কোর্ট প্রাঙ্গণে গ্রিক দেবী : আমাদের করণীয়

মূর্তি। আক্ষরিক অর্থ হলো ‘অবয়ব’। হিন্দুধর্মে মূর্তি বলতে দেবতার প্রতিমাকে বুঝায়। সাধারণত পাথর, কাঠ, ধাতু বা মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণ করা হয়। হিন্দুরা মূর্তির মাধ্যমে দেবতার পূজা করে থাকে। তাদের ধর্মীয় সংস্কার বা শাস্ত্রের নির্দেশানুযায়ী নির্দিষ্ট দেবতার মূর্তি নির্মিত হয়ে থাকে। ভাস্কর্য। পাথর, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। যিনি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন তাকে ভাস্কর বলা হয়। মূর্তি বা ভাস্কর্যের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই। প্রায় সমার্থক।
থেমিস। গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে ইনি ছিলেন প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন নিয়ন্ত্রণকারিণী দেবী। ইনি ইউরেনাসের ঔরসে গেইয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বংশগত বিচারে ইনি বারোজন টাইটানের একজন। টাইটান ইংরেজি শব্দ। যাকে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় তিতান বলা হয়। বারোজন টাইটান বা তিতান হলেন- অকেয়ানোস, তেথুস, হুপেরিয়ন, থেইয়া, কয়উস, ফয়বে, ক্রোনুস, রেয়া, নেমোসাইনে, থেমিস, ক্রিউস ও ইয়াপেতুস।
আমরা বাংলাদেশী। বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা’র রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন পতাকা পতপত করে আজো বাংলাদেশের সকল জাতীয়, সরকারী, বেসরকারী স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে উড়ছে স্বগৌরবে। আমরা গর্বিত। আমাদের রয়েছে স্বাধীনচেতা মন, রয়েছে নিজস্ব জাতীয়তাবোধ। আমাদের রয়েছে সাহসী এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আমাদের চেতনায় আজো দেশীয় মমত্ববোধ সর্বদা জাগ্রত। দেশীয় চেতনায় আজো বাংলার দামাল ছেলেরা উচ্ছসিত। আপামর জনতা আজো দেশকে, দেশের চেতনাকে হৃদয় গহীনে গেঁথে রেখেছে নিরবে, নিভৃতে। আমরা কোন দেশের, কোন জাতীর বা কোন গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক নয়। আমরা গোলামী করি না কোন দেশের, কোন জাতি বা গোষ্ঠীর। আমাদের দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিমকোর্ট। যা দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। যারা কথায় কথায় দেশের জাতীয়তাবোধ নিয়ে কথা বলেন তাদের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রইল এই কোর্ট প্রাঙ্গনে বিজাতীয় দেশের মূর্তি বা ভাস্কর্য আমাদের দেশের জাতীয়তাবোধকে কি প্রশ্নবিদ্ধ করে না? তাহলে কি আমরা আমাদের জাতীয় চেতনাকে হারাতে বসেছি? কার স্বার্থে এই মূর্তি? নাকি বাংলাদেশের জনগণের সাথে জাতীয়তাবোধ নিয়ে খামখেয়ালী? আমাদের পূর্বসূরীরা রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন নিজস্ব জাতীয়তাবোধ ও স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। আজ সেই জাতীয়তাবোধ বিপন্ন হওয়ার পথে। যদি আমাদের জাতীয়তাবোধকে বিপন্ন করার পায়তারা করা হয়, তাহলে বসে থাকবে না বাংলার সাহসী সূর্যসন্তানেরা।
আমরা মুসলমান। দেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। যাদের ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে অনেক গভীরে। আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি রয়েছে অগাধ ভালোবাসা। দেশের প্রতি মমত্ববোধ রয়েছে হৃদয় গহীনে। ধর্ম ও দেশের অপমানে কখনো বসে থাকার কথা নয়। ইসলাম ধর্ম এসেছে পৃথিবীতে শান্তির বার্তা নিয়ে। এসেছে একত্ববাদের বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে। শিরক তথা মূর্তি পূজা বাদ দিয়ে এক আল্লাহর বন্দেগীর শিক্ষা দিতে। আল্লাহর প্রেরিত সব নবী-রাসুল একই মিশন নিয়ে এ ধরাধামে এসেছিলেন। মূর্তিকে সম্মান নয়, উৎখাত করতে। আল্লাহর বাণী, ‘যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, এই মূর্তিগুলো কী? যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ। তারা বললঃ আমরা আমাদের বাপ-দাদাকে এদের পূজা করতে দেখেছি। তিনি বললেনঃ তোমরা প্রকাশ্য গোমরাহীতে আছ এবং তোমাদের বাপ-দাদারাও। তারা বলল : তুমি কি আমাদের কাছে সত্যসহ আগমন করেছ, না তুমি কৌতুক করছ? তিনি বললেনঃ না, তিনিই তোমাদের পালনকর্তা যিনি নভোমন্ডল ও ভূমূন্ডলের পালনকর্তা, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, এবং আমি এই বিষয়েরই সাক্ষ্যদাতা। আল্লাহর কসম, যখন তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যাবে, তখন আমি তোমাদের মূর্তিগুলোর ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা অবলম্বন করব। অতঃপর তিনি সেগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন ওদের প্রধানটি ব্যতীত। যাতে তারা তাঁর কাছে প্রত্যাবর্তন করে। তারা বললঃ আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার কে করল? সে তো নিশ্চয়ই কোন অত্যাচারী। কতক লোকে বললঃ আমরা এক যুবককে তাদের সম্পর্কে বিরূপ আলোচনা করতে শুনেছি, তাকে ইবরাহীম বলা হয়। তারা বললঃ তাকে জনসমক্ষে উপস্থিত কর, যাতে তারা দেখে। তারা বললঃ হে ইবরাহীম! তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ? তিনি বললেনঃ না, এদের এই প্রধানই তো এ কাজ করেছে। অতএব তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে। অতঃপর মনে মনে চিন্তা করল এবং বললঃ লোক সকল, তোমরাই জালিম। অতঃপর তারা ঝুকে গেল মস্তক নত করে, তুমি তো জান যে, এরা কথা বলে না। তিনি বললেনঃ তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের কোন উপকারও করতে পারে না, এবং ক্ষতিও করতে পারে না? ধিক! তোমাদের জন্যে এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত কর, ওদের জন্যে। তোমরা কি বোঝ না? -(সুরা আল আম্বিয়া ঃ ৫২-৬৭)। আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে মূর্তি এবং তদীয় ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা। এমনকি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও কা’বা ঘরের অভ্যন্তরে ৩৬০ মূর্তিকে এক এক করে ভেঙ্গে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। মুসলমান জাতি মূর্তির পূজা অর্চনা করতে নয়, দেবীকে সম্মান দিতে নয়, দেবীর কাছে ন্যায় বিচার চাইতে নয়, তা ভেঙ্গে ফেলার দায়িত্ব ও কর্তব্যের মাধ্যমে জীবন বিলিয়ে দিতে এসেছে। তাই, আজ কোর্ট প্রাঙ্গনে মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার দাবী বাংলাদেশের কোটি কোটি জনতার, আপামর জনসাধারণের। এ দাবী কোন ব্যক্তি বা দলের নয়।

আমাদের সমাজে এক ধরণের বুদ্ধিজীবী(?) (আবুল হিকাম ওরফে আবু জাহেল) রয়েছেন তাদের কাছে থেমিসদেরকে মূর্তি মনে হয় না। এগুলোর মাধ্যমে জাতীয় চেতনা ভুলণ্ঠিত হয় না, ধর্মীয় চেতনায় আঘাত আনে না। সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেয় না। তাদের মতে এটা ভাস্কর্য। অথচ মূর্তি এবং ভাস্কর্য এক ও অভিন্ন। আজ কাকে খুশি করার জন্য এই থেমিস মূর্তিকে বঙ্গীয়করণ?
সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে দাড়িঁয়ে আছে গ্রীক পুরাণের দেবী থেমিস। এক হাতে দাড়িপাল্লা অন্য হাতে খোলা তলোয়ার। চোখ বাঁধা। যার দ্বারা এটাই বোঝানো তিনি পক্ষপাত মুক্ত। এই বিষয়টা না বাঙ্গালী চেতনাবোধের অর্ন্তভূক্ত, না ইসলামী মূল্যবোধের অনুকূলে। যা আমাদের চেতনাবোধকে জাগ্রত করে না, যা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রেরণা দেয় না। তাহলে সেটা আমাদের সংস্কৃতিতে নিয়ে আসার অর্থ কি? আমাদেরকে মূর্তি পূজারী নাকি ঐ টাইটানদের অনুকরণে আমাদেরকে ইসলামের বদলে খ্রিষ্টীয় ধর্ম শিখানো হচ্ছে? বিবেকবান গণের বুঝতে বাকী নেই যে, আমাদেরকে পাশ্ববর্তী দেশের মূর্তির প্রতি সম্মান শিক্ষা (?) দেয়ার জন্য ওদের মূর্তিকে সরাসরি না এনে টাইটান মূর্তির মাধ্যমে লাল সংকেত দেয়া। এটা সহজতর কোন বিষয় নয়। পাশাপাশি রয়েছে জাতীয় ঈদগাহ ময়দান। যা মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং নিদর্শনের অন্যতম। এই ঈদগাহ ময়দানের পাশাপাশি থেমিস কে দাঁড় করানো বাংলাদেশের সমস্ত মুসলমানদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শনের নামান্তর। আলেম সমাজকে চপোটাঘাতের ভিন্ন নমুনা।
আলেম তথা মুসলিম সমাজ তথা গোটা দেশবাসী বসে থাকবে না। ইসলামী মূল্যবোধকে ধুলিসাৎ করার পায়তারা রুখে দাড়াবে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলিমরাই কেবল তাঁকে ভয় করে’ -(সুরা ফাতির ঃ ২৮)। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আলিমগণ নবীদের উত্তরাধীকারী’। নবী-রাসুলগণের মিশন-ভিশন ছিল আল্লাহর একত্ববাদের দিকে মানুষকে আহবান করার পাশাপাশি শিরক তথা মূর্তি কে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া। আজ আমাদের একান্ত করণীয় হলো সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা ভেঙ্গে ফেলার ব্যবস্থা করা। কেননা, আমাদের সরকার একজন মুসলীম সরকার। যিনি অবশ্যই মূর্তি পূজারী নন। তাই আশাবাদী সরকার এবিষয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করবেন। যদি তাই না হয়, তাহলে মুসলীম সমাজকে হাদীস অনুসারে এগিয়ে যেতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে- “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ দেখে তবে সে যেন তার হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে। যদি সক্ষম না হয় তার জিহ্বা অর্থাৎ কথার মাধ্যমে প্রতিহত করে। যদি তাতেও সক্ষম না হয় তবে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করে। আর অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করাই ঈমানের দুবর্লতা।” বাংলাদেশের মুসলীম জনতা হাদীসের প্রথম অংশকেই বেছে নিবে। কেননা, এদেশ শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশ। এদেশের মুসলমান দূর্বল বা নিস্তেজ নয়। যাদের শেকড় গভীরে, অনেক গহীনে। আল্লাহ যেন সরকারপ্রধান সহ সংশ্লিষ্ট সকলের শুভবুদ্ধির উদয় করে দেন।

Comments

comments

About

Check Also

রাসুলুল্লার হিজরাত : প্রাসঙ্গিক ভাবনা

পৃথিবীতে তখন ঘোর অমানিশার রাজ। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। যে ভিন্নতার জন্য …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *