ধূম্রদের অভিযান

(পূর্ব প্রকাশের পর)
১০ম পর্ব
ড.মাহফুজ বললেন-জ্বি স্যার, এজন্যেই নাস্তিক বিজ্ঞানীরা কথা বলার সুযোগ পায়। তারা অভিযোগ করে বলে-বিজ্ঞান যে বিষয় আবিষ্কার করে ফেলে মুসলিম বিজ্ঞানীরা বলে বেড়ায় সেটা কোরআনেই আছে। তারা কোরআন শরীফ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে। এজন্যেই আমার বেশি ক্ষোভ হয় সেসব অদায়িত্বশীল মুসলিম বিজ্ঞানীদের উপর। কোথায় ১৫০০ বছর আগের কোরআন শরীফ আর কোথায় আজকের আবিষ্কৃত বিজ্ঞান! কোরআনের ৮০ ভাগ তথ্যই বিজ্ঞান আজ প্রমাণ করে ফেলেছে। একদিন আসবে ১০০ ভাগ তথ্যই প্রমাণ করতে পারবে বিজ্ঞানীরা। ড.আশরাফ এক নি:শ্বাসে কথাটি বলে ফেললেন। তার কথার রেশ ধরে ড.মাহফুজ বললেন-
বিজ্ঞানকে কোরআনের তত্ত্বের মাপকাঠি কেউ ভাবলে সে আর মুসলমান থাকবে না। কেননা বিজ্ঞান মানবীয় সিদ্ধান্ত। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে সামান্যতম জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন সেই জ্ঞান বুদ্ধি বা বিবেকের ফসল হলো- বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের তত্ত্ব-তথ্য নিত্য আপডেট হতে থাকে। তাই বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তে ভুল থাকতে পারে এবং সিদ্ধান্তগুলোর পরিবর্তন-পরিমার্জন হতে পারে। আর কোরআন শরীফ হলো অলৌকিক গ্রন্থ ও স্বয়ং সমস্তকিছুর সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তার বাণী। এই বাণীর কোনো পরিবর্তন কখনো সম্ভব হবে না। অতি সত্য একথাটা বুঝতে তাদের এতো বিপত্তি হয় কেন ঠিক বুঝতে পারি না! ড.আশরাফ বলেন-শুধু কি তাই মাহফুজ সাহেব, তারা তাদের কথার সমর্থনে কোরআন থেকে যুক্তিও দাঁড় করেছে। তারা বলে-আল্লাহ এরশাদ করেন-আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী বস্তুুপুঞ্জকে খেলার ছলে সৃষ্টি করি নাই এবং অন্য আয়াত অর্থাৎ আকাশ ও ভূমণ্ডলের মধ্যস্তিত বস্তপুঞ্জের মধ্যে জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের জন্য নিদর্শন রয়েছে। উক্ত আয়াতদ্বয়ে আকাশকে অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি বরং পৃথিবীর কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে আর সবকিছুর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে স্পষ্ট বলা হলেও মহাকাশের সাতটি উপকারী স্তরই যে কোরআনে বর্ণিত সাত আকাশ বা স্তর তা বলার পক্ষে কখনো প্রমাণ হতে পারে না। তাতো অবশ্যই স্যার। তারা যদি বলতো-কোরআনে বর্ণিত সাত আকাশের মধ্যে প্রথম আকাশের সাতটি স্তর এগুলো তাহলে কোনো অসঙ্গতি দেখা দিতো না। কেননা আমরা জানি, আকাশের স্তর বিষয়ে কোরআনের একটি আয়াত রয়েছে এভাবে-নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী আকাশকে তারকারাজির দ্বারা সুশোভিত করেছি। এই আয়াতে পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশ বা প্রথম স্তরের আকাশের কথা বলা হয়েছে। আর প্রথম আকাশের একেকটি তারকা এমনও রয়েছে যার আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ১০০ কোটি বছর। সুতরাং সহজেই অনুমেয় প্রথম আকাশের তারকারাজির কক্ষপথ বা অবস্থানস্থল কতোটুকু মহা প্রশস্ত যা মানবীয় জ্ঞানের বাইরে। ড.মাহফুজ একথাটি বলে না থেমেই আবার বলতে শুরু করলেন-
বিজ্ঞানের এতো অগ্রগতি হয়েছে যে সাধারণ মানুষদের তাক লাগিয়ে দেয়। তাসত্ত্বেও বিশ্বনবী সা.-এর মিরাজকে আজও মেনে নিচ্ছে না অমুসলিম বিজ্ঞানীগণ। কোরআন হাদীসের অসংখ্য তথ্য ও তত্ত্ব বিজ্ঞানসম্মত এটা তারা স্বীকার করলেও মিরাজকে মেনে নিতে তাদের আপত্তি কোথায় ঠিক বুঝতে পারি না স্যার? ড.আশরাফ বললেন-এটা তাদের বিশ্বাসের দুর্বলতা। তারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস রাখলে ঠিকই মেনে নিতো। তবে একটি বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, অনেক অমুসলিম বিজ্ঞানী ভেতরে ভেতরে মিরাজের ঘটনাকে ঠিকই বিশ্বাস করে কিন্তু এটা মুখে স্বীকার করছে না। কারণ এটা স্বীকার করলে তাদের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে দুনিয়াবি ফায়দা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। তাই এই ঝুকি তারা নিতে চায় না। তবে আমাদের ইসলামী মনিষীগণ মিরাজের ঘটনাকে বিজ্ঞানের আলোকে উপস্থাপন করতে হয়তো পুরোপুরি সক্ষম হচ্ছেন না। কোনো না কোনো ফাঁক থেকে যাচ্ছে তাদের বর্ণনায়। ড.মাহফুজ বললেন। কিন্তু সাথে সাথে তার একথার প্রতিবাদ করে ড.আশরাফ বললেন-এটা কখনোই এরকম নয়। বর্ণনায় কোনো ফাঁক রাখছেন না কেউ। যেমন তারা মিরাজের ঘটনাকে বিজ্ঞানের আলোকে বর্ণনা করেন নিম্নরূপভাবে-

আল কুরআন জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুপম বিশ্বকোষ। চাই তা পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান হোক আর মহাকাশ বিজ্ঞানই হোক। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মহাকাশ অভিযান শুরু হয় ১৯৫৭ সালে। এ অভিযানে প্রথম সফলতা আসে ১৯৬৯ সালের ২১ জুলাই। প্রায় ২ লাখ ৩৯ হাজার মাইল পথ ভ্রমণ শেষে (এপোলো-১১ নভোযানে) নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে প্রথম পা রাখেন। অথচ আজ থেকে ১৫০০ বছর আগেই বিশ্বনবী সা.-এর মিরাজ বা মহাকাশ অভিযানের কথা আল কুরআনে ঘোষিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে (মুহাম্মদকে) ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখার জন্য, তিনিই সর্বশ্রোতা; সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনি ইসরাইল-১)। মহান আল্লাহ অনত্র এরশাদ করেন-নিশ্চয় সে তাকে আরেকবার দেখেছিল, সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে, যার কাছে অবস্থিত বসবাসের জান্নাত। যখন বৃক্ষটি দ্বারা আচ্ছন্ন হওয়ার, তদ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম হয় নি এবং সীমালঙ্ঘনও করেনি। নিশ্চয় সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছেন। (সূরা নাজম আয়াত-১৩-১৮)। অতঃপর তিনি তাঁর নিকটবর্তী হলেন, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাঁদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল অথবা তারও কম। তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন। (সূরা নাজম, আয়াত-৮-১০)। ‘এভাবে আমি ইব্রাহিমকে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর পরিচালনা ব্যবস্থা দেখাই, যাতে সে (ইব্রাহিম) নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। (সূরা আনআম-৭৫)। এখানে সূরা বনি ইসরাইলে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর মক্কা (মসজিদুল হারাম) থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস (মসজিদুল আকসা) পর্যন্ত এবং সূরা নাজমে ঊর্ধ্বাকাশে উত্তোলন ও ভ্রমণের অর্থাৎ মহাকাশ ভ্রমণের কথা উল্লেখ রয়েছে। সূরা আনআমেও হজরত ইব্রাহিম আ.-এর ক্ষেত্রে অনুরূপ মহাকাশ ভ্রমণের বিষয় ঘোষিত হয়েছে। বিজ্ঞান আজ যে জ্ঞানের কাছে মাথা নত করেছে অবশ্যই তা মানবীয় জ্ঞান নয় বরং ওহির জ্ঞান এবং মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান। আল কুরআনে কল্পনা বা মিথ্যার কোনো স্থান নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে মিরাজুন্নবী সা.-কে কাল্পনিক বলার প্রশ্নই আসে না। এ কথা সন্দেহাতীতভাবে সত্য, বিশ্বনবী সাঃ-এর মিরাজ রূহানিভাবে, নিদ্রাযোগে হয়নি, তা হয়েছে সজ্ঞানে সশরীরে এবং জাগ্রতাবস্থায়। যেমন হযরত মুসা আঃ-এর দলবলসহ হেঁটে নীল নদী পার হওয়া। হযরত ইব্রাহিম আঃ-এর নমরুদের বিশাল অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি পাওয়া, হযরত ঈসা আ.-এর আকাশে আরোহণ এবং তাঁর আবার দুনিয়াতে আগমন হওয়ার কথা। বিবি মরিয়মের স্বামী ছাড়া পুত্রসন্তান লাভ। এসবই সত্য এবং বাস্তব ঘটনা। তদ্রূপ মিরাজও। মিরাজ অর্থ সিঁড়ি বা সোপান। মিরাজ শব্দটি আরবি ‘উরুজ’ শব্দ থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ উপরে আরোহণ করা। হযরত মুহাম্মদ সা.-এর বোরাকযোগে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা ভ্রমণ এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে এবং ‘রফরফ’যোগে ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণের মাধ্যমে সৃষ্টির অনন্ত রহস্য ও অলৌকিক নিদর্শনাবলি অবলোকন, আল্লাহপাকের সান্নিধ্য অর্জন এবং উভয়ের বাক্যালাপকে মূলত মিরাজ বলা হয়। অধিকাংশ আলেম ও গবেষকের মতে একাদশ বা দ্বাদশ নববী সালের ২৭ রজব তারিখ রাতের এক শুভ মুহূর্তে মিরাজের ঘটনা ঘটে। আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করলে কোনোরূপ অবলম্বন ছাড়াই মুহূর্তের মধ্যে তাঁর প্রিয় বন্ধুকে সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করাতে পারতেন, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছুই ছিল না। তবুও ‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’যোগে তাঁকে ভ্রমণ করিয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’ কী জাতীয় বাহন? ‘বোরাক’ আরবি ‘বরকুন’ ধাতু হতে নির্গত, যার অর্থ বিদ্যুৎ (ঊষবপঃৎরপরঃু)। এটা নূরের তৈরি জান্নাতি বাহন। বিদ্যুতের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন। আলোর গতি অপেক্ষাও এর গতি অনেক বেশি। ‘রফরফ’-এর আভিধানিক অর্থ বিছানা, নরম তুলতুলে, সবুজ। সূর্যরশ্মির চেয়েও ক্ষিপ্র তার গতিবেগ, এ কুদরতি বাহন দু’টির গতি আলোর গতির চেয়েও কল্পনাতীত দ্রুত হওয়ার কারণে অতি অল্প সময়ের মধ্যে রাসূল সা.-এর সপ্তাকাশ ভ্রমণ সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, আলোর গতি প্রতি সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। একটা বিষয় এখানে সবার মাথায়ই প্রশ্ন জাগবে। আর তা হলো, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয়তম বন্ধুকে কোনো বাহন ব্যতীতই সপ্ত আসমান পরিভ্রমণ করাতে পারতেন কিন্তু ‘বোরাক’ ও ‘রফরফ’ ব্যবহার করেছেন কেন? এর তিনটি কারণ হতে পারে।
প্রথমতঃ বাহনে করে অতি যতেœ নেয়ায় মর্যাদাবান রাসূল সা.-এর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ জাগতিক অর্থে মিরাজকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। তৃতীয়তঃ এ বিশিষ্ট বাহনের ব্যবস্থা দ্বারা আল্লাহপাক মানুষকে বুঝাতে চেয়েছেন নবীজি সা.-এর মিরাজ স্বজ্ঞানে-স্বশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় সংঘটিত হয়েছে। তাফসীরবিদগণ নবীজি সা.-এর মিরাজ গমনকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত অংশকে ইসরা বা রাতের সফর এবং ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণকে ‘মিরাজ’ বলেছেন। তা ছাড়া ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণকে আশ্চর্যজনক ঘটনা মনে করে কেউ কেউ হয়তো রাসূল সা.-কে উপাস্য বলে সন্দেহ করতে পারে, তাই ‘বিআবদিহি বা তার বান্দা’ শব্দের সাথে আল্লাহ নিজেকে পুরো সম্পৃক্ত করেছেন এবং রাসূল সা.-যে আল্লাহর একান্ত প্রিয়তম ও নিকটতম বান্দা তা স্পষ্ট করে বুঝিয়েছেন। রাতের সফরকে ‘ইসরা’ বলা হয়। সে সত্ত্বেও ‘লাইলান বা রাতের অংশ’ শব্দ দিয়ে বুঝিয়েছেন নবীজি সা.-এর মিরাজ সারারাত ধরে হয়নি বরং তা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে এটা বুঝাতে। বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি থাকায় শূন্য মণ্ডলের যেকোনো স্থূল বস্তুকে সে নিচের দিকে টেনে নামায়। কোনো স্থূলদেহী মানুষের দ্বারা মহাকাশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দোহাই দিয়ে তারা মিরাজকে অস্বীকার করেছেন, বিরুদ্ধবাদীদের সে নীতিকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শূন্যে অবস্থিত যেকোনো স্থূল বস্তুকে পৃথিবী যে সব সময় সমানভাবে আকর্ষণ করতে পারে না আজ তা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মতে, প্রত্যেক গ্রহেরই নিজস্ব আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। সূর্য ও পৃথিবী একে অন্যকে টেনে রাখছে। এ টানাটানির ফলে উভয়ের মাঝখানে এমন একটা স্থান আছে যেখানে কোনো আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই। যার ফলে পৃথিবীর কোনো বস্তু যদি সেই সীমানায় পৌঁছায় বা পার হয়ে সূর্যের সীমানায় যেতে পারে, তাহলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। গতিবিজ্ঞানের (উুহধসরপং) মতে, পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুকে প্রতি সেকেন্ডে ৬.৯০ অর্থাৎ সাত মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুড়ে দেয়া হলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। আবার পৃথিবী থেকে কোনো বস্তু যতই ওপরে উঠবে ততই তার ওজন কমবে। যার ফলে অগ্রগতি ক্রমেই সহজ হয়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানীগণ বলেন, ‘পৃথিবী থেকে কোনো বস্তুর দূরত্ব যতই বাড়ে, ততই তার ওজন কমে, পৃথিবীর এক পাউন্ড ওজনের কোনো বস্তু ১২ হাজার মাইল ঊর্ধ্বে মাত্র এক আউন্স হয়ে যায়। এ থেকে বলা যায়, পৃথিবী থেকে যে যত ঊর্ধ্বে গমন করবে, তার ততই অগ্রগতি হবে। ’ বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছেন, ঘণ্টায় ২৫ হাজার মাইল বেগে ঊর্ধ্বলোকে ছুটতে পারলে পৃথিবী থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। একেই মুক্তিগতি (ঊংপধঢ়ব াবষড়পরঃু) বলে। গতি বিজ্ঞানের এসব নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ চাঁদে যেতে পেরেছে এবং মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। তাই মাধ্যাকর্ষের যুক্তি দিয়ে মিরাজের সত্যকে কেউ উড়িয়ে দিতে পারে না। বিরুদ্ধবাদীদের মতে, রাসূল সা.-এর দেহ জড়দেহ, তাই তা নভোলোকে পৌঁছতে পারে না। আল্লাহর সৃষ্টিজগতে দেখা যায়, বুনিয়াদ এক হলেও প্রতিটি বস্তুরই ভিন্ন ভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন কয়লা থেকে হীরক প্রস্তুত হয়। উভয়ই পদার্থ। কিন্তু তাই বলে এ দু’টি পদার্থ এক নয়। তা ছাড়া সব পদার্থের সবখানেই ধর্ম এক নয়। যেমন কাচ জড় পদার্থ, বাধা দেয়া তার ধর্ম। এ জন্য একটা কাঠ ভেদ করে তার মধ্য দিয়ে আলোক রশ্মি যেতে পারে না। কিন্তু কাচ জড় পদার্থ, তার বুকের ভেতর ভেদ করে আলোক রশ্মি চলে যায়, বাধা দিতে পারে না। আবার দেখা যায়, ‘পানি’র কঠিন, তরল ও বায়বীয় তিন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন তিনটি রূপ, একটি থেকে অন্যটি ভিন্ন। এমন অনেক অস্বচ্ছ পদার্থ রয়েছে যার ভেতরে সাধারণ আলো প্রবেশ করতে পারে না কিন্তু রঞ্জন রশ্মি বা এক্সরে তা ভেদ করে চলে যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, আমরা যে পদার্থকে দেখি তা-ই যে তার একমাত্র সত্য রূপ, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আল্লাহ পাক নবীজিকে অলৌকিকভাবে এই বিশাল পথ অতিক্রম করান। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সন্দেহবাদীদের ধারণা এত অল্প সময়ের মধ্যে রাসূল সা. বাইতুল মুকাদ্দাস হয়ে সাত আসমানের ওপর সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে আল্লাহর সাথে কথাবার্তা বলে আবার মক্কায় ফিরে এলেন, তা কী করে সম্ভব? মূলত আল্লাহর সময়ের সাথে পৃথিবীর সময়ের মিল হবে না। বিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের ঘড়ি অন্য গ্রহে অচল। এ বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীদের মত, স্বভাবের প্রকৃত সময় (ঞৎঁব ঞরসব ড়ভ ঘধঃঁৎব) সম্পর্কে আজো আমরা জানি না। বিজ্ঞানীরা জানান, আলোর গতির যত কাছে যাওয়া যায়, ততই সময় শ্লথ হয়ে আসে। আলোর গতি অপেক্ষা বেশি দ্রুত গতিতে গেলে সময় উল্টো দিকে বয়। মিরাজের বেলায়ও তা হয়েছিল। রাসূল সা.-এর বাহনের গতি আলোর গতি অপেক্ষা বেশি ছিল। তাই মিরাজ থেকে ফিরে এসে বিছানা উষ্ণ পাওয়ার বিষয়টিও সম্পূর্ণ সত্য।
বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ভাষায় স্ট্যান্ডার্ড টাইম বলে কোনো টাইম নেই, সব টাইমই লোকাল অর্থাৎ স্থানীয়ভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহর কাছে স্থান, কাল, গতি ও সময়ের কোনো বন্ধন নেই। তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন মুহূর্তের মধ্যেই তা ঘটিয়ে থাকেন। তাঁর রহস্য সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান অক্ষম। আধুনিক বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে যাওয়ার আগে বিশেষ বাহন প্রস্তুত করেন। নভোচারীদের দেহ খুব সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে উপযুক্ততা যাচাই-বাছাই করে থাকেন। বিশেষ পোষাক পরিধান ও বিশেষ খাবার গ্রহণ করেন। মিরাজে গমনের আগে বা বোরাক এবং রফরফ নামক বিশেষ বাহনে আরোহণের আগে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর নির্দেশে জিবরাঈল আঃ রাসূল সা.-এর বক্ষ স্বযতেœ বিদীর্ণপূর্বক জড়ধর্মী স্বভাব দূর করে আলোর স্বভাব স্থাপন করেন। গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে টিকে থাকার জন্য কুদরতি ওষুধ তাঁর শরীরে প্রয়োগ করেন। হৃদপিণ্ডের মধ্যেও বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, যাতে মহাকাশ গমনের সময় তার মধ্যে কোনো প্রকার ক্লান্তি না আসে, মহাকাশের নিদর্শনাবলি দেখে কোনো ভয়ভীতি সঞ্চার না হয় এবং আল্লাহর সাক্ষাত লাভের সময় যেন সৃষ্টি না হয় কোনো প্রকার বাধাবিপত্তি। এক কথায় ঊর্ধ্বজগতের বিভিন্ন কুদরত প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা লাভে তাঁকে সক্ষম করে নেন আল্লাহপাক। তাই আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে মিরাজকে অবৈজ্ঞানিক রূহানিক বা কাল্পনিক বলার প্রশ্নই আসে না। নবীজি সা.-এর মিরাজ হয়েছিল স্বশরীরে, স্বজ্ঞানে ও জাগ্রতাবস্থায়।
(৯ম পর্ব)

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *