শীতের পিঠা তৈরি ও বিক্রিতে নারীরা এগিয়ে

শাল জড়িয়ে কানটুপি মাঙ্কিটুপি পেঁচিয়ে শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার মাঝেও আনন্দ আছে শীতের পিঠায়। শীতের এই দিনে শীতের পিঠা খাওয়া হবে না, তা কি করে হয়। বসন্ত এলে আমরা বলি-‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক এখন বসন্ত’। তেমন করে বলতে হয়-‘শীত আসুক আর না আসুক, শীতের পিঠা খাওয়া চলুক’। আমরা যারা শহরে থাকি গ্রামের ধান উঠা, ধান মাড়ার খবর কয়জন রাখি। গ্রামে চলছে নবান্নের উৎসব, এখন শহরেও পালিত হচ্ছে নবান্নের আয়োজন। সেই সাথে শীতের পিঠার আয়োজন একটুও পিছিয়ে নেই। সেই পাঁচতারা হোটেল বলি আর অলিগলির এক ছাউনি কিংবা খোলা আকাশের নিচেই বলি। রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লা, ভি আই পি রাস্তার পাশে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, মার্কেটের সামনে, খোলা আকাশের নিচে, ভ্যানে চলছে শীতের পিঠা বিক্রি। নারী-পুরুষ উভয়ে এই পেশার সাথে থাকলেও এগিয়ে আছে আমাদের নারীরা। প্রতিটি পিঠার দোকানে লম্বা লাইন। খোঁজ করলে এমন লোক পাওয়া যাবে না, যিনি শীতের পিঠা খাননি বা খাচ্ছেন না। পিঠাঘর গুলোতেও খুবই উৎসব উৎসব ভাব। কিছু দোকান আছে সারাদিন চলছে পিঠা বানানো আর বিক্রি। কিছু দোকার ক্ষণস্থায়ী, এরা সন্ধ্যার আগে আগেই বসে। তৈরি করা আটা শেষ না হওয়া অবধি চলতে থাকে বানানো আর বিক্রি।
তেজগাঁও এর ফার্মগেট এলাকায় বসবাস, আশেপাশে অনেক অনেক পিঠার দোকান। প্রায়ই পিঠা কিনে নিয়ে আসি, সবাই একত্রে পিঠা খেয়ে তৃপ্তি মিটাই। সেদিন সাভারে মায়ের বাসায় যাই পরিবারের সবাই, ভাই ও আসে ওর পরিবার নিয়ে। আগে মা নিজেই পিঠা করে খাওয়াতেন আমাদের এখন মা এর শরীর ভাল না, বয়স হয়েছে। তাই পিঠা খাওয়ার জন্যে ছোট ছোট দোকানই বেশ। চাঁদনী রাত, সন্ধ্যার পর বের হই পিঠার খোঁজে।
সাভার রেডিও কলোনী বাস স্টেন্ড থেকে জাহাঙ্গীরনগর হাউজিং সোসাইটি যাবার পথে ডানপাশে ছোট্ট একটা ছাউনি মাথার উপর। চারপাশে চারটি মোটা বাঁশের খুঁটি। ভেতরে মাটির চুলার আগুন দেখা যায়। চিতই আর ভাপা দুই পিঠা বানাচ্ছেন। ছাউনির পাশে দুইটি কাঠের বেঞ্চি, আর দুটি প্লাস্টিকের চেয়ার। দুই চেয়ারে দুজন পিঠা ভক্ত বসে খাচ্ছেন। তিনটি মাটির চুলা, দুটিতে চিতই পিঠা একটাতে ভাপা পিঠা। ভাপা পিঠার চুলা একটা হলেও একসাথে চারটি পিঠা দেয়া যায়। পিঠায় ভাপ দেয়ার খাচটা এমনিই। সবাইকে পিঠা খেতে দিচ্ছে ২০/২২ বছর বয়সি আকলিমা। পানির কলস রেখে যায় এক মধ্যবয়সী নারী। পাশে বসা আরো দুইজন পুরুষ। দশটা ভাপা আর দশটা চিতই প্যাকেট করার কথা বলে গল্প শুরু করি। আকলিমা জানায়-
‘পরিবারের সবাই মিলে শীতের সময় পিঠা বানানো ব্যবসা করি, মা, বাবা, আমি আর আমার বর। প্রতিদিন নয় থেকে বার কেজি চাল গুড়া করান মেশিনে। শুক্রবার করে পিঠা একটু কম বিক্রি হয়, তাই সেদিন নয় কেজি চাল ভাঙ্গানো হয়। অন্যদিন বার কেজি করে। নারিকেল আর গুড় দিয়ে ভাপা পিঠা। শুটকি ভর্তা আর সরিষার ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাওয়া হয়। চিতই পিঠার দাম পাঁচ টাকা, ভাপা পিঠার দাম দশ টাকা।’
সামনে এক কেইচ ডিমও রাখা। ডিম কি করে জিজ্ঞেস করায় বলেন, ‘কেউ কেউ চিতই পিঠার মাঝে একটা ডিম দিয়ে খান। আর ডিম দিয়ে চিতই পিঠা খেলে পরেনো টাকা’। কেউ খাচ্ছেন বসে, কেউ নিয়ে যাচ্ছেন বাসায়। তৈরি হতে দেরি দেখে কেউ ফিরেও যাচ্ছেন।


ফার্মগেট থেকে সরকারি বিজ্ঞান স্কুল ও কলেজ রোডের দিকে যেতেই রাস্তার ডানপাশে চোখে পড়বে বিশাল এক পিঠার দোকান। প্রায় এখান থেকে পিঠা নিয়ে আসি। দাঁড়িয়ে ও খাই, দাঁড়িয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই দোকান মালিক খালা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেন, ‘খালা ভাল আছেন, মেয়েকে আনতে যাচ্ছেন, ফেরার পথে পিঠা খেয়ে যাবেন।’
এ দোকান খোলা আকাশের নিচে। ৬ টা চুলা লম্বা লাইনে, এমন চুলা অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়। পাঁচটি চুলায় হচ্ছে চিতই পিঠা, একটায় তেল পিঠা। সামনে সাজানো ১৫/১৬ পদের ভর্তা। সব বাটিতে ছোট চামচ দেয়া। পিরিচে পেপার দিয়ে পিঠা ভক্তদের হাতে দেন, উনারা পছন্দের ভর্তা দিয়ে শুরু করেন খাওয়া। কেউ চিতই কেউ তেল পিঠা। তেল পিঠা কড়াইতে দেয় খালার এক ছেলে। এক ছেলে প্যাকেট করে যারা বাসায় নিবে তাদের গুলো, আর টাকা হিসাব করে নেয়। তাদের পাশেই ছোট দোকানে ভাপা পিঠা বানায় খালার আরেক ছেলে। খালার স্বামী আয়োজনে এদিক ওদিক, এটা সেটা এনে দেয়া এসব কাজে আছে। মেইন দায়িত্বে খালা নিজেই। পুরো পরিবার নিয়ে উনার পিঠার ব্যবসা। প্রায় সারাবছর এই ব্যবসা চলে উনাদের। অনেক গণমাধ্যম কর্মী আসেন ছবি তুলতে, খালার সাথে কথা বলতে। কেউ কেউ একসাথে ২০/৩০/ ৪০/ ৫০ পিঠাও নিয়ে যায়। খালা বলেন-
‘অনেকে দুধে চিতই খাওয়ার জন্যেও পিঠা নিয়ে যান। বেশ ভাল হয় এই পিঠা খেজুর গুড় আর দুধে ভিজাইলে’।
পূর্ব নাখালপাড়া কমিউনিটি সেন্টারের কাছে পিঠার দোকান নিয়ে বসেছেন আনোয়ারা খালা, জয়নব খালা আর শিউলি খালা। একই সারিতে বসতে দেখে একটু অবাক হয়েছি। কিন্তু উনারা মোটেও চিন্তিত নন এই নিয়ে। তারা তিনজনেই বাসা বাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করেন। কাজ শেষে শীতের দিনে পিঠার ব্যবসা করে। দারুন একটা মিল উনাদের, তিনপদের পিঠা এখানে তৈরি হলেও উনারা একেকজনে দুই পদের পিঠা তৈরি করেন। ভাপা, চিতই আর তেল পিঠা। সমান তালে বানাচ্ছেন তিনজনেই, বিক্রিও হচ্ছে। কেউ খাচ্ছেন কেউ নিয়ে যাচ্ছেন। আশেপাশের দোকান মালিক কর্মচারীরা সন্ধ্যার পর এই পিঠাই নাস্তা করেন। বাসা বাড়ি থেকে অনেকে এসে নিয়ে যান। অনেকে অতিথি আপ্যায়ন করেন এই পিঠা দিয়ে। পিঠাঘরের পিঠার দামের চেয়ে এগুলো সস্তা, আর সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালে।
জয়নব খালা চিতই বানাচ্ছেন আর একটা বড় বক্সে রাখছেন, জিজ্ঞেস করায় বললেন-‘একজনে ৫০ পিঠার অর্ডার দিয়েছে কালকেই। ঘন্টাখানেক পর আসবে নিতে। উনারা দুধে ভিজাবেন, তাই একটু মোটা মোটা করে বানাচ্ছি। সাবধানে করতে হচ্ছে, এই পিঠার নিচের অংশ সাদাই থাকতে হয়, তাহলে দুধে ভিজাইলে রং ও স্বাদ ভাল থাকে’।
ফার্মগেট থেকে নাখালপাড়ার দিকে যেতেই হলিক্রস স্কুল ও বটমলী হোমস স্কুল প্রায় মুখোমুখি। বটমলী হোমস স্কুলের গেইট ভ্যানে করে পিঠা বিক্রি করে একজন লোক। ভ্যানের দিকে তাকালেই বুঝা যায় এটা পিঠা তৈরির। একপাশে চুলা, অন্য পাশে পিঠার আটা বড় পাতিলে, সামনে সেই ১৫/১৬ পদের ভর্তা। সাথে চিনিও আছে। লোকটা বলে-‘মাঝে মাঝে কেউ কেউ প্রতিযোগিতা করেও খায়। নিয়ম চালু করেছি, একজনে একসাথে ২০ টা চিতই খেতে পারলে হাফ লিটারের একটা সেভেন আফ ফ্রি।’
বেশ মজা পেলাম নিয়ম শুনে। ছোট মেয়ে এখানে মাঝে মাঝে আসে, সাথে বোতল ভরে পানি আনে, বলে-‘যে ঝাল, তবুও খেতে ভাল লাগে। বসে বসে খেতে পারলে আরো ভালো হতো’।
ভ্যানের নিচে আরেকটা তাক বসানো, সেখানে বড় বড় বক্সে ভর্তা রাখা। সব ভর্তা প্রতিদিন শেষ হয় কিনা জিজ্ঞেস করায় বলেন-‘ না, কিছু ভর্তা থেকে যায়। সেগুলো কারওয়ান বাজারের হোটেলে বিক্রি করে দিই। যা বাজারের শ্রমিকরা রাতের খাবারের সাথে খায়’।
পিঠা বলতে আমরা অনেক পিঠাকেই চিনি জানি। তবে স্বল্প বিনিয়োগে শীতের মৌসুমে চিতই, আর ভাপা পিঠার কদর একেবারেই আলাদা। বড় বড় দোকানের চেয়ে এমন ছোট ছোট ক্ষনস্থায়ী দোকানের পিঠা অনেকের পছন্দ, কারণ এদের কাছে বাসী খাবার নেই, প্রতিদিন এরা চাল ভেঙ্গে গুড়া করে, আটা করে তা দিয়ে গরম গরম পিঠা। গ্রামে না যেতে পারলেও শহরে থেকে পিঠার স্বাদ এ এক অন্য অনুভূতি। নিজেদের প্রয়োজন বাড়তি আয় তো আছেই।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *