ধূম্রদের অভিযান

গত সংখ্যার পর
২য় পর্ব
জঙ্গিনেতা সাজ্জাদের কাছে বিভৎস এসব হামলা-হত্যার কোনো কিছু আর জানতে চান না ড. আশরাফ। ভিডিও দৃশ্যগুলো দেখে দেখে হাঁপিয়ে উঠেছেন। ধর্মের নামে এতো হত্যা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের আসল উদ্দেশ্য কী সেটা স্বয়ং জঙ্গিনেতার মুখে এখন শুনতে আগ্রহী তিনি। যদিও জানেন, সাজ্জাদ নিজ থেকে কিছু বলবে না। তাকে বলানোর জন্য ‘স্ক্যানার হেমলেট’-এর আশ্রয় নিতে হবে। আজ বিরতি নিলেন। পরের দিন একই সময়ে এসে বসলেন গবেষণাগার কক্ষে। সব সেটআপের নির্দেশ দিলেন বিজ্ঞানী ধূম্রটিমকে।
কম্পিউটারের পর্দায় সাজ্জাদকে নীরিক্ষা করে মাইক্রোফোনে প্রশ্ন করলেন ড. আশরাফ-‘তুমি আধুনিক যুগের একজন সমজদার যুবক হয়ে মানুষ হত্যা করছো কিসের লোভে?’ সাথে সাথে সাজ্জাদের উত্তর-‘এখন কোনো লোভ-ক্ষোভ বুঝি না। শুধু নির্দেশ পালনে নিজেকে সঁপে দেই।’ ড. আশরাফ ও জঙ্গিনেতা সাজ্জাদের প্রশ্নোত্তর এগিয়ে চললো।
‘কার নির্দেশ পালনে এতো অন্যায়, বিকৃত রুচির কাজ করে যাচ্ছ? ড. আশরাফের প্রশ্ন। সাজ্জাদ কোনো দ্বিধা না করেই উত্তর দিলো-‘আমার বসের। পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. আবু সালেহ’র।’
‘কেন? তোমার পিতা-মাতার আশা আকাঙ্খার উপেক্ষা করে আবু সালেহ’র নির্দেশ পালন করছো কেন?’
‘আমার পিতা-মাতা ধর্মের সবদিক বুঝেন না। তিনিই বুঝেন।’
‘এটার কি করে তুমি বলতে পার? অথচ তারা না হলে তোমার জন্মই হতো না।’
‘আমি দেখেছি, আমার পিতা-মাতা নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে খুবই উদাসীন। তারা যেমনি ইসলাম ধর্মের আবশ্যকীয় রীতিগুলো পালন করে না অনুরূপ আমিও আদায় করতাম না। এখন নিজ ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে পেরেছি, তাই স্বীয় কর্তব্য পালনে জীবনকে সার্থক করে তুলছি।’
মাত্র দশগজের ব্যবধানে দুই কক্ষে বসা ড. আশরাফ ও সাজ্জাদের প্রশ্নোত্তর চলছিল বড় পর্দার ভিডিও চ্যাটে। সাজ্জাদের এই উত্তরে মুসলিম সমাজের একটি চরম বাস্তবতা ও ব্যর্থতার চিত্র দেখতে পেলেন ড. আশরাফ। তিনি মনে মনে বললেন-প্রত্যেক মুসলিম পিতা-মাতা যদি ইসলাম ধর্মের সঠিক শিক্ষা উপলব্ধি করে শরয়ী বিধানাবলী মেনে চলতো তবে তাদের সন্তানরা দেখে দেখেও তা শিখতে পারতো। অথবা নিজেদের অপরাগতার ব্যর্থতা ঘুচাতে স্বীয় সন্তানদের ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রদানের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে ইসলামী আদর্শে গড়ে তুলতো। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলিম সমাজ বেশ উদাসীন।
ড. আশরাফ একমিনিট থেমে আবার প্রশ্ন করতে শুরু করলেন-‘তুমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে এখন কি জানতে পেরেছ?’
সাজ্জাদ মুখস্ত করা কথার মতো গড় গড় করে উত্তর দিলো-‘আমার ধর্ম বলে, আমাকে জান্নাতে যেতে হবে। জান্নাতে যাওয়ার সব প্রকারের পথ ও কর্ম অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, সমাজ থেকে, দেশ থেকে সব ধরণের অন্যায় ও বিজাতীয় সংস্কৃতি তাড়ানো। এটা বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ না করা।’
‘কিন্তু তুমিতো স্বীয় ধর্মের লোকদের হত্যা করছো। মসজিদ ও ঈদগাহে মুসল্লিদের উপর আক্রমণ করছো? নির্বিচারে যেকোনো মানুষ হত্যা করাকে তুমি ধর্মের কাজ কি করে বলতে পারো?’
সায়েন্স ফিকশন
‘কুসংস্কারধারী, অন্যায়কারী নিজ ধর্মের হলেও তাকে হত্যা করে জঞ্জালমুক্ত রাখা কর্তব্য। ফলে এই দেশ একটি খাঁটি ইসলামী শাসনের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে। চমৎকার একটা শান্ত, জান্নাতি পরিবেশের দেশের বাসিন্দা হবো আমরা। যেখানে কোনো সুখভোগের অভাব থাকবে না। ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি ছাড়া কোনো কাজের বালাই থাকবে না।’
‘ছি: ছি:। এমন গর্হিত কাজের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাও? ইসলামি ধর্মগ্রন্থের কোথায় নির্দেশ আছে এই কর্মপন্থার? তুমি কি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারবে?
‘প্রমাণটা আমার বসই আমাকে দেখিয়েছেন। তিনিই ভাল বলতে পারবেন।’
গুরুত্বপূর্ণ এই পয়েন্টে একটু অবকাশ নিলেন ড. আশরাফ। তিনি জঙ্গিগ্র“পের মূল ব্যক্তিকে আটক করতে চান। সেই ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় জানতে সাজ্জাদের কাছে কতটা তথ্য পান, কেমনভাবে সে মুখ খুলে তারই অপেক্ষা এখন। ভুল বা মিথ্যা কিছু বললে সামনে রাখা অত্যাধুনিক কম্পিউটার সিগন্যাল দিতে থাকবে। একটু কৌশলী প্রশ্ন সাজাতে থাকলেন ড. আশরাফ। বিরতি নিয়ে প্রশ্ন করলেন-‘এ বিষয়ে তোমার বস কি বলেছেন?’
‘তিনি বলেছেন, এই দেশ এখন আর আগের মতো নেই। এদেশে ঠিক মতো ইসলামী রীতি পালন করা হয় না। অথচ সংখ্যাগরিষ্টলোক মুসলমান। বিজাতীয় সংস্কৃতিতে ভরে গেছে চারপাশ। আর তোমাদের মতো যুবকরা গোলামী জীবনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যে জীবনে তোমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই। যেখানে তোমাদের কোনো ইচ্ছাই পূরণ হবে না। তোমাদের পিতা-মাতা যেমন ইসলাম থেকে অনেক দূরে সরে গেছে তেমনি তোমরাও।’
ড. আশরাফের কপালে ভাঁজ দেখা দিলো। তিনি ধূম্রদের বললেন; দেখতো হ্যামলেট স্ক্যানার কাজ করছে কিনা ঠিক মতো। সাজ্জাদ এমন স্বাভাবিকভাবে অনর্গল কথা বলছিল দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল যন্ত্রগুলো কাজ করছে কিনা। কিন্তু ‘হ্যামলেট স্ক্যানার’ ঠিক মতোই কাজ করছিল।
পাশের ল্যাবরোমে হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দে ড. আশরাফ চমকে উঠলেন। কি ঘটতে পারে ভাবার আগেই বাইরের ফ্লোর ধূয়ায় ঢাকা পড়ে গেল। গ্লাসে মোড়া রোম বলে তিনি নিরাপদ বসে বাইরের সব দেখতে পাচ্ছেন। হাইভোল্টেজের বৈদ্যুতিক বাতিগুলো জোনাকি পোকার আলোর মতো দেখাচ্ছে এখন। তীব্র গতিতে ছুটোছুটো করছে লাখ লাখ ধূম্র।
ল্যাবরেটরিতে সিসি ক্যামেরার সাথে যুক্ত ওয়াচ পর্দা চালু করলেন তিনি। ঝাঁপসার মাঝেও ল্যাবের চিত্র দেখে ভ্রুকুচকে মৃদু হাসলেন। ধূম্রদের টেস্টটিউবগুলো বিস্ফোরিত হওয়ায় সবাই বাইরে চলে এসেছে।
ড. আশরাফ বুঝলেন, এটা তারই অসতর্কতায় হয়েছে। সময়মতো ধূম্রদের টিউবআউট না করায় মাত্র ২ সেকেন্ড বেশি সময় পেয়ে অত্যাধিক পক্ক হয়ে উঠেছিল তারা। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। গ্লাসেমোড়া তার গবেষণাগারের বাইরে বেরোতে পারবে না একটি ধূম্রও। ড. আশরাফ রেড এলার্টের সুইচ টিপে দিলেন। চারদিকে এমার্জেন্সি সাইরেন সচল হয়ে উঠলো। এখন থেকে কারো জন্যই বাইরে বেরোনো এবং ভেতরে প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
সাজ্জাদের স্বীকারুক্তিমূলক বক্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে, সব কলকাঠি অধ্যাপক আবু সালেহের হাতেই। আবু সালেহের নাড়ি-ভূড়ি ও খুঁটির জোর সব জানিয়ে দিয়েছে সাজ্জাদ। তাকে আটক করলেই জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক তছনছ করা যাবে বলে ড. আশরাফ নিশ্চিত হলেন। কিন্তু এই নাটের গুরুকে গ্রেফতার করাও বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। ধূম্রদের দিয়ে আটক করতে হলে আবু সালেহর ডিএনএ অবশ্যই সংগ্রহ করতে হবে। কেননা ডিএনএ রিপোর্টের তথ্য ছাড়া তার পরিচয় ধূম্রদের দেয়া সম্ভব নয়।
ড. আশরাফ বুঝলেন, সাজ্জাদকে দিয়েই এ কাজ করতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাজ্জাদকে সুস্থ করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারপর কৌশলে পাঠাতে হবে আবু সালেহের আস্তানায়। ড. আশরাফ স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে এ কাজে লেগে গেলেন। সাজ্জাদকে পুরোপুরি সুস্থ করে ফিট করতে কত দিন সময় লাগতে পারে তার একটা হিসেব বিশ্লেষণ করতে লাগলেন মনিটরের পর্দায়।
জঙ্গিনেতা সাজ্জাদকে হারিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন অধ্যাপক আবু সালেহ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি বিভাগে খুঁজ নিয়েও সাজ্জাদের সন্ধান পাননি তিনি। তার সংগঠনের গোয়েন্দা বাহিনীও কোনো তথ্য দিতে পারেনি সাজ্জাদের। সাজ্জাদ নিজ থেকে লুকিয়ে আছে নাকি কেউ অপহরণ করে তুলে নিয়েছে তাও বুঝতে পারছেন না ড. আবু সালেহ। দেশের যে কোনো বাহিনী তুলে নিলে তিনি অবশ্যই তথ্যটি জানতেন। কেননা প্রতিটি ডিপার্টমেন্টেই তার গোয়েন্দা পার্টির লোক রয়েছে।
অধ্যাপক আবু সালেহ সাজ্জাদকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে খুব পেরেশান হয়ে উঠলেন। সাজ্জাদের কাছ থেকে কোনো ধরণের তথ্য উদঘাটন কোনোভাবেই কেউ করতে পারবে না এতে তিনি নিশ্চিত। কিন্তু তার একমাত্র ভয় দেশের প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ড. আশরাফকে। সাজ্জাদ তার হাতে গেলে এতো দিনের সাধনা-পরিশ্রম সব মাটি হয়ে যাবে। তিনি মস্তিস্কের কোষ থেকে স্মৃতিকে জীবন্ত করে তুলতে পারেন বলে সবার মতো আবু সালেহেরও ধারণা।
ড. আশরাফ কোথায় থাকেন, কোথায় যান, নির্দিষ্ট আস্তানাই বা কোথায় তা আজও কেউ জানেন না। এটা এক মহা রহস্য। বিভিন্ন সেমিনারে বক্তৃতার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎই তাকে দেখা যাবে। বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ থেকে নামার সাথে সাথেই সম্পূর্ণ অদৃশ্য। সিসি ক্যামেরা ও তার গতিবিধি রেকর্ড করতে সক্ষম হয়নি।
প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ড. আশরাফের ব্যাপারে সন্দেহের পুকা মাথায় ঢুকতেই অধ্যাপক আবু সালেহ পুরোপুরি অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন। সাজ্জাদের কথা ভেবে ভেবে তার রাগ ক্ষোভ চরমে উঠলো। তিনি তার আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত পিস্তলটি কোমরের খাপ থেকে হাতে নিয়ে ঠিক আছে কিনা তা পরখ করতে লাগলেন। রাগে গরগর করতে করতে তার ইচ্ছে জাগছে, সাজ্জাদকে দেখা মাত্রই গুলি করে হত্যা করা। ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গিনেতা সাজ্জাদ আকস্মাৎ উপস্থিত হলো আবু সালেহের সামনে। বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলেন তিনি। ভাবার আগেই হাতটি নড়ে উঠলো। পিস্তলের মুখ সাজ্জাদের বুক বরাবর তাক করে আঙ্গুলটি নাড়ানোর অপেক্ষা মাত্র।
(চলবে)

১ম পর্ব

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *