ধূম্রদের অভিযান

গত সংখ্যার পর
৫ম পর্ব
ইয়াজুজ ও মাজুজ এমন অত্যাচারিত দু’টি জাতি যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর পৃষ্ঠে উঁচু পাহাড়ের ঢালুতে প্রাচীর দিয়ে বন্দী করে রেখেছেন। তাই এই ধ্বংসকারী জাতিকে পৃথিবীর কেউ দেখতে পায় না। এরা দুর্ভেদ্য প্রাচীরটি ডিঙাতে চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। মহাপ্রলয়ের পূর্বে এরা ঠিকই প্রাচীরটি ভেঙে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সব পানি পান করে নদী-সমুদ্র শুকিয়ে ফেলবে। পানি শূন্যের পর পিপাসায় তারা কাঁদা-মাটি খেতে থাকবে। সব কাঁদা-মাটি শেষ হলে পৃথিবীর সবকিছু ধ্বংস করবে। মানুষ ও জীবজন্তু হত্যার পর তারা বলবে-পৃথিবীর সবাইকে তো হত্যা করে ফেললাম, এবার আকাশের সবাইকে হত্যা করব। একথা বলতে বলতে তারা আকাশের দিকে তীর ছুঁড়তে থাকবে। তাদের ছুঁড়া তীরের ফলায় আল্লাহ তায়ালা রক্ত মাখিয়ে ফিরিয়ে দেবেন। এতে তারা চরম বিভ্রান্ত হবে। বিভিন্ন ইসলামি গ্রন্থে এমনটাই বর্ণনা পেয়েছেন ড. আশরাফ। তবে আরও বিস্তারিত জানতে তাঁর আগ্রহ এবার চরমে উঠল।
ড. আশরাফ স্বপ্নে দেখা ঘটনাটি কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছেন না। তাঁর কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে, মহাপ্রলয়ংকারী দিন তথা কিয়ামত দিবস খুব নিকটেই এসে পড়েছে। আর ইয়াজুজ ও মাজুজ জাতি দু’টি শীঘ্রই আত্মপ্রকাশ করবে। তিনি স্বপ্নে ফলাফল জানতে হাজির হলেন তার আধ্যাত্মিক গুরু বালাকুটি হুজুরের দরবারে।
প্রখ্যাত দরবেশ আল্লামা বালাকুটি উঁচু দরজার একজন আলিমে দ্বিন। শরিয়ত এবং মারিফতের আলোয় ভরপুর তাঁর ছিনা। তার বাড়িতে প্রতি মাসে দুইদিন হয় ‘খানকাহ মাহফিল’। ড. আশরাফের ইচ্ছা, মাহফিল শেষ হলেই স্বীয় স্বপ্নের কথা বর্ণনা করবেন হুজুরের কাছে। আর ইয়াজুজ ও মাজুজ জাতি সম্পর্কে সূক্ষè কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নেবেন। কিন্তু তিনি বেশ আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করলেন যে, স্বীয় মনের ভেতর লুকায়িত প্রশ্নগুলোর হুবহু বিষয়ে প্রশ্নোত্তর আকারে আজ আলোচনা করছেন বালাকুটি হুজুর।
নির্ধারিত সংখ্যক জিকির শুরু হওয়ার আগে প্রায় ঘন্টাখানেক নসিহত প্রদান করেন বালাকুটি হুজুর। প্রতি মাহফিলেই এ আলোচনা হয়ে থাকে। একেকদিন একেক বিষয়ে অত্যন্ত নির্মল ও শান্ত পরিবেশে ভক্ত-মুরিদদের সামনে নসিহত করেন। এতে অলৌকিকভাবে অনেকের গোপন জিজ্ঞাসার উত্তর প্রশ্ন না করেই জেনে যান। যেমন করে আজ জানছেন ড. আশরাফ। তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে সেটা আয়ত্ব করে নিচ্ছেন।
মহাগ্রন্থ কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন-হে মুহাম্মদ (সা.) তারা আপনাকে যুলকারনাইন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন আমি তোমাদের কাছে তাঁর অবস্থা বর্ণনা করব। আমি তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম এবং প্রত্যেক বিষয়ের কার্যোপকরণ দান করেছিলাম। অতঃপর তিনি এক কার্যোপকরণ অবলম্বন করলেন। অবশেষে তিনি যখন সূর্যের আস্তাচলে পৌঁছলেন; তখন তিনি সূর্যকে এক পঙ্কিল জলাশয়ে অস্ত যেতে দেখলেন এবং তিনি সেখানে এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেলেন। আমি বললাম, হে যুলকারনাইন। আপনি তাদেরকে শাস্তি দিতে পারেন অথবা তাদেরকে সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পারেন। (সূরা কাহাফ, আয়াত ৮৩-৮৬)।

জুলকারনাইন পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতেন এবং নির্যাতিত, বঞ্চিত, শাসকের হাতে শোসিত লোকদের মুক্তি দিতেন। ইয়াজুজ মাজুজ জাতি সম্পর্কে বাইবেলেও বর্ণনা রয়েছে। খ্রিষ্টান ধর্মেও এ দু’জাতিকে গগ এবং ম্যাগগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অত্যাচারিত, অভিশপ্ত এবং রাক্ষুসে জাতি বলে পরিচিত ইয়াজুজ মাজুজ এশিয়ার উত্তর পূর্বাঞ্চলে মাঝে মাঝে ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতো। জুলকারনাইন তাদেরকে দুই পর্বতের মাঝে গলিত তামা, সীসা বা লোহার তৈরি একটি প্রাচীর বানিয়ে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেন।
অনেক গবেষকের ধারণা, রাশিয়া ও উত্তর চীনে ইয়াজুজ মাজুজ জাতির অবস্থান। কারো মতে, সেই স্থানটি হলো-কাসপিয়ান সাগরের উপকূলে। তাদের যুক্তি এখানে লোহা ও তামার তৈরি একটি প্রাচীর আবিস্কৃত হয়েছে যার প্রবেশ পথে ‘কাসপিয়ান গেট’ নামক একটা তোরণ রয়েছে। এই প্রাচীর ‘দারিয়াল’ এবং ‘দারবেন্ত’ নামে দু’টি শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘দারিয়াল’ রাশিয়া এবং জর্জিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। আর দারবেন্ত রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত একটি শহর। উক্ত দেয়ালটি তোলা হয়েছে দু’টি বৃহৎ পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে। পাহাড় দু’টিকে বলা হয় ‘পৃথিবীর উঠান’। দেয়ালের উচ্চতা ২০ মিটার এবং এটি ৩ মিটার (১০ ফুট) পুরু।
পবিত্র কোরআনের বর্ণনানুযায়ী জুলকারনাইন অরুণাচলে, যেখান থেকে সূর্য উদিত হয় সেখানে দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। সূরা কাহাফের ৯৩ হতে ৯৮ নম্বর আয়াতে এই প্রাচীর নির্মাণের উল্লেখ আছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, ইয়াজুজ মাজুজ জাতি ধাতুর ব্যবহার জানতো।
তারা হাপর বা ফুক নল দ্বারা বায়ু প্রবাহ চালনা করে ধাতুকে উত্তপ্ত করে গলাতে পারতো এবং তারা লোহার পিণ্ড ও গলিত সীসাও তৈরি করতে পারতো। তারা নিজেরাই জুলকার নাইনের আদেশে দুই পর্বতের মাঝে শক্ত প্রাচীর তৈরি করেছিল।
ইয়াজুজ মাজুজ জাতির তৈরি প্রাচীরের অবস্থান নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। তবে ড. আশরাফ সবকিছু জেনে শুনে এই সিদ্ধান্তে অটল হচ্ছেন যে, দাজ্জালের ফেতনার পূর্বে এরা কোনো অবস্থায় পৃথিবীতে আসতে সক্ষম হবে না। তাঁর স্বপ্নে আদিষ্ট এলিয়েন ইয়াজুজ মাজুজ জাতির কেউ নয় এবং এরা কোরআন-হাদিসের বাণীকে মিথ্যা প্রমাণিত করে মাহদি বা ঈসা (আ.) এর আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে আসা কল্পনা করা যাবে না।
খানকাহ মাহফিল শেষে বালাকুটি হুজুরের খাস কামরায় সাক্ষাত করলেন ড. আশরাফ। একজন ভক্ত সাগরিদের বিনয়ের চেয়ে অনেক বেশি বিনয়ী হয়ে ড. আশরাফের সাথে আচরণ করছেন বালাকুটি হুজুর। অথচ এটা ঠিক উল্টো হওয়ার কথা ছিল। একটুও খটকা লাগল না ড. আশরাফের কাছে। কেননা তিনি প্রখ্যাত বুজুর্গ বালাকুটি হুজুরকে ভালো ভাবেই জানেন। সম্মানী ব্যক্তিদের কদর করা প্রকৃত সম্মানী ব্যক্তিদের কাছেই শেখা যায়। এটা ইসলামের নির্দেশেরই প্রতিফলন। আর ওলী আউলিয়াগণ হলেন শরিয়তের বাস্তব উদাহরণ। একজন সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত বিজ্ঞানী ব্যক্তি ড. আশরাফ শরিয়তের পুরোপুরি অনুসরণকারী বলেও আলাদা মর্যাদা পান এ মহান বুজুর্গের কাছ থেকে। ড. আশরাফ এসমস্তকে গ্রহণ করেন ততোধিক বিনয় ও নিরহংকারের সাথে।
ড. আশরাফ স্বীয় গবেষণাগারে বসে সাজ্জাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। সাজ্জাদ কোথায় আছে তিনি সঠিকভাবে জানেন না। অধ্যাপক আবু সালেহ এতোদিন নিজেকে কোন কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন তাও তিনি জানেন না। সমস্ত দিন একধরণের অলস সময় কাটল ড. আশরাফের। বিকেলে সাজ্জাদ দেখা করার অনুমতি চাইল তার অনির্দিষ্ট একটি বাসায় এসে। রুমে ঢুকে ড. আশরাফকে সালাম করে বলল-স্যার, আজ সারাটি দিন আপনার সবকটি অবস্থানের জায়গা খোঁজে বেড়িয়েছি, আপনাকে পাইনি। অবশেষে অদৃশ্য থেকে কানের কাছে কেউ বলল, আপনি এখানে আছেন তাই সাথে সাথে ছুটে এলাম। অদৃশ্য থেকে কিভাবে শুনলে সাজ্জাদ? তোমার কানের যন্ত্রটিতো আমি আগেই সরিয়ে ফেলেছিলাম। তবে কি তুমি হ্যালোসিনোসনে ভুগছ? ড. আশরাফ বললেন। সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন-জানি না স্যার। তবে এভাবেই শুনেছি আর বিশ্বাস করে ছুটে এসেছি। আমি কিন্তু আপনার কাছ থেকে আর কোথাও যেতে চাই না। আপনি আমার জীবন রক্ষা করেছেন। ইহকাল ও পরকালের ধ্বংস থেকে আমাকে উদ্ধার করেছেন। আমি আপনার খেদমতে সারা জীবন কাটাতে চাই। ড. আশরাফ তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালেন সাজ্জাদের চোখের দিকে। দেখলেন তাঁর চোখে সন্দেহের কিছু দেখা যাচ্ছে না। বললেন-শুনো সাজ্জাদ, আমি একাকি মানুষ। সারা জীবন কাটালাম একা একা। আমার কোনো সহকর্মী বা খেদমতগার প্রয়োজন নেই। তুমি বরং গ্রামের বাড়ি গিয়ে সাধারণ জীবনযাপন শুরু করো। সাজ্জাদ কেঁদে ফেলল। কেঁদে কেঁদে বলল-আপনি পৃথিবীর মানুষের উপকার ছাড়া কোনা অপকারের চিন্তা কখনো করেন না। কিন্তু আপনার কোনো সাগরিদ না থাকলে ভবিষ্যত পৃথিবীর ক্ষতি ছাড়া ভালোর চিন্তাই করা যায় না। অন্তত আমাকে সাথে রেখে যদি এই খেদমতের সুযোগ দেন তাহলে আগামী পৃথিবীর মানুষ আপনার জন্য অনেক দোয়া করবে। ভালো মানুষদের মাঝে বেঁচে থাকবেন আপনি এবং আপনার কর্র্মকাণ্ড। ড. আশরাফ বললেন ‘তা পরে দেখা যাবে সাজ্জাদ। এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে অধ্যাপক আবু সালেহের খোঁজ নেয়া। বেচারা নতুন কোনো ফন্দিতে আছেন কি-না তা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। ‘হ্যাঁ কি করতে হবে। স্যার আমাকে বলুন। আমি তা জীবন দিয়ে হলেও করব’ সাজ্জাদ বলল। না, না। জীবন দিতে হবে না। অতি সাধারণ একটা কাজ, তুমি মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখ। কালকের মধ্যেই তা করা উচিত। ড. আশরাফ কথাটি বলে একটা ম্যাপ খুলতে লাগলেন। ম্যাপটি দেখিয়ে সাজ্জাদকে সব বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। (চলবে)র্
(৪র্থ পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *