জামাই কাটা হাওর : ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী

শিশির ফোটা স্পর্শে যেমন ফুলগুলী ফুটে
শীতল হাওয়ার ছোয়ায় মন সতেজ হয়ে ওঠে।
সময় সচেতন জীবনধারা থেকে বেরিয়ে কখনো কখনো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির কোলে। মনে হয় যেন প্রকৃতির নীরবতায় শরীরটাকে একটু এলিয়ে দিলেই দূর হবে সব ক্লান্তি। কারো কাছে হয়তো পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে লোকানো সৌন্দর্য আবিষ্কারেই পরিপূর্ণ আনন্দ, আবার কারো কাছে হয়তো নিজেকে হালকা করতে সমুদ্রের বাঁধভাঙ্গা ঢেউয়ের গর্জনই সই। তবে যে যা-ই বলুক, প্রকৃতির নৈস্বর্গের মাঝে হাওরের নান্দনিকতা বরাবরই একটু বেশি। সুরমা-কুশিয়ারার বুক চিড়ে রতœা নদীর তীরে অবস্থিত ‘জামাই কাটা হাওর’। জগন্নাথপুর, ছাতক, বিশ্বনাথ এই তিন উপজেলা ঘিরে ছিল হাওরের মূল সীমানা। পূর্বে বিশ্বনাথ উপজেলার জানাইয়া গ্রাম, পশ্চিমে জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর, উত্তরে ছাতক উপজেলার মঈনপুর এবং দক্ষিণে জগন্নাথপুর উপজেলার নয়াবন্দর। বর্তমান সময়ে পৃথিবীটা যেভাবে দিনদিন ছোট হয়ে আসছে, ঠিক সেইভাবে হাওরের আয়তনেরও একই অবস্থা! বর্ষায় হাওরে পানির রাজত্ব চললেও হিম হিম শীতে ভিন্ন এক রূপের ডালি মেলে ধরে এ হাওর। ঘন কুয়াশায় স্বচ্ছ নীল জল, আর তাতে ভেসে বেড়ানো হাজারো পাখির কলতানে একসময় মুখর হয়ে ওঠতো এক স্বপ্নীল জগৎ। শীতের সময়টায় হাওরের বিভিন্ন জায়গায় পানি কমতে থাকায় অনেক কান্দা বা পাড় জেগে ওঠে। ফলে পুরো হাওর ভাগ হয়ে যায়, আর পড়ে মাছ ধরার ধুম। হাওরের একসময়ের মধ্যবর্তী গ্রাম লোহারগাও (বর্তমানে হাওরের প্রবেশমুখ) প্রতি বছরই দফায় দফায় মাছ ধরা পড়ে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে ৪/৫ গ্রামের মানুষ মিলে এখানে মাছ ধরার শত বছরের ঐতিহ্য বিরাজমান। তবে এখন আর আগেরমতো মাছ পাওয়া যায়না। মাছ ধরার শেষ পর্যায়ে হাওরের পানি আটকানোর জন্য হাওরের প্রবেশ মুখের বাধটি (লোহারগাঁও) বাধা হয়ে যায় এবং এখানে প্রচুর পরিমাণ ধান উৎপাদিত হয়। ধান রোপণের ব্যস্ততায় তখন ঝাপিয়ে পড়েন স্থানীয় কৃষকরা। চৈত্রের শেষের দিকে যখন পানির আগমন ঘটে, তখন অনেকসময় বাধটি ভেঙ্গে যায়। শুরু হয় কৃষকদের জীবন-মরণ সংগ্রাম। আশপাশ গ্রাম, পাড়া, মহল্লার মসজিদগুলোতে মাইকিং করা হয় টুকরী-কুদাল নিয়ে আসার জন্য। বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে! যাদের জমি নেই তারাও অনেকসময় সহযোগীতা করেন এ বাধ রক্ষার সংগ্রামে। বাধ রক্ষায় মাঝেমধ্যে সফল হলেও ব্যর্থ হতে হয় অধিকাংশ সময়।
প্রাকৃতিক মায়াময় ছায়াঘেরা এই হাওরে ঘটে যায় একটি অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা। দিন তারিখ বা সাল লিপিবদ্ধ নেই, তাই ঘটানার বয়স কত? তা বলা মুশকিল। তবে ঘটনা শত বছর আগের। এই হাওরের এক কোনে আমারও জন্ম। এজন্য বুঝ হয়ার পর থেকেই শুনে আসছি জামাই কাটা হাওর, জামাই কাটা হাওর। ইচ্ছা থাকা সত্বেও সময়-সুযোগের অভাবে বিস্তারিত আর জানা হয়নি! কয়েকদিন আগে স্নেহাশিস ছোট ভাই হাফিজ শাহ আলম হঠাৎ বলে যে ভাই! জামাই কাটা হাওর নিয়ে কিছু একটা লিখেন। সাথে সাথে তাকে কিছু বলিনি যে, এটি একটি ঐতিহাসিক বিষয়। এরকম কোনো বিষয়ে কিছু লিখতে গেলে আগে সে বিষয় সম্পর্কে জানতে হয়। আমি এই বিষয়ে অজ্ঞ! তাই এলাকার কয়েকজন মুরব্বীর কাছে জানতে চাইলাম আসলে মূল বিষয়টি কি? এখানে দেখা যায় বিভিন্ন মতভেদ আছে।


(১)
আগের যুগে চলাচলের একমাত্র মাধ্যম ছিলো নৌকা। অবশ্য ভাটি অঞ্চলের কিছুকিছু এলাকায় এখনো আছে যে, বারো মাসই নৌকা ছাড়া কোন উপায় নেই। জামাই কাটা হাওরের মধ্যদিয়ে ছিলো আগেকার যুগের নৌকা চলাচলের রাস্তা। একদিন এক নতুন বর কনেসহ বরযাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে হাওরে ডাকাতের আক্রমণ ঘটে, আর এই ডাকাতের আক্রমণেই মূলত জামাই মারা গেছেন। কিছু মানুষ (শুনার শুনা) বলছেন যে, নৌকায় ডাকাত আক্রমণ করেছিল রাতের অন্ধকারে, নিজের আতœরক্ষার জন্য স্ত্রী দা দিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এরমধ্যে ডাকাত মনে করে তিনি তার স্বামীর উপর কুপ দিয়ে দেন এবং সাথে সাথেই স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকেই হাওরের নামকরণ করা হয় “জামাই কাটা হাওর”।
(২)
বউ ষড়যন্ত্র করে জামাইকে হত্যা করেছেন, পরেরদিন জেলেরা হাওরে লাশ দেখতে পান এবং চিহ্নিত করার পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে বেশকিছুদিন পর থেকে হাওরের নামকরণ করা হয়েছে ‘জামাই কাটা হাওর’।
(৩)
শ্বশুর জামাইকে কেটেছেন, নাকি বউ জামাইকে কেটেছেন? এনিয়েও একটি মতভেদ আছে , তবে উল্লেখযোগ্য মতভেদ হলো ‘ডাকাতরা আক্রমণ করে মালামাল লুট করে নিয়ে যায় এবং জামাইকে হত্যা করে। এই ঘটনা বা হাওরের বয়স কত, তার সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। ১৯৫৪/১৯৫৬ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসনামলে যখন জরিপ এসেছিল, তখন স্থানীয় লোকজনকে জরিপকারীরা জিজ্ঞেস করেছিলেন এই হাওরের নাম কি? তখন তারা বলেছিলেন এখানে তো জামাই কাটা হয়েছিলো, তাই আমরা ‘জামাই কাটা’ হাওর বলেই ডাকি। ধারণা করা হচ্ছে এ থেকেই লিখিতভাবে ‘জামাই কাটা হাওর’ নামকরণ-এর সুত্রপাত। তবে ভাটিবাংলার রাজধানী খ্যাত বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ হাওর অধ্যুষিত এলাকা সুনামগঞ্জ জেলা। সুনামগঞ্জ যখন জেলা ছিলোনা, তখনকার ভূগলে ভাটি অঞ্চলের হাওরের ইতিহাসে একমাত্র ‘জামাই কাটা’ হাওরের নামই ছিল প্রসিদ্ধ। পরবর্তীতে এই নামটি মুছে ফেলা হয়েছে।
হাওরের কথা বলতে গেলে সাগরের কথা মনে ভেসে উঠে। বর্ষাকালে বড় বড় হাওরে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যোগাযোগের জন্য পাড়ি জমালে বা নৌকা ভাসালে মনে হয় যে, ‘অকুল দরিয়ার মাঝে কুল নাই, কিনারা নাই রে’ বর্ষাকালে হাওরে পানি এতো বেশি থাকে যে, দেখে মনে হয় তীরহীন সমুদ্র। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে দেখা যায়। এই হাওরগুলো নদী ও খালের মাধ্যমে জলপ্রবাহ করে থাকে। বাংলাদেশের ষড়ঋতুতে হাওরের ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। হাওরের জলরাশি ভেদ করে রঙ্গীন সূর্য উদিত হয় এবং দগদগে লাল সূর্যটি জলের ভিতরই ডুবতে দেখা যায়। বর্ষাকালে হাওরের সৌন্দর্য অপরূপ। হাওর কোনো স্থায়ী জলাশয় বা জলধারা নয়। বর্ষায় যেখানে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। শুষ্ক মৌসুমে সেখানেই মাইলের পর মাইল চোখ জোড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত। কবি যে বলেছিলেন- জন্ম আমার ধন্য মাগো…

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *