বিশ্ব শ্রমিক দিবস, ইসলামের শ্রমনীতি : একটি পর্যালোচনা

ভূমিকা : দিবসটির প্রেক্ষাপট
শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশ্বের মানুষ ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস পালন করেন। প্রাচীন ইউরোপে রোমান পৌত্তলিকগণ ১ মে ফুলের দেবী ফ্লোরার উপাসনায় উদযাপন করত বলে জানা যায়। পরবর্তীকালে প্রাচীন ও মধ্য যুগেও ইউরোপের মানুষ বসন্তের পুনরাগমন উপলক্ষে ১ মে উদযাপন করত। ১৮৮৬ সালের ৪ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিক বিক্ষোভ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ১৮৮৯ সালে প্যারিসের সোশালিস্ট পার্টি ১ মে-কে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস’ (International Worker’s Day) হিসেবে ঘোষণা করে। ক্রমান্বয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ দিবসকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ দিনকে মে-দিবস’ও বলা হয়। মে দিবসকে সামনে রেখে এ লেখায় আমরা ইসলামের শ্রমনীতি ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্ককে অতি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই।
ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা
নিজে পরিশ্রম করে যে স্বাবলম্বীতার পরিচয় দেয়, এমন শ্রমিক ও শ্রমজীবী আল্লাহর প্রিয়, তাঁর নবীজীর (স.) প্রিয়পাত্র। বায়হাকী শরীফে বলা হযে়ছে, “শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু।” (বায়হাকী)। আল্লাহ নিজে এদের প্রশংসা করে বলেছেন, “এমন বহু লোক আছে যারা জমিনের দিকে দিকে ভ্রমণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়ায়।” (সূরা মুয্যাম্মিল :২০)। সূরা জুমুয়ায় নির্দেশনা রযে়ছে, “সালাত আদায় হযে় গেলে জমিনে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়াবে।” (৬২:১০)। রাসূলুল্লাহ (স.) এই খোঁজাখুঁজিকে সরাসরি জিহাদতুল্য ইবাদাত বলে আখ্যাযি়ত করেছেন “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(স.)-এর কাছে দিযে় গমন করে। সাহাবীগণ লোকটির শক্তি, স্বাস্থ্য ও উদ্দীপনা দেখে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এই লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) থাকত! তখন রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, যদি লোকটি তার ছোটছোট সন্তানদের জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিযে় থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তাতেই (ফী সাবীলিল্লাহ) রযে়ছে। যদি সে তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিযে় থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তাতেই রযে়ছে। যদি সে নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিযে় থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তাতেই রয়েছে।” (আত-তারগীব ২/৩৩৫; হাদীসটি সহীহ)। হাদীসে পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয়া হযে়ছে “হালাল উপার্জন মুসলিম মাত্রের ওপর অবশ্য কর্তব্য।” (আত-তারগীব ২/৩৪৫; হাদীসটি হাসান)। অন্য হাদীসে আরও খুলে বলা হয়েছে “হালাল জীবিকা অন্বেষণ ফরয ইবাদাতের পরে একটি বাড়তি ফরয।” (বায়হাকী, সূত্র: মিশকাত/২৬৬১)। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই প্রক্রিয়াকে ইসলাম এত মূল্য দিযে়ছে যে, বাহনে থাকা অবস্থায় পডে় যাওয়া চাবুক উঠিযে় আনতে অন্যের সাহায্য নেয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ, সূত্র: মিশকাত/১৭৬৪)।
নবীজী (স.) নিজে বকরী চরিয়েছেন, পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কূপ থেকে বালতিতে পানি উঠিয়েছেন, ব্যবসা করেছেন, মাটি খনন করেছেন, রান্নার কাঠ সংগ্রহ করেছেন, রান্নায় সাহায্য করেছেন, টুপি সেলাই করেছেন, জামার উকুন বাছাই করেছেন, রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তাঁরই (স.) মেযে় হযরত ফাতিমা (রা.), যিনি জান্নাতী নারীদের নেত্রী হবেন, তিনি বাঁদী বা কাজের লোকের শরণাপন্ন না হয়ে ঘরের সকল কাজ নিজেই করতেন। নিজে ঘর ঝাড়ু দিতেন। নিজ হাতে জাঁতা ঘোরাতেন; এতে তাঁর হাতে দাগ পড়ে গিয়েছিল। এমনিভাবে পানির মশক বহন করতে করতে তার বুকে দাগ বসে গিয়েছিল।
পয়গাম্বর হযরত আদম (আ.) জমি চষে শস্য ফলাতেন, নূহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রী, ইদরীস (আ.) ছিলেন দর্জি। নবী দাউদ (আ.) ছিলেন কামার, যাকারিয়া (আ.) ছিলেন তাঁতী আর মূসা (আ.) ছাগলের রাখাল। সুতরাং কাজ যত ছোটই হোক, ইসলামের দৃষ্টিতে সম্মানজনক। অন্যদিকে, পরের কাছে থেকে চেয়ে পাওয়া জিনিস (ভিক্ষা) তা যত সুন্দর ভঙ্গিরই হোক, অবাঞ্ছিত, আত্মসম্মান বিরোধী। নবীজীর (স.) ভাষায় “নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ খায়নি; আল্লাহর নবী দাউদ নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।” (বুখারী, সূত্র: মিশকাত/২৬৩৯)। আর সৎ ব্যবসায়ীকে তো সুসংবাদ শোনানোর হযে়ছে এভাবে “সত্যবাদী, বিশ্বস্ত মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতে নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের সঙ্গী হবে।” (তিরমিযী, ৩/৫১৫; হাদীসটির সনদ হাসান)। অতএব, শ্রম ও পরিশ্রম-সাপেক্ষে স্বাবলম্বী হওয়ার বিকল্প নেই। এ জন্যই সাহীবীরা সবাই ছিলেন নিজের খাদেম বা স্ব-শ্রমিক। (বুখারী, ২/৭৮৯)
ভাল শ্রমিক-এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য
আল-কুরআনের ভাষায় যোগ্য শ্রমিকের মৌলিক বৈশিষ্ট্য দু’টি এক: শক্তিশালী তথা সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য সামর্থ্যবান হওয়া, দুই: দ্বিতীয়তঃ আমানাতদারি বা বিশ্বস্ততা। সামর্থ্যবান শ্রমিক যদি বিশ্বস্ত না হয়, তাহলে মালিকের পক্ষে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকা থাকে। তাইতো মূসা (আ.) যখন মিশর থেকে মাদাযে়নে হিজরত করে ঘটনাক্রমে নবী শোয়ায়ব (আ.)-এর দরবারে নীত হন, তখন শোয়ায়ব (আ.)-এর এক মেযে় তার বাবাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন “হে পিতা! আপনি তাকে (মূসাকে আ.) মজুর নিযুক্ত করুন, কারণ আপনার মজুর হিসেবে উত্তম হবে এমন ব্যক্তিই, যে (একই সাথে) শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত।” (২৮:২৬)। হযরত সুলায়মান (আ.)-এর এক ‘কর্মচারী-জিন’-এর জবানবন্দীতেও বিষয়টি ব্যক্ত হয়েছে “সুলায়মান আরো বলল, হে আমার পারিষদবর্গ! তারা (রাণী বিলকিস ও তার সাথীরা) আমার কাছে আসার আগে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে? এক শক্তিশালী জিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার আগেই আমি ঐ সিংহাসন নিযে় আসব; আর এ ব্যাপারে আমি অবশ্যই ক্ষমতাবান ও বিশ্বস্ত।” (সূরা নামল ২৭:৩৮Ñ৩৯) ভাল মালিক-এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য আল-কুরআনের দৃষ্টিতে ভাল মালিকের মূল বৈশিষ্ট্য পাঁচটি এক: সে বুঝে-শুনে সচেতনভাবে শ্রমিক নিযে়াগ দেয়, দুই: পারিশ্রমিক আগেই নির্ধারণ করে নেয়, তিন: শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি নির্ধারণ করে, চার: শ্রমিককে অযথা কষ্ট দেয় না এবং পাঁচ: শ্রমিকের সাথে সদাচরণ করে। এই শিক্ষাই আমরা নিচের আয়াত ও তার দৃশ্যপট থেকে পাই “তাদের (শুয়ায়ব আ.-এর দুই মেযে়র) একজন বলল, পিতা! তুমি একে (মূসাকে আ.) মজুর নিযুক্ত কর, কারণ তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত। সে (শুয়ায়ব আ.) মূসাকে বলল, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই, এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে, যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সে তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাইলে তুমি আমাকে সদাচারী পাবে।” (সূরা কাসাস ২৮:২৬Ñ২৮)
শ্রমিকের অধিকার
শ্রমিকের অধিকারকে আমরা মালিকের কর্তব্য ও দাযি়ত্ব বলে ব্যক্ত করতে পারি। মালিক এই দাযি়ত্বপালন করে না বলেই পোশাক-শিল্পে অহরহ শ্রমিক-বিক্ষোভ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইসলাম মালিককে এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিযে়ছে
এক: নিযে়াগের আগেই শ্রমিকের মজুরী নির্ধারণ করতে হবে, যাতে শ্রমিক না ঠকে এবং মালিককে ঝামেলার মুখোমুখি হতে না হয়। হাদীসের ভাষায় “মজুরের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না।” (বায়হাকী)
আল-কুরআনে মজুরি নির্ধারণের এই আদর্শ দেখতে পাই, হযরত শোয়ায়ব (আ.) কর্তৃক হযরত মূসা (আ.)-কে পারিশ্রমিক নির্ধারণের মধ্যে। (সূরা কাসাস ২৮:২৭)
দুই: শ্রমিককে মানবিক জীবনযাপনের উপযোগী ন্যায্য মজুরী পারিশ্রমিক দিতে হবে। হাদীসে সাবধান করে বলা হযে়ছে “নবী করীম (স.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন – কিয়ামতের দিন আমি তিন রকমের লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করব, যাদের মধ্যে এক রকমের লোক হল তারা যারা শ্রমিকের কাছে থেকে পূর্ণ কাজ নিযে় নিযে়ছে অথচ তাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়নি।” (বুখারী ৪/২০৮৩; বায়হাকী, কিতাবুল ইজারা)
তিন: যথাসমযে় শ্রমিকের পাওনা মিটিযে় দিতে হবে। নবীজীর (স.) ভাষায় “ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পাওনা মিটিয়ে দাও।” (ইবনে মাজাহ ২/৮১৭; হাদীসটি সহীহ)
চার ও পাঁচ : শ্রমিকের ওপর বাড়তি বা দুঃসাধ্য কাজ চাপাবে না। কঠিন কাজ দিলে তাকে সাহায্য করবে।
ছয়: তার খাদ্য ও পোশাকের মানানসই অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এবার হাদীসের সাপোর্ট নেয়া যাক “তাবেয়ী মা’রূর ইবনে সুওয়াইদ (রহ.) বলেন, আমরা রাবযা নামক স্থানে আবু যার গিফারীর বাডি়র পার্শ দিযে় যাচ্ছিলাম। আমরা দেখলাম তার দেহে যে পোশাক তার চাকরের দেহেও সেরূপ একই পোশাক। আমরা বললাম, আবু যার, আপনি যদি চাকরকে এরূপ কাপড় না দিযে় তার কাপড়টি আপনার কাপড়ের সাথে সংযুক্ত করে আপনি ব্যবহার করতেন তাহলে একটি সুন্দর সেট হত। আর তাকে অন্য কাপড় দিতেন। তখন তিনি বলেন, আমার ও আমার এক শ্রমিকভাইযে়র মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। তার মা ছিল অনারব। আমি তাকে তার মা তুলে গালি দিই। সে ভাই এ বিষযে় রাসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে অভিযোগ করেন। এরপর আমি যখন রাসূলুল্লাহ (স.)-এর সাথে সাক্ষাত করলাম তখন তিনি বলেন, আবু যার, তুমি কি তাকে মা তুলে গালি দিযে়ছ? তোমার মধ্যে এখনো জাহিলিয়্যাত (মূর্খতা, অন্ধকার) রযে়ছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, মানুষ কাউকে গালি দিলে তো তার মা-বাবা তুলবেই! তিনি বলেন, আবু যার, তোমার মধ্যে জাহিলিয়্যাত বিরাজমান! তারা তোমাদের চাকরবাকর-শ্রমিক বা দাস শ্রেণী তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ ও দায়িত্বাধীন করেছেন। কাজেই তোমরা যা খাও তা থেকে তাদেরকে খাওয়াবে এবং তোমরা যা পরিধান কর তা থেকে তাদেরকে পরিধান করাবে। তাদের পক্ষে কষ্টকর বা অসাধ্য কোন দাযি়ত্ব তাদের ওপর চাপাবে না। যদি কোন কষ্টসাধ্য দাযি়ত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত কর তবে তোমরা তা পালনে তাদেরকে সাহায্য করবে।” (মুসলিম, ৩/১২৮২, ১২৮৩)
সাত: তাকে অযথা কষ্ট দেয়া যাবে না বরং তার সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। শ্রমিকের (মূসা আ.) প্রতি একজন মালিকের (হযরত শোয়ায়ব আ.) বক্তব্য লক্ষ্য করুন “আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না; আল্লাহ চাইলে (ইনশা আল্লাহ) তুমি আমাকে সদাচারী হিসেবে পাবে।” (সূরা কাসাস ২৮:২৭)
আট: শ্রমিকের ক্ষমার যোগ্য ত্রুটি ক্ষমার নজরে দেখতে হবে। রাসূলুল্লাহ (স.) অধীনস্তকে ক্ষমার ব্যাপারে তাগিদ করলে এক সাহাবী জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাকে দৈনিক কত বার ক্ষমা করব? নবীজী (স.) বললেন, “প্রতিদিন ৭০ বার (বহুবার)।” (আবু দাউদ ৪/৩৪১; হাদীসটি সহীহ)। তাছাড়া কুরআন মাজীদে ক্রোধ দমন, দোষত্রুটি উপেক্ষা (ক্ষমা) এবং সদয় ব্যবহারের প্রতিদানে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও জান্নাতের ওয়াদা করে বলা হযে়ছে, “(ক্ষমা ও মহামূল্য জান্নাত ঐসব আল্লাহভীরুদের জন্য) যারা সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করে, ক্রোধ হজমকারী, মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আল্লাহ সদয় ব্যবহারকারীদেরকে (সৎকর্মীদেরকে) ভালবাসেন।” (সূরা আলে-ইমরান ৩:১৩৩-১৩৪)
নয়: দান-সদকা মানুষের বালা-মুসীবাত দূর করে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। সুতরাং সাধ্য থাকলে গরিব শ্রমিককে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দান করা উচিত যাতে তার জীবন কিছুটা সুন্দর হয়। কিন্তু মানুষের আচরণ ঠিক উল্টো, যা আল্লাহর কাছে তিরস্কৃত হযে়ছে এভাবে “আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকেও কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিযে়ছেন। যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হযে়ছে তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হযে় যায়। তবে কি ওরা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?” (সূরা নাহ্ল ১৬:৭১)
দশ: শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে; কারণ, সুস্বাস্থ্য ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা না গেলে কাক্সিক্ষত শ্রম ও সার্ভিস পাওয়া অনিশ্চিত হযে় পড়বে। হাদীসে এসেছে “শ্রমিকদের প্রতি ঐ পরিমাণ কাজের দাযি়ত্ব চাপাবে, যা তারা সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে পারে এবং তাদের শক্তি অনুসারে কাজ নিবে যাতে তাদের এরূপ কাজ করতে না হয়, যা তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হয়।” (আল-মুহাল্লা, সূত্র: মিশকাতের অনুবাদে যাকাত অধ্যাযে়র আগে দেয়া মাওলানা নূর মোহাম্মদ আ’জমী রহ.-এর ভূমিকা)। আর বাংলা কবিতায় বলা হযে়ছে, ‘বিশ্্রাম কাজের অঙ্গ এক সাথে গাঁথা/ নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।’
এগার: শ্রমিক ও অধীনস্থ যে কারুর ব্যাপারেই খুব বেশি হুঁশিয়ার থাকতে হবে। কারণ, অধীনস্থের সাথেই অসতর্ক আচরণ সংঘটিত হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। নবীজী (স.) ইনতেকাল-সমযে়র অসহ্য কষ্টের মধ্যেও দু’টি মাত্র জিনিসের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে গেছেন তার একটি সালাত, অন্যটি অধীনস্থ। নবীজীর (স.) ভাষায় “সাবধান! সালাত এবং অধীনস্থের ব্যাপারে সাবধান!!” (ইবনে মাজাহ ১/৫১৯, ২/৯০০, ৯০১)
মালিকের অধিকার
শ্রমিকের যেটা করণীয় সেটাকেই বলা হয় মালিকের অধিকার। এই অধিকার আদায়ে শ্রমিকের করণীয় হচ্ছে
এক: যে কাজ সহজে বা কিছুটা বাড়তি কষ্ট করে সম্পন্ন করা সম্ভব এমন কাজই নেবে; অসাধ্য সাধনের ঝুঁকি নিযে় জীবন ও সুনামকে বিপন্ন করবে না। যে কাজ সম্পাদনের শক্তি-সামর্থ্য নেই, তাতে জড়িত হওয়ার মানে হয় না। (সূরা কাসাস ২৮:২৬)
দুই: স্বীয় কাজ বা দাযি়ত্বকে আমানাত (অবশ্য পরিশোধ্য অন্যের প্রাপ্য) মনে করে তা সম্যকভাবে আদাযে় সচেষ্ট হতে হবে। এ ব্যাপারে আল্লাহর তাগাদা রযে়ছে “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানাত তার প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতে।” (সূরা নিসা ৪:৫৮)
তিন: শ্রমিককে অবশ্যই মালিকের কল্যাণকামী হতে হবে; নতুবা দাযি়ত্ব পালনে অবহেলা অবশ্যম্ভাবী। নবীজী (স.) ইরশাদ করেছেন “উত্তম উপার্জন হল শ্রমিকের উপার্জন যদি সে মালিকের কল্যাণ কামনার সাথে কাজ করে।” (মুসনাদে আহমাদ, সূত্র: নূর মোহাম্মদ আ’জমী রহ. কৃত মিশকাতের যাকাত অধ্যাযে়র ভূমিকা)
শেষকথা
সমস্ত সমস্যার সমাধান হচ্ছে দাযি়ত্বজ্ঞান; আর দাযি়ত্বজ্ঞানের পথে প্রেরণার উৎস হচ্ছে আল্লাহ ও পরকালের ভয়। আমরা প্রত্যেকে যদি একটি হাদীস মনে রাখি, অসংখ্য সমস্যার সমাধান হযে় যাবে অবলীলায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন ঃ সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই এক একজন দাযি়ত্বশীল। আর (কিয়ামতের দিন) তোমাদের প্রত্যেককে তার দাযি়ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সুতরাং (১) জনগণের শাসকও একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি; কিয়মতের দিন তার দাযি়ত্ব সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, (২) পুরুষও তার পরিবারে একজন দাযি়ত্বশীল; তাকে তার এই দাযি়ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, (৩) স্ত্রীও তার স্বামীর ঘর-সংসার এবং সন্তানের ওপর দাযি়ত্বশীলা; (কিয়ামতের দিন) তাকেও এই দাযি়ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, (৪) এমনকি কোন ব্যক্তির গোলাম বা দাস (চাকর-চাকরানীও) তার প্রভুর সম্পদের ব্যাপারে একজন দায়িত্বশীল; সেদিন তাকেও তার দাযি়ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। অতএব, সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। আর তোমাদের প্রত্যেককেই কিয়ামতের দিন এই দাযি়ত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম, সূত্র: মিশকাত, হাদীস নং ৩৫১৬)

Comments

comments

About

Check Also

বিজয় দিবস : একটি পর্যবেক্ষণ

নিশ্চয়ই আমরা তোমার জন্য এক সুস্পষ্ট বিজয় নির্ধারণ করেছি। এতে করে আল্লাহ তোমাকে তোমার পূর্ববর্তী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *