে মজিদের বাপ এবং করিম মিয়া গৃহে ফিরিলেন। অত:পর নূরু এ সম্পর্কে তাহার মায়ের সহিত আলাপ করিল। তাহার মা আদৌ ছিলেন না। তিনি বলিলেন যে, বিবাহের ব্যবস্থা করাই ভালো। পড়াশুনার নামে বদনাম কুড়াইয়া কী লাভ হইবে? আর, পিয়ারাতো তাহাই চায়। সে বরাবর ইর্ষা পরায়ণা। ননদ লেখাপড়ার নামে বসিয়া-বসিয়া সংসারের অন্ন ধ্বংস করিবে, তাহাতে ভবিষ্যতে তাহারই লোকসান। কাজেই যতশীঘ্র আপদ দূর করা যায়, ততই মংগল। সেও নূরুকে নানান কথা কহিয়া বুঝাইল। মা এবং স্ত্রীর মনোভাব বুঝিয়া সে স্থির করিল যে, আয়েষার বিবাহের চেষ্টাই করিতে হইবে।
এদিকে আয়েষা প্রমাদ গণিল। ভাইয়ের অনুকূল্যে তাহার এতো সাধের লেখাপড়া চলিতেছিল এ যাবৎ। এবার বুজি উল্টা হাওয়া বহিল। এখন উপায়? মাও যখন বিরূপ তখন আর কাহার কাছে আব্দার জানাইবে? গাঁয়ের পরশ্রীকাতর কুচক্রীদের চক্রান্তে এবার তাহার পড়াশুনা বন্ধ হইবে ভাবিয়া সে অতিশয় মর্মাহতা হইয়া পড়িল।
আয়েষার বিবাহের চেষ্টা চলিতে লাগিল। যোগ্য পাত্র আসে, আসিয়া তাহাকে দেখিয়া যায়। কিন্তু শেষটায় সম্বন্ধ ভাংগিয়া যায়। এইভাবে প্রায় পাঁচ-ছয় মাস ধরিয়া কত সম্বন্ধ আসিল-গেল কিন্তু টোপ গিলিলনা কেউই। এমন সময়ে রহিমের জন্য প্রস্তাব আসিল-মজিদের বাপই নূরুকে জানাইল। প্রস্তাব শুনিয়া নূরু মনে-মনে অতিশয় বিরক্ত হইল। কী আস্পর্দা তাঁহার? করিম মিয়ার ছেলে রহিম এই তিন-চার বৎসর যাবৎ নবশ্রেণিতে জাবর কাটিয়া, এবার অতি ধর-পাকড়ে দশম শ্রেণিতে প্রমোশন পাইয়াছে কিন্তু পাশ করিবার আশা নাই। এই হইল একদিক, অন্যদিক সে উচ্ছৃংখল, অসচ্চরিত্র। তারও উপর সে আয়েষার কাছে রূপে, গুণে, স্বাস্থ্যে সব দিক দিয়াই বেমানান। এ-হেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রস্তাব কী করিয়া দিতে পারিল? লজ্জাও হইল না? বলাবাহুল্য, এই উদ্দেশ্য সফল করিবার জন্যই তাহারা কান-ভাংগানী কোনো উপযুক্ত পাত্রকে এখানে সম্বন্ধ করিতে দিতেছেনা। এটা নূরুর বুঝিতে কষ্ট হইল না।
শত চেষ্টা করিয়াও আয়েষার সুপাত্র জুটিল না আর প্রতিবেশীগণের বদৌলতে সমাজে মুখ দেখানও যায় না। করিম মিয়ার তরফ হইতে ঘন-ঘন তাগাদা আসিতে লাগিল। যদিও অসম্ভব, তবু নূরু লোক মারফৎ হালিমের অভিভাবকের মতামত জানিয়া লইল। তাহাতে জানিল যে-বিএ পরীক্ষা হইয়া গেলে পর বিবাহ সম্পর্কে চিন্তা করা যাইবে, এখন তাহাকে বিবাহ দিবার ইচ্ছা নাই। মেয়ের পক্ষ বেশি সাধাসাধি করিতে গেলে ভালো দেখায় না। লজ্জার কথা, সমাজে সেরূপ রেওয়াজ নাই। তবুও লজ্জা ফেলিয়া নূরু সে চেষ্টাও দেখিল। মোটের উপর বুঝিল যে, আয়েষার বিবাহ হালিমের সহিত হওয়া তাহার অভিভাবকের মনঃপুত নয়। এদিকে মান-ইজ্জৎ বাঁচান দায়। করিম মিয়ার দল উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়া আছে। অনন্যোপায় হইয়া অগত্যা সে করিম মিয়ার প্রস্তাবে রাজী হইল। করিম মিয়ার ছেলে রহিমের সহিত আয়েষার বিবাহ। দিনক্ষণও ধার্য্য হইয়া গেল। কিন্তু … … গোল বাঁধিয়া গেল এই যে, বিবাহের দিন কনেকে খুঁজিয়া পাওয়া গেল না কোথায়?

এগারো.
মাসুদাকে খোঁজে পাওয়া যাইতেছে না-এই পর্যন্ত আমরা জানি। কোথায় গেল সে, কী হইল তাহার, এখন তাহা শুনিবার অবকাশ হইল। সেই রাতে মাসুদা মরিয়মের মায়ের সহায়তায় গোপনে পিত্রালয়ে আসিয়া ছিলো। দীর্ঘ আড়াই বৎসর ধরিয়া স্বামীর এবং শাশুড়ি-ননদের লাঞ্চনা-গঞ্জনা সে নীরবে সহ্য করিয়া ছিলো। সহ্যেরও সীমা আছে। যখন সীমা অতিক্রম করিল, তখনই সে আগু-পিছু না ভাবিয়া এই পলায়ন-প্রবৃত্তির বশবর্তী হইতে বাধ্য হইয়াছিল। এ-জন্য তাহাকে অপরাধ দেওয়া যায় কি?
স্বামী-সোহাগের অজস্র দাগ অংগে দারণ করিয়া মাসুদা বাপের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল সেদিন। রফিজ মিয়া তখন বাড়িতে ছিলেন না। জোহরা খাতুন আশ্চর্য্য হইয়াছিলেন এবং এইভাবে আসার জন্য তাহাকে খুব তীরস্কার করিয়া ছিলেন। পরে যখন সকল সংবাদ জানিতে পারিলেন এবং প্রহারের দাগগুলি দেখিলেন, তখন তিনি রাগে দুঃখে-ক্ষোভে হাউ-মাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়াছিলেন।
যথাসময়ে সফি এখানে লোক পাঠাইয়া মাসুদার খোঁজ লইয়াছিল। নিজে আসিতে সাহস পায় নাই। … … এই ঘটনা কিছুদিন পরে রফিজ মিয়া বাড়ি আসিয়া ছিলেন তাঁহার কর্মস্থল হইতে। তিনি জামাইকে সংবাদ দিয়া আনাইয়া ছিলেন এবং মেয়েকে বুঝাইয়া শুনাইয়া জামাইয়ের সহিত পাঠাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়া ছিলেন। কিন্তু কিছুতে কিছু হইল না। মেয়ে ভীষ্মপণ করিয়া বসিল-সফির বাড়িতে আর যাইবে না। মেয়ের মা এবং ভাইয়েরাও বাঁকিয়া বসিল। অগত্যা সফিকে খালি হাতে ফিরিতে হইয়াছিল। যাবা রসময়ে জামাইকে তিনি বলিয়া দিয়াছিলেন যে, যাউক আর কিছুদিন। রাগ পড়িলে যখন যাইতে রাজী হইবে তখন পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে। আপতত: এখানে থাকুক কিছুদিন।
মাসুদা পিত্রালয়ে রহিয়া গেল। আয়েষা রোজই একবার করিয়া তাহার কাছে আসিত। দুইজনে নানান সুখ-দুঃখের কথা হইত। রগড়-তামাসাও করিত পূর্ববৎ। কিন্তু মাসুদার দুর্দশা আয়েষাকে বড়োই পীড়া দিত। কখনও সে ওকে বলিত-তোর কপালেও এতো দুঃখ লিখেছিল! হায়, বিয়ের যে কী সুখ, ভালোবাসায় কী যে আনন্দ একটা দিনও তা পেলিনে? জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় সার্থকতা কোথায়?
মাসুদা জোর করিয়া অধর প্রান্তে হাসি ফুটাইয়া বলিত-আমি অসুখী কে বল্লে তোকে?
‘ছিনু মোরা সুলোচনে, গোদাবরী তীরে
কপোত-কপোতী যথা; উচ্চবৃক্ষ চূড়ে
বাঁধে নীড়, রহে সুখে।… … …’

আয়েষাও কৌতুক করিতে ছাড়িত না। বলিত-হ্যাঁ, সুখের দাগগুলো বোধহয় এখনও পিঠে রয়ে গেছে, মিলিয়ে যায়নি।
এক প্রকার দিন কাটিতে ছিল মন্দময়। আয়েষার মধুর সাহচর্য্যে মাসুদা অনেকটা দুঃখ-ব্যথা উপেক্ষা করিয়া যাইতে পারিতে ছিলো। কিন্তু আজ এ কী কথা শুনিতে হইল? আয়েষাকে পাওয়া যাইতেছেনা?
কোথায় গেল সে? কোথায় যাইবার স্থান আছে? তবে কি মরিল? মরিল কীভাবে? গলায় দড়ি দিয়া গাছে ঝুলিয়া? তবে তো তাহার মৃত দেহ পাওয়া যাইত। তবে? তবে কি নদীতে ডুবিয়া মরিল? যাক, ভালোই হইল। মরিয়া বাঁচিয়াছে। যাকে চায় না, যাকে ঘৃণা করে মনে-প্রাণে, জীবনে যাকে ভালোবাসা যাইবে না, সেই অবাঞ্চিত পুরুষের ঘর-করা হইতে সে রেহাই পাইয়াছে। খুব বাঁচিয়াছে। নতুবা তাহারই মতো সেও তিলে-তিলে জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিত জীবন-ভর। তাহার চাইতে এই একবারে মরা-ই ভালো।… … এমনিতরো অনেক ভাবিল, মনকে বুঝাইল কিন্তু মাসুদার অবাধ্য চোখ বারণ মানিল না। বাল্য-বান্ধবীর অন্তর্ধানের শোকে চোখের পাতা তাহার অশ্র“সিক্ত হইল।
তারপর একে-একে দেড়টি বৎসর অতীত হইয়া গেল। রফিজ মিয়া মাসুদাকে স্বামীগৃহে পাঠাইতে অনেক চেষ্টা করিয়াছেন। অনেক বুঝাইয়াছেন। কিন্তু রাজী করিতে পারেন নাই। সে অই কথা শুনিতেই পারে না। সে মরিতে কবুল। তবু কাজীর গাঁয়ে যাইতে রাজী নয়। সংসারের আর সবাইও অমত প্রদর্শন করিতেছে। পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনেরাও বলিতেছেন, জোর করিয়া মেয়েকে স্বামীর বাড়ি পাঠান উচিৎ নয়। যদি আত্মহত্যা করে সে? অতএব, যাহাতে ছাড়াছাড়ি হয়, তাহার চেষ্টা দেখাই সমীচীন। অগত্যা রফিজ মিয়া ইহাই সাব্যস্ত করিলেন। সফিকে বলা হইল যে, যখন মাসুদার সাথে তাহার বনিবনা হইতেছে না, তখন তাহাকে নিয়া জোর-জবরদস্তী করিয়া লাভ নাই। তাহাতে সেও সুখী হইতে পারিবে না। কাজেই জঞ্জাল না রাখাই উত্তম। সে যদি স্বেচ্ছায় তালাকনামা লিখিয়া দ্যায়, তবেই ভালো হয়।
কিন্তু তাহাও নির্বিবাদে সম্ভবপর হইতেছিল না। ইহাতেও কুচক্রীরা লাগিয়া রহিল। মানুষের ক্ষতিই মানুষে করিতে পারিলে ছাড়ে না। গণ্ডগোল বাঁধাইয়া রাখিতে পারিলেই যেন তাহাদের লাভ। সফি এবং-একবার নরম হয়, কিন্তু রফিজ মিয়ারই প্রতিবেশীরা তাজাকে নানান যুক্তি-পরামর্শ দিয়া শক্ত করে। এইভাবে জজ্ঞাল বাঁধিয়াই রহিল এতোদিন। ফয়সালা কিছুই হইল না। সফি মাসুদাকে তালাক দিবে না। রফিজ মিয়া কিংকর্তব্য বিমূঢ় হইয়া আপন কার্য্যে লাগিয়া রহিলেন।
দিন যাইতে লাগিল। জোহরা খাতুন ভাবিয়া কুল-কিনারা পাইলেন না। এমন সময়ে করিম মিয়া একদিন আসিয়া তাঁহাকে জানাইলেন যে, শ’তিনেক টাকা দিলে তিনি এর একটা কিছু ফয়সালা করিয়া দিতে পারেন সফির গাঁয়ের মাতুব্বরদের লইয়া। কাজীর গাঁয়ে তাঁহার ভগ্নিপতি বাড়ি। কাজেই সেখানে তাঁহার যথেষ্ট হাত আছে, ইহা বুঝাইলেন। মেয়েলোকের মাথায় কতো আর বুদ্ধি খেলে। জোহরা খাতুন ভাবিলেন, হয়তো সম্ভব হইবে। কিন্তু টাকা কোথায় পাইবেন? স্বামীকে তিনি জানেন। নেহাৎ কর্তব্য বলিয়াই তিনি টাকা খরচ করিয়া মেয়ের বিবাহ দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কিন্তু ঘুষ দিয়া তালাকনামা আদায়ের টাকা তাহার বাক্সে নাই। তাঁহার কাছে টাকা পাইবার উপায় নাই। অবশেষে তিনি ছেলেদের সহিত পরামর্শ করিয়া গোপনে টাকা সংগ্রহ করিলেন এবং করিম মিয়াকে দিলেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য যে, ফাঁকতালে করিম মিয়া তিনশত টাকা উদরসাৎ করিলেন, আসলে কাজ কিছুই হইল না!
অনেকে রফিজ মিয়াকে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা বসাইতে পরামর্শ দিয়াছিলেন। তিনি তাহাতে রাজী হন নাই। বলিয়াছেন, মেয়ে নিয়া মামলা করিয়া কে জিতিয়াছে? ছেলের স্বাস্থ্য-সামর্থ্য,অর্থ-সবই আছে। তাজাকে বর্জন করা আইনত: অসাধ্য। বলিব না নাই, সংসারে সুখ নাই, স্বামীর রূচির সংগে খাপ খায় না, মনে মনান্তর, মতান্তর-স্বামীকে ভালোই লাগে না মেয়ের। অতএব, তাহাকে বর্জন করিব-এটা মেয়েদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। সেটা শুধু পুরুষেরাই পারে। আইনে তাহাকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না। কিন্তু অপছন্দনীয় স্বামীকে ত্যাগ করিবে, মেয়েদের জন্য সেইরূপ আইন আজও সৃষ্টি হয় নাই। পুরুষের স্ত্রী বর্জনে ‘কারণ’ দরকার হয় না। মেয়েদের স্বামী বর্জনের জন্য উপযুক্ত কারণ দর্শাইতে হয়।… … এসব যদিও সত্য, কিন্তু আসলে রফিজ মিয়া মেয়ের জন্য বেহুদা টাকা খরচ করিতে ইচ্ছুক নহেন বলিয়াই মামলা-মোকর্দ্দমার মধ্যে যাইতে চাহেন না।
এই সময়ে সহসা মাসুদা একদিন ডাকে একটা চিঠি পাইল। খুলিয়া দেখিল যে, উহা আয়েষার লেখা। সে বিস্মিত এবং আনন্দিত মনে উহা পাঠ করিতে শুরু করিল-
প্রিয় মাসুদা,
দীর্ঘ দেড় বছর পরে আমার সাড়া পেয়ে খুব আশ্চর্য্য হয়েছিস না। ভেবেছিলে, হয়তো আত্মাহত্যা করেছি। কিন্তু তা করিনি। মরণটাকি অতো সোজা ভেবেছিস? জীবনের দাম আছে। সহজেই তাকে ডালি দেয়া যায় না। বেঁচে থাকাটাই জীবনের সার্থকতা। তাই বাঁচার জন্যে এতো চেষ্টা। তবে বাঁচাটা বাঁচার মতোই হওয়া চাই। জীবন্মৃত হয়ে বাঁচার চাইতে অবশ্য মরার শ্রেয়। কিন্তু সংগ্রাম করা চাই বাঁচার জন্য।
আমি পালিয়ে এসেছিলাম। কেনো, তা আশা করি তোকে বুঝিয়ে বলবার আবশ্যক করবে না। বুঝতেই পারছিস যে, যদি পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা না করতাম তবে নিশ্চয় তোর মতো দশা হতো আমারও। জীবনটা হাহুতাসে এবং সারাজনম জ্বলে-পুড়ে মরার একদিন নিঃশেষ হয়ে যেতো। কিন্তু আমি তা হতে দেইনি। নিজের পথ নিজেই খুঁজে নিয়েছি। বল-কী অপরাধ করেছি?
গাঁয়ে আমাকে নিয়ে মুখরোচক আলাপের অন্ত ছিলো না। এখনও চলছে আশা করি। আমরা নিখোঁজের ব্যাপার নিয়েও সম্ভবত: কিছুকাল জোরে-শোরে মজলিশী আলাপ চলছে। এখনও হয়তো তার বিরাম হয়নি, কেমন?
যাক গে, আমি এখন হালিম ভাইয়ের সংগে ঢাকায় আছি। থুরি-এখনও ভুল হয়, হালিম ভাই বলে ফেলি কখন কখনো। আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এখানে সংসার পেতেছি। অবশ্য এ সংবাদ অদ্যাবধি তার বাড়িতেও কেউ জানে না। হালিম ভাই-থুরি, আবার ভুল হয়-সে এখন বিএড পড়ছে। আমি মেট্রিক পাস করে একটা বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি এবং প্রাইভেটলী আইএ-র কোর্স পড়ছি। বেশ সুখেই আছি আমরা।… … কীভাবে কী হলো, এ-সব জানবার জন্য নিশ্চয় তোর খুব সাধ জেগেছে। কিন্তু না, সব বলব না। চিঠিতেই সব গুমোর ফাঁক করে দিলে, সাক্ষাতে বলবার যে আর কিছুই থাকে না। সাক্ষাৎ মতের সকল কিছু বলার আশা রইল।
আর একটা খবর তোকে জানাই, শুনে নিশ্চয় খুশী হবি। খবরটা হলো এই যে, আমাদের দাম্পত্য প্রণয়ের সোনার ফসল শীঘ্রই আসছে! খোদা চাহে তো, যেদিন তোর সাথে সাক্ষাৎ হবে, সেদিন তাকেও দেখতে পাবি। দোয়া করিস।
বিএড-এর ছ’মাস প্রায় হয়ে গেছে। ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলেই ওর সাথে দেশে ফিরব। কতোকাল মাকে দেখিনি, তোদের সংগে সাক্ষ্য নেই-মনটা এতো সুখের মাঝেও সে জন্যে ব্যথায় ভারাক্রান্ত। এতোদিনে আসতাম, কিন্তু সে বড়ো লাজুক এবং ভীতু। আমাকে সাথে আনতে চায়নি। লজ্জা এবং তার বাপ-ভাইয়ের ভয়। আচ্ছা বোকা যা হোক, কদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে এ খবর? যাক গে ওর পরীক্ষার পরে আর কোনো ওজরাপত্তি শুনবো না, আমি আসবোই।
তোর খবরতো জানিই। কিন্তু কী করি বল? এমনিভাবে ভবিষ্যতের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকিসনে। নিজের পথ নিজেই খুঁজে নে সময় থাকতে। মাথা উঁচু করে, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়া। লজ্জা, সংশয়, ভয় দূর কর। লোক নিন্দায় কী আসে যায়? কান দিসনে ও-সবে। নিজের জীবনটাকে সার্থক করতে চেষ্টা করিস। অনাগত ভবিষ্যতের হাতে ভাগ্যকে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে থাকা সমীচীন নয়। … … … মেয়েদের অধিকার পুরুষেরা সহজে দিতে চাইবে না। সমাজে, সংসারে তারা পাত্তা পাবে না কোনোদিনই, যদি না তারা উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা পায় এবং অকুতোভয় হয়ে নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে যতœবতী না হয়। আমরা মেয়ে না যেনো ‘মোয়া’-এক পয়সার কিনে কামড় দিয়ে থাক কি গিলে থাক, খেলেই হলো এক রকমে। এ-ছাড়া আর কী? আমাদেরও প্রাণ আছে, মন আছে, সাধ-ইচ্ছা আছে, জীবনে সুখ-শান্তি লাভের কামনা আছে। ভোগ-সুখ, জীবনযাত্রার ব্যক্তিগত পছন্দ, রূচি অনুভূতি, সব কিছু। কিন্তু কে তা’ স্বীকার করে বল? আমরা যদি আত্মসচেতন হই, তবে-
‘সেদিন সুদূরে নয়
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে
গাহিবে নারীরও জয়।’
ভালোই আছি। তোর কুশল সংবাদ জানাতে বিলম্ব করিস নে। তোর সমস্যার সমাধান করবার কোনো পথ-পন্থা হয়েছে কি? কী সাব্যস্ত করেছিস, না এখনও কিছু স্থির করতে পারিসনি? জানাস সকল সংবাদ। প্রীতি অন্তে এখানেই ছেদ টানছি এ-লেখার আজকের মতো। ইতি-
তোর আয়েষা।

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *