নারী : সহিংসতা ও প্রতিকার

নারী। সৃষ্টিরাজির সৌন্দর্য্য এবং পুরুষদের চক্ষুশীতলকারী আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা দূর করার লক্ষ্যে, পৃথিবীতে মানবজাতির ক্রমধারা অব্যাহত রাখতে হজরত হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। উভয়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবজাতির ক্রমধারা অব্যাহত রাখা প্রসঙ্গে ঘোষিত হচ্ছে-এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী-(সুরা আন নিসা : ০১)। এক্ষেত্রে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। নারী ছাড়া পুরুষ পরিপূর্ণ হতে পারে না। আবার মহান আল্লাহ তায়ালা নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে তৈরী করে দিয়েছেন দয়া, মহব্বত-ভালোবাসা। আল্লাহর বাণী-আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্যে থেকে তোমাদের সঙ্গীনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন-(সুরা আল ইমরান : ১৪)।
নারী জাতিকে লোভনীয় ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত করে সৃষ্টি করা হলেও তাঁদের মান-মর্যাদা, সম্মান, অধিকার, দায়িত্ব-কর্তব্য, পুরুষদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ইসলাম ধর্ম তাদেরকে সর্বক্ষেত্রে সর্ববিষয়ে অবস্থাভেদে সম্মান ও অধিকার প্রদান করেছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে নারীদেরকে অধিক সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে। যা ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে। মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন হিসেবে মর্যাদা প্রদানের পাশাপাশি অন্য নারীদের সম্মান ও অধিকার রক্ষা করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। তথাপি নারী জাতি সহিংসতা, লাঞ্চনা, নির্যাতন আর অবমাননার শিকার। এ সবের নেপথ্যে অগণিত কারণ রয়েছে। যা হাতে গুণে শেষ করার নয়। সংক্ষেপে কিছু কারণ আলোকপাত করছি।
প্রথমত : বর্তমান সমাজে পুরুষ-নারী ইসলামী মৌলিক শিক্ষা ও কুরআন সুন্নাহ হতে দূরে বহুদূরে। ইসলামী শিক্ষাকে অবজ্ঞা, অবহেলা হেতু নিজ নিজ কর্তব্য, দায়িত্ব, আচার-আচরণ, চলাফেরা চির অচেনা হয়ে গেছে। যার কারণে নিজের বাস্তবিক অধিকার ও সম্মান নিয়ে কেউই সচেতন নয়। ফলস্বরূপ নারীরা সমাজে সহিংসতার শিকার। অথচ ঐ নারীজাতিকে দাসীত্ব ও পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে সভ্যতানুযায়ী মুক্ত করতে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সোচ্চার ছিলেন। সেই নারীরা আজ সর্বত্র যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও হত্যার শিকার।
দ্বিতীয়ত : শরীয়ত অনুযায়ী পর্দা না করা। হিজাব বা পর্দা নারীর অন্যতম ভূষণ। মানুষ যখন তার শালীনতাকে বিসর্জন দিয়ে স্বেচ্ছানুযায়ী বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করে তখন তার বিপদ চলে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বর্তমান সমাজে নারীদের কিছু অংশ পর্দাকে অপরিহার্য মনে করছেন না এবং তাদের একটা অংশ পর্দা প্রথাকে ধর্মীয় গোড়ামী (?) মনে করে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করার চেষ্টা করছেন। যার ফলে অবাধ চলাফেরার সুযোগে কুরুচিপূর্ণ কিছু নামধারী মানুষের লালসার শিকার হচ্ছে নারী সমাজ। ঘটছে সহিংসতা, যৌনতা, ব্যভিচার আর অমানবিকতা।
তৃতীয়ত : নৈতিক শিক্ষার অবনতি। মানুষ যখন নীতি নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে তখন যে কোন অসামাজিক কাজ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। পারিবারিক শাসন ও নৈতিক শিক্ষা সংকুচিত হওয়ায় বর্তমান সমাজের তরুণ-তরুণীরা সহ সমাজের বিশাল অংশ বিপথগামী হচ্ছে। যার দরুণ কিশোর-কিশোরীরা, শিক্ষাঙ্গনে সিনেমার আদলে ফুল দিয়ে জনসম্মুখে প্রপোজ করছে, জড়িয়ে ধরছে। যুবক-যুবতীকে প্রেম নিবেদন করছে, ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকাকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। এসকল ঘটনা সমাজে আজ আর বিরল নয়, বরং প্রতিনিয়ত ঘটছে।
চতুর্থত : নারীর ক্ষমতায়ন। সমধিকারের স্লোগানে প্রগতিশীল নামধারী কিছু নারী বর্তমান সময়ে নারীদের কপালে আমদানী করেছে দূর্গতি। নারী ছিল শ্রদ্ধার পাত্রী। সমান অধিকারের লাভের আশায় রাস্তায় অবস্থানকারী ওদের ভাগ্যে জুটছে হীনমন্যের কতিপয় কুদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ নামধারী অমানুষদের যৌনতা নিবারণের সামগ্রী। শুধু তাই নয়; পুরুষের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কারণে পুলিশের পিটুনি আর বুটের লাথি খেতে হয়। সহিংসতার পিছনে এটাও একটা অন্যতম কারণ। প্রগতির নামে বেহায়াপনার নোংরামিতে লিপ্ত হওয়ায় ইভটিজিং, ধর্ষণ আর হত্যার শিকার হচ্ছে।
পঞ্চমত : সহশিক্ষা। ছেলে-মেয়ে উভয়ে একসাথে সহশিক্ষার পরিবেশের কারণে সুযোগ হচ্ছে অবাধ চলাফেরা আর মেলামেশার। পারিবারিক তীক্ষè নজরদারিতা না থাকার কারণে তা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। সহপাঠী বা একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে প্রথমে কথাবার্তা, পরিচয়, পরিনয়, যৌনতা, ধর্ষণসহ নানাবিধ কর্মকাণ্ড ঘটেই চলছে। শেষ অবধি এসিড নিক্ষেপ আর হত্যার নির্মম শিকার হচ্ছে নারীরা। যার বোধদয় সমাজে এখনও হয়নি। এগুলো হাতে গোনা কয়েকটা কারণ মাত্র। এছাড়া আরো বহুবিদ কারণ আমাদের দৃষ্টির অগোচরে নয়। প্রয়োজন এসকল সহিংসতা, নির্মমতা আর নির্যাতন থেকে নারী সমাজকে মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি আমাদের সমাজকে বসবাস উপযোগী করে তোলা। চলুন জেনে নেই কতিপয় প্রতিকার সমূহ।
কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলা : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এখানে সার্বিক জীবন ব্যবস্থা বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহকে গ্রহণ করার বিষয়ে আল্লাহ বলেন-রাসুল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর-(সুরা আল হাশর : ০৭)। এটা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহর রাসুল কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে এসেছিলেন। তাই আমাদের সমাজে কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান বাস্তবায়িত করতে পারলে নারী সহিংসতা, ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও নারী হত্যা শূন্যের কোঠায় চলে আসবে। আসুন সমাজকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলোকিত করি।
পর্দা প্রথা : পর্দা নারীকে সুশোভিত ও সংরক্ষিত রাখে। পর্দাই নারীর অন্যতম ভূষণ। পর্দার মাধ্যমে ফিরে পায় সম্মান, মর্যাদা আর আত্মতৃপ্তি। আল্লাহর বাণী-ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণত: প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে-(সুরা আন নুর : ৩১)। বর্তমান সমাজে পর্দাহীন নারীই নির্যাতন ও যৌনতার শিকার হচ্ছে বহুলাংশে। পর্দা করার মাধ্যমে সম্ভব আমাদের সমাজের কুরুচিপূর্ণ স্বভাবগুলোকে চিরতরে মুছে দেয়া। তখন আর মানুষরূপী শয়তানদের লালসার শিকার হবে না আমার আপনার সকলের প্রিয় বোনেরা।
নৈতিক শিক্ষার উন্নতি সাধন : নৈতিকতার জন্য অবশ্যই ইসলামী মৌলিক জ্ঞান থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবার অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নে আপোষহীন থাকতে হবে। যদি ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শকে লালন না করে তাহলে সমাজে নৈতিকতা পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। পরিবারের দায়িত্ব হিসেবে সন্তানদের প্রতি নজরদারি করা অতীব জরুরী। সন্তান কি করছে? কোথায় যাচ্ছে? কাদের সাথে চলাফেরা করছে? এই বিষয়ে পরিবার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকলে সমাজ আলো পাবে কোথা থেকে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে নৈতিকভাবে আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে নারী সহিংসতা, নগ্নতা, ইভটিজিং আর ধর্ষণ সমাজ থেকে বিলুপ্ত হতে বাধ্য। নিজ নিজ ক্ষমতা ও দায়িত্ববোধ অনুযায়ী কাজ করা : মহান রাব্বুল আলামীন পুরুষ-নারী সৃষ্টি করে তার নিজস্ব অবস্থান প্রদান করেছেন। পুরুষকে নারী পরিচালনার দায়ভার প্রদান করে নারীকে সহযোগী হিসেবে আলাদাভাবে সম্মান-মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব প্রদান করেছেন। মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন হিসেবে মর্যাদা প্রদানের পাশাপাশি নারীদের অধিকারকে নিশ্চিত করেছেন। যারা আল্লাহর বিধানের উপর সন্তুষ্ট না থেকে নারীর ক্ষমতায়ন বা সমধিকারের স্লোগান দিচ্ছেন তারাই ‘খাল কেটে কুমির আনছেন’। ঐ সমধিকারের স্লে­াগানধারীরা শেষ পর্যন্ত কোন না কোন স্বার্থ লোলুপ মানবরূপী পশুদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। মনে রাখতে হবে আল্লাহর বিধান এবং ফয়সালা মানবজাতির উত্তম আশ্রয়স্থল। সৃষ্টিগতভাবেই আল্লাহ তায়ালা পুরুষ-নারীকে বিস্তর ব্যবধান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই যার যার অবস্থানুপাতে মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত। ক্ষমতায়ন বা প্রগতিশীলতার নামে নগ্নতা ও বেহায়পনা শান্তির জীবন প্রদান করতে পারবে না।
শিক্ষার পরিবেশ হতে সহশিক্ষা দূরীকরণ : সহশিক্ষার কারণে ছেলে-মেয়েদের অবাধ চলাফেরা ও মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। যার দরুণ অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। যে বয়সে যৌনতা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকার কথা ঐ বয়সে প্রেম প্রেম খেলা করে নষ্ট করে দিচ্ছে নিজের জীবনকে, ক্যারীয়ারকে। প্রতিষ্ঠান সমূহের খবরা-খবর নিলে সর্বত্রই এসব চিত্র পরিলক্ষিত হবে। আস্তে আস্তে সমাজের সহশিক্ষার পরিবর্তন আনতে পারলে নারী নির্যাতন, সহিংসতা, ইভটিজিং, ধর্ষণ লোপ পাবে।
সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে যে বিষয়গুলো ফুটে উঠবে তাতে উপরোক্ত বিষয়সমূহ অবশ্যই অগ্রাধিকার পাবে। সমাজের এ অবনতির কারণে আমাদের চোখের সামনে তনু, মিতা, রিশাসহ চলে গেল অনেকেই। শেষ অবধি পাষণ্ড বদরুলের কাছে হার মানতে হল মেধাবী খাদিজার। এভাবে আর কত? আর কতজনের লাশ গুণতে হবে? এসব থেকে সমাজকে পরিত্রাণ দেয়া দরকার। সময় এসেছে জেগে উঠার। নারীদেরকে আরো সচেতন ও ধর্মভীরু হওয়া প্রয়োজন। পুরুষদের প্রয়োজন নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা। পশুত্ব স্বভাবগুলোকে চিরতরে নিঃশেষ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পুরুষদের প্রতি ফরমান জারী করে বলেন-মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য অধিক পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।’-(সুরা আন নুর : ৩০)
আমাদের সকলের উচিৎ সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ইসলামের আদর্শকে বাস্তবে রূপ দেয়া। আল্লাহ যেন আমাদের সমাজকে সুন্দরভাবে গঠন করার তাওফীক প্রদান করেন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

চিনে মুসলমানের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির ব্যবসা

সিরাজুল ইসলাম সা’দ নজিরবিহীন ভাবে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী উইঘুর মুসলমানদের ওপর কমিনিষ্ট পার্টির …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *