ওয়াদা

রমজান আলী বলল, তুমি চুপ করো ভাই আল্লাহর মর্জি থাকলে তোমার আশা পূর্ণ হবে। তুমি আমার দোস্ত। তোমার ইচ্ছা পুরণে কিছু করনীয় থাকলে আমি তা করব। আগে তুমি সুস্থ হয়ে উঠো।
রুস্তুম আলী বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। আচ্ছা ভাই আসাদকে কি খবর দিয়েছ?
রমজান আলী বলল, হ্যাঁ, তাকে ফোন করা হয়েছে এসে পড়বে। তুমি চুপচাপ ঘুমাও আর কথা বলো না।
সকাল এগারোটার দিকে রুস্তুম আলী আবার সংজ্ঞা হারালেন। ডাক্তারদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি ইহলীলা সংবরণ করলেন। আসাদ যখন চট্টগ্রাম থেকে হসপিটালে এসেছিল তখন বাবর লাশ বাড়িতে নেবার উদ্যোগ চলছিল।
ছ’ মাস পরের কথা আসাদ এম. এ. ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে ফিরে এসেছে। সে এখন মিলের কাজ দেখাশুনাও করছে। প্রথম যেদিন সে রুহুল আমীনের কক্ষে প্রবেশ করলো। দেখতে পেলো, অফিসের দেয়ালে সাদা কাগজে লেখা :
(ক) শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকাবার আগে মজুরী পরিশোধ কর।
(খ) যে অধীনস্থদের উপর অত্যাচার করে সে মোমেন নয়।
(গ) হালাল রুজি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ কর।
(ঘ) কাজে ফাঁকি দেওয়া মানে নিজেকেই ফাঁকি দেওয়া।
(ঙ) মিথ্যা সকল পাপের প্রসূতি। সুতরাং মিথ্যাকে পরিহার কর।
আসাদ বলেছিল: তুইতো দেখছি তোর রুমটাকে একটা মাদ্রাসায় পরিণত করে রেখেছিস।
তার মানে? … রুহুলের প্রশ্ন। দেওয়ালে কুরআন-হাদিসের বাণী টাংগিয়ে রেখেছিস, মাদ্রাসা নয়তো কি?
আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আল্লাহ রাসুলের নির্দেশ স্মরণ করতে হবে। সে কারণে চোখের সামনে টাংগিয়ে রাখা উত্তম। ভুলে যাবার সম্ভাবনা থাকে না।
ভালো, ভালো তা, এবার একটা বিয়ে সাদী করে সংসারি হয়ে গেলে কেমন হয়?
মন্দ হয় না। বয়সটাতো কম হয়নি।
কতো হলো?
তাহলে আর দেরী নয়। আজকালতো প্রায়ই পঞ্চাশ উত্তীর্ণ হলেই ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়বার সময় এসে যায়। তাহলে পাত্রী দেখবো নাকি।
আছে নাকি?
আছেইতো আমাদেরইতো দু’টো আছে। তার একটা আমাদের লায়লা না, তাকে মানাবেনা তোর সংগে। দাড়িওয়ালা ছেলে সে পছন্দ করেবে না। তাছাড়া —
তাছাড়া আবার কি?
তোর মেন্টালিটার সংগে খাপ খাবে না। তবে রমজান চাচার মেয়েটি কোয়াইট ফিট ফর ইউ। আচ্ছা এইটাই দেখা যাক। বলিস।
দ্যাখ চেষ্টা করে।
আচ্ছা তাই দেখছি।
আসাদের পাত্রী সম্পর্কে খোজ খবর করার সুযোগ আর হলোনা। তার আগেই একদিন রমজান আলী এসে জোবেদা খাতুনকে বললো : ভাবী, মৃত্যুর আগে রুস্তুম ভাইয়ের ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেছেন। আপনিও তা জানে না। এখন এ সম্পর্কে একটা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।
হ্যাঁ ভাই ছ’ মাস হলো তিনি এন্তেকাল করেছেন। আসাদের পরীক্ষাও শেষ। এখন একদিন তারিখ করা যায়। কিন্তু পর্দানসীন মেয়ে আপনার আসাদকে পছন্দ করবে কি না?
তা অবশ্যই তবে আমার মেয়ে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে বলে মনে হয় না। তবু মতামত নেবো
আর আমিও আসাদকে বলি। মনে হয় আসাদও আপত্তি করবে না।
ঠিক আছে। তবে তাড়াতাড়ি করুন। শুভ কাজে বিলম্ব করতে নেই।
আচ্ছা আজই আমি ওকে বলবো।
রমজান চলে গেলেন। ঠিক এসময় আসাদ ঘরে প্রবেশ করে বললো- চাচা কি চলে গেলেন?
-হ্যাঁ, তার সংগে আমার কিছু কথা হয়েছে: এখন তোর সংগে একটু আলাপ দরকার
কি বিষয়ে?
বিষয়টা তোর বিয়ের।
বিয়ে? তা এতো তাড়াতাড়ি কেন? যাক না আরও কিছুদিন।
না শীঘ্র করে ফেলা ভালো। তাছাড়া রমজান ভাইও বল্লেন।
কি বললেন?
তিনি এখনই কাজটা সমাধান করে ফেলতে চান।
তার মানে?
মানে নাসরিনের সংগে তোর বিয়ে হবে।
কেন অসম্ভব?
ঐ বোরখা-ওয়ালি মেয়ে আমার পছন্দ নয়। তাছাড়া ওর জন্য পাত্র আমি ঠিক করে ফেলেছি।
কোথায় পাত্র ঠিক করলি।
আমাদের ম্যানেজার রুহুল আমীন। সে বিয়েতে রাজী আছে।
তা হয় না।
কেন হয় না।
তোর আব্বা মারা যাবার আগে রমজান ভাইকে বলে ওয়াদাবদ্ধ করে গেছেন। তাই তিনি এ সম্বন্ধই করতে চান।
আগে তো বলোনি কখন।
দরকার হয়নি, বলিনি। এখন বললাম।
কিন্তু আমি যে কথা রাখতে পারবো না, মা
কি বল্লি? যে বাপ তোকে তিলতিল করে মানুষ করেছে, তার অন্তিম ইচ্ছাপূরণ করবি না? তাই যদি হয় তাহলে তোর সংগে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না।
রাগ করবে কেন মা? আমার দিকটা একটু ভেবে দেখো।
না, আমি কারো জন্য ভাববোনা। আমার ঐ এক কথা মরা মানুষের অন্তিম ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই। তুই যদি ইচ্ছামতো কিছু করে ফেলিস তবে সেদিন যেন তুই আমার মরা মুখ দেখতে পাস। আল্লাহর কাছে তাই কামনা করি।
এমন সময় লায়লা এখানে এসে উপস্থিত হলো। দূর থেকে সে এসব কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিল। আসাদকে লক্ষ্য করে সে বল্লো: তুই আপত্তি করিসনে ভাইয়া। আব্বা- আজ বেঁচে থাকলে তাকে বলে তার মত পাল্টানো যেতো। তিনি বেঁচে নেই। আমরা তার আদরের সন্তান। বাপ-মার কারণেই আমরা দুনিয়ায় এসেছি। তাদের খুশী করা আমাদের কর্তব্য। মা- বাবাকে বেজার করলে আল্লাহ বেজার হন। তাতে ভালাই হয় না।
আসাদ এবার কথা বললো মায়ের প্রতি: মা, তুমি যা বলেছো, তাই হবে। আমি রাজী আছি।
আসাদের এ- উক্তিতে জোবেদা খাতুন খুশি হলেন। তারপর তিনি আসাদকে লক্ষ্য করে বললেন: আল্লাহ তোর সুমতি দিলেন, এজন্য তার দরবারে হাজার শোকর। এবার তাহলে আমি কাজে লেগে যাই?
হ্যাঁ যা- যা করতে হয় যাও। আব্বা যখন বেঁচে নেই সব দিকতো তোমাকেই দেখতে হবে।
কথা হচ্ছিল নাসরিনদের বাড়ীতে। জামিলা বল্লেন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে: তোর বিয়ের কথা হচ্ছে আসাদকে তোর পছন্দ হয় কি না?
কথা যখন হচ্ছেই, তখন আর জিজ্ঞেস করছো কেন? … নাসরিনের বিরক্তি পূর্ণ উত্তর।
তবুতো জিজ্ঞেস করতে হয়। এটাতো আর আমাদের জামানা নয় যে, বাপ- মা যা ঠিক করে, মেয়েরা তাই মেনে নেয়।
তাই বুঝি জিজ্ঞেসা করছো? এখন আমি যদি অসম্মতি জানাই, তাহলে কি করবে?
অসম্মতি কেন? আসাদ উচ্চশিক্ষিত ছেলে। তাছাড়া প্রতিবেশী। এক সাথে বাসা। আত্মীয়ের মতোই। আমার তো মনে হয়Ñ এ- সম্বন্ধ একশোবার করা উচিত।
আর আমার তো মনে হয় হাজার বার না করা উচিত।
কেন?
আমার সংগে আসাদের স্বভাবের মিল নেই। তাছাড়া
তাছাড়া আবার কি?
আমি একজনকে কথা দিয়েছি।
কথা দিয়েছিস? কাকে
রুহুল আমীনকে … একটু ইতস্ততঃ করার পর বলে ফেললো।
কিন্তু এদিকে তোর আব্বা একজনকে কথা দিয়ে রেখেছে।
কথা দেবার আগে আমার মতামত যাচাই করা উচিত ছিল।
সুযোগ ছিল না। কথা দেওয়া হয়েছে রুস্তুম ভাইকে তার মৃত্যুশয্যয়। সুতরাং ওয়াদা খেলাপ করা যাবে না। আর, ওয়াদা দিলে রক্ষা করা ওয়াজেব হয়ে যায়। ওয়াদা বর খেলাপকারীতো শরীয়তের দৃষ্টিতে মোনাফেক। তোর আব্বাকে কি তুই মোনাফেক বানাতে চাস?
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর নাসরিন বল্লো: সমস্যাটা বড়ই জটিল। আব্বাকে যেমন ওয়াদা ভংগকারী বানানো আমার পক্ষে পাপের তেমনি আমার নিজের ওয়াদা ভংগ করা ও পাপের। এখন আমি কোনটা করি?
পিতা জন্মদাতা তাকে রক্ষা করা আগে দরকার। তবে রুহুল আমীনকে বলে ওয়াদা মুক্ত হতে চেষ্টা করা যেতে পারে। আল্লাহ সব জানেন, সব বোঝেন, উভয় সংকটে পড়লে পথতো একটা বের করতেই হবে। তবে যেটা সব চাইতে বেশী জরুর, সেটাকে নিয়েই আগে ভাবতে হবে।
ঠিক আছে। আব্বার যাতে ওয়াদা রক্ষা হয় আমি সেই চেষ্টা করবো। তবে এই মূহুর্তে আমাকে রুহুল আমীন এবং আসাদের সংগে বোঝাপড়া করে নিতে হবে।
বেশতো। তাই করিস।
এ দিনের আলাপ এই পর্যন্তই।
আসাদকে সংবাদ দিয়ে আনা হলো রমজান মিয়ার বাড়িতে। আসাদকে বসতে বলে জামিলা ভিতরে চলে গেলেন। নাসরিন প্রবেশ করলো কক্ষে, তার দেহ বোরখায় আবৃত। সে এসে আসাদকে লক্ষ্য করে বল্লো: আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।
তাই নাকি? কোনো জরুরী আলাপের দরকার নাকি?
হ্যাঁ। এদিকে যে সব কথা-বার্তা চলছে, নিশ্চয় আপনি জানেন।
জানি কিছু কিছু।
শুনুন সত্যকে গোপন করা পাপ। আর কাউকে ধোকা দেওয়াও পাপ। তাই সত্যকে লুকাবোনা।
(চলবে)

পরবর্তী অংশ পড়ুন এখান থেকে

Comments

comments

About

Check Also

মুবাহাসা (২য় পর্ব)

(পূর্ব প্রকাশের পর)মুসাল্লা উঠিয়ে নাওইমাম আযম আবু হানিফা র.-এর আদত মুবারক ছিল যখন তিনি শাগরিদকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *