ধূম্রদের অভিযান

(পূর্ব প্রকাশের পর)
৯ম পর্ব
‘বি এস এ-৭১’ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের সব ধরণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেন ড. আশরাফ। অত্যাধুনিক স্যাটেলাইটি প্রস্তুত করার সময় ড. আশরাফ বার বার আনমনা হয়ে যেতেন। দেখে মনে হতো তিনি যেন কোনো কিছু নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়েছেন। একদিন তাঁর সহকর্মী মহাকাশ বিজ্ঞানী ড. মাহফুজ জিজ্ঞেস করলেন- ‘ স্যার আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করেছি এখানে এলেই আপনার ভেতর একটা গভীর ভাবনা কাজ করে। বলার মতো কোনো সমস্যা থাকলে দয়াকরে বলুন, সমাধানের চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। ‘ড. আশরাফ কোনো ধরণের রাখঢাক না করেই বললেন-‘হা মিস্টার মাহফুজ, এখানে আসলেই আমার মনে একটা ভয় কয়েকগুণে বেড়ে যায়। এতো উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করে আমরা অবুঝের মতো মহান আল্লাহর ছুড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ কি গ্রহণ করছি না? আমরা কি পরোক্ষভাবে নাস্তিকদের মতো আল্লাহর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছি না? এই আশংকাটি আমাকে বার বার ভাবাচ্ছে।’ আৎকে উঠলেন ড. মাহফুজ। সাথে সাথে প্রশ্ন করলেন- ‘ তা কিভাবে হয় স্যার? দয়া করে একটু খোলাসা করে বলুন। ‘ ‘ বিষয়টি খুব সূক্ষ্ম নয়। আপনি নিশ্চয় কোরআনের সেই ঘটনাটি জানেন। আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে এরশাদ করেছিলেন- ” বলুন, যদি এই কোরআনের অনুরূপ কোরআন আনয়নের জন্য মানুষ ও জ্বিন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে, তবুও তারা এর অনুরূপ কোরআন আনয়ন করতে পারবে না। (সুরা-বনী ঈসরাইল-৮৮)” অন্য সুরায় এরশাদ হচ্ছে-“তারা কি বলে? কোরআন তুমি রচনা করেছো? তুমি বলো, তাহলে তোমরাও এর অনুরূপ স্বরচিত ১০টি সুরা আনয়ন করো এবং (সাহায্যার্থে) আল্লাহ ছাড়া যাকে ডাকতে পারো ডেকে নাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সুরা-হুদ-১৩)” মুশরিকরা এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে আল্লাহ তায়ালা আরও সহজ করে সুরা ইউনুস এবং সুরা বাকারার শুরুতে একথা বলেছেন যে, তা না পারলে অন্ততপক্ষে ১টি সুরা রচনা করে আনো। এতেও তাঁরা অপারগ হলে সর্বশেষ আল্লাহপাক খুবই সহজ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে এরশাদ করেন-“তাঁরা যদি সত্যবাদী হয় এর সদৃশ কোনো কথা উপস্থিত করুক না। (সুরা-তুর-৩৪)”
ইতিহাস বলে, কাফির-মুশরিকরা অবশেষে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এবং সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও আল্লাহর বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে পারেনি। কিন্তু তাদের মতো কোনো মুসলমান ভুল করেও এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি। কারণ মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো পবিত্র কোরআনের একটি শব্দেও কোনো ভুল এবং অবান্তর কথা নেই। আমার কেন-জানি বার বার চিন্তা হয়- ঠিক এই চ্যালেঞ্জের মতো মহাকাশ বিষয়ক একটা চ্যালেঞ্জও রয়েছে আল্লাহর। এটা প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও পরোক্ষভাবে রয়েছে আল কোরআনে। জানি না আপনি আমার সাথে এতে একমত হবেন কিনা। তবে আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। ‘ ড.মাহফুজ বললেন-‘ বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। যুক্তিসংগত হলে একমত না হয়ে কি পারা যায়! এখন বিস্তারিত বলুন স্যার। ‘ ড.আশরাফ পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করে সাথে সাথে বাংলা অনুবাদ করে বললেন-‘ এরশাদ হচ্ছে-” তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ জানেন যা কিছু আকাশে ও ভূমণ্ডলে আছে। এসব কিতাবে লিখিত আছে। এটা আল্লাহর কাছে সহজ। ” অন্যত্র এরশাদ করেছেন-“সে ধারণা করে যে, আল্লাহ কখনোই ইহকাল ও পরকালে রাসুলকে সাহায্য করবেন না, সে একটি রশি আকাশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে নিক;এর পর কেটে দিক; অতঃপর দেখুক তাঁর এই কৌশল তাঁর আক্রোশ দূর করে কি-না। “পবিত্র কোরআনের সুরা ছোয়াদ এর ১০ নং আয়াতে অনুরূপ এরশাদ হয়েছে-“নাকি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর উপর তাদের সাম্রাজ্য রয়েছে? থাকলে তাদের আকাশে আরোহণ করা উচিত রশি ঝুলিয়ে।” আকাশে রশি ঝুলিয়ে আরোহণ করার আয়াত দু’টি যদিও কিয়ামত দিবস ও পরকালকে অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে কিন্তু এই হুকুম সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আকাশে আরোহণ করার ক্ষমতা আজ মানুষের হয়েছে। মানুষ রকেট নিয়ে উড়ছে মহাকাশের ভেতর। চেষ্টা করছে আরও গভীরে যেতে। এর লক্ষ্য একটাই, সব কিছুর রহস্য উম্মোচন করা। আর এটা করছে অমুসলিম বা নাস্তিক বিজ্ঞানীগণ। কিন্তু কোনো মুসলিম বিজ্ঞানীর জন্য এই রহস্য উম্মোচন করার ইচ্ছায় মহাকাশে আরোহণ করা কি ইসলাম সমর্থন করবে? কোরআনের আয়াতে রশি, সিঁড়ি বা যে কোনো বাহনের মাধ্যমে আকাশে আরোহণের মাধ্যমে আল্লাহর ফয়সালা স্থল বা আরশে আজীম পর্যন্ত যাওয়ার যে চ্যালেঞ্জ ছুড়া হয়েছে তা যে কেউ গ্রহণ করে চেষ্টা চালাক না কেন, কোনো মুসলমানের জন্য কখনো এটা বৈধ হওয়ার কথা নয়।

বিধর্মী বা নাস্তিক মহাকাশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় কোনো একদিন তারা মহাকাশের প্রান্তে পৌছতে পারবে। তখন বিশ্বভ্রমাণ্ডের রহস্য তাদের হাতের নাগালে এসে যাবে। সব রহস্য তারা খোলে ফেলবে। কিন্তু একজন মুসলমানের যে বদ্ধমূল ধারণা তাতে মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা বৈধ কিন্তু সেই সৃষ্টি তত্ত্ব সম্পর্কে গবেষণা করে কিনার পাওয়া বা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছা মানুষের জ্ঞানের বাইরে। তাই আমরা যে কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বি এস এ-৭১’ উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিচ্ছি তার বৈধতা খুঁজে পাচ্ছি না মিস্টার মাহফুজ। ‘ ড.আশরাফের কথাগুলো শুনে চমকে উঠলেন ড.মাহফুজ। তিনি বললেন -‘ তাইতো স্যার। এটা রীতিমতো ধৃষ্টতা। তবে আল্লাহর দেয়া চ্যালেঞ্জ কোনো কালেই কেউ মোকাবেলা করতে পারবে না। তারা মহাকাশের ভেতর যতোই যাবে ততো বিভ্রান্ত হয়ে ফিরবে। কেননা পবিত্র কোরআনে যে সাত আকাশের কথা বর্ণিত হয়েছে সেই সাত আকাশের পরিসীমা সীমিত মানব জ্ঞানেই ধরবে না। আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যের তত্ত্ব – রহস্যভেদ মানুষের নাগালে আসা অসম্ভব স্যার’ ড.আশরাফ এবার বেশ ক্ষোভের সাথে বললেন- ‘ঠিক বলেছেন আপনি। তবে কয়েকজন মুসলিম বিজ্ঞানীর অন্ধকারে ঢিল ছুড়ার মতো তথ্য পরিবেশন করা দেখে দুঃখ হয়। তারা ধারণা করে বলেছেন, মহাকাশ বিজ্ঞানীগণ মহাকাশের যে সাত স্তর নির্ধারণ করেছেন তা কোরআনে বর্ণিত সাত আকাশই। তাদের যুক্তি হলো, পবিত্র কোরআনের সুরা মুলক এর ৩নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে-“তিনি (আল্লাহ) সাত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টিতে কোনো তফাৎ দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোনো ফাটল দেখতে পাও কি?” অনুরূপভাবে সুরা নুহের ১৫নং আয়াতে এরশাদ হচ্ছে-“তোমরা কি লক্ষ্য করোনা যে, আল্লাহ কিভাবে সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন।” এসব যুক্তি দিয়ে সপ্ত আকাশকে মহাকাশের গণ্ডির ভেতর নিয়ে আসা কতোই না নির্বুদ্ধিতা। কেননা তাদের কথানুযায়ী পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশে মেঘমালা চলাচল করে। যদি মেঘের আকাশকে প্রথম আকাশ ধরা হয় এবং সূর্যের নিকটবর্তী আকাশকে সপ্তম আকাশ হিসেবে ধরা হয় তাহলে সূর্যের উপরের অর্থাৎ সূর্যালোকের বাইরের মহাকাশকে এসব বিজ্ঞানীগণ কি নামে সম্ভোধন করবেন?
অথচ সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রগুলোর কক্ষপথের প্রান্তসীমার বাইরেও আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্য রয়েছে। এছাড়া মহাকাশ স্টেশনের বিজ্ঞানীগণ এখন এমন কিছু নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছেন যার আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগবে ১০০কোটি বছর। ড.মাহফুজ বললেন-এদের কথায় মনে হচ্ছে যেন বোকার রাজ্যেই এরা বাস করে। বিজ্ঞানীদের নির্ধারিত সাতটি স্তর কোরআনে বর্ণিত সাত স্তরের প্রথম স্তর মাত্র। তাদের গবেষণা প্রথম আকাশেই সীমাবদ্ধ। এই গণ্ডির বাইরে যাওয়া তাদের পক্ষে কল্পনাও করা যায় না। কেননা সাত আকাশের উপর রয়েছে সিদরাতুলমুনতাহা, আরশ, কুরসি, লৌহ-কলমসহ আল্লাহর অশেষ কুদরতি ব্যাপার। তিনি আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু ড.আশরাফ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-মহাকাশ বিজ্ঞানীরা যে সাতটি স্তর নির্ধারণ করেছেন সেগুলো হলো-১. ট্রপোস্ফিয়ার। এটি সর্বনিম্ন বায়ুস্তর। ভূপৃষ্ঠের লাগোয়া স্তর যা মানুষেরা অনুভব করে। এ স্তরের উচ্চতা বা পুরোত্ব ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত। ২. স্ট্রেটোস্ফিয়ার। প্রথম স্তরের উচ্চতার পর থেকে শুরু করে ৫০কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এর উচ্চতা। ৩. ওজন স্তর। এটি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষাকারী আবরণ স্তর। ৪. মেসোস্ফিয়ার। ৫. থার্মোস্ফিয়ার। ৬. আয়নোস্ফিয়ার। ভূপৃষ্ঠ থেকে এই স্তরের শেষ সীমানা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। এই স্তর থেকে রেডিও তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়। এই স্তরে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নিতকরণ হয়েছে বলে এটিকে ঝালর স্তর বা বায়ুস্তরের অলংকার স্বরূপ স্তরও বালা হয়। ৭. এক্সোস্ফিয়ার। এটি ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরে গ্যাসের ঘনত্ব খুব কম এবং আয়নিত অবস্থায় আছে। এই সাতটি স্তর পৃথিবীর নিরাপত্তায় কাজ করছে। কোনো একটি স্তর নষ্ট হয়ে গেলে প্রাণীজগৎ হুমকির মুখে পড়বে এবং প্রাণীকূল বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে। আফসুসের ব্যাপার হলো, এইসূত্রে কতিপয় ইসলামি বিজ্ঞানী ঘোষণা দেন-এই সাতটি স্তরই কোরআনে বর্ণিত সাত আকাশ।
(৮ম পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *