ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও ভাষা শহীদদের মর্যাদা

ভাষা মহান আল্লাহ তায়ালার অপার নেয়ামত। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ভাষা ভিন্ন রকমের। এমনকি একই ভাষাভাষী মানুষের কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণভঙ্গি পৃথক। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহ পাকের কুদরতের নিদর্শন। আল কুরআনের ভাষায়-‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাসীর জন্যে নিদর্শন।’ সুরা রুম, আয়াত ২২। ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আমাদের মাতৃভাষার গুরুত্ব দিয়েছেন। হযরত আদম আ. হতে শেষ নবী পর্যন্ত সবকটি আসমানী কিতাব নবীদের মাতৃভাষায় নাযিল করেছেন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী-
প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর জাতির লোকদের মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি, যাতে তারা তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতে পারে। সুরা ইবরাহীম, আয়াত ০৪। এজন্য হযরত দাউদ আ. এর মাতৃভাষা ইউনানী বা আরমাইক ভাষায় যাবুর কিতাব, মুসা আ. এর মাতৃভাষা ইবরানী বা হিব্রু ভাষায় তাওরাত, ইসা আ. এর মাতৃভাষা সুরইয়ানী বা সিরিয়ার ভাষায় ইঞ্জিল ও হযরত মুহাম¥দ স. এর মাতৃভাষা আরবীতে আলকুরআন নাযিল করা হয়েছে।
‘আমি কুরআনকে আরবী ভাষায় নাযিল করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পার। সুরা ইউসুফ, আয়াত ০২।’
কোনো বক্তব্য ভাল করে বুঝা ও বুঝানো কেবল মাতৃভাষাতেই সম্ভব। মাতৃভাষায় কিতাব না হলে কাফিররা আপত্তি উত্থাপন করতো। সুরা হামীম সাজদা এর ৪৪ নং আয়াতে ঘোষণা হচ্ছে-আর যদি আমি কুরআনকে অনারব ভাষায় নাযিল করতাম তবে তারা অবশ্যই বলত এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হলো না কেন। এ কেমন কথা- অনারবী কিতাব আর আরবী ভাষাভাষী রাসুল।
ইসলাম শুধু মাতৃভাষা নয়, মাতৃভাষার আঞ্চলিক উপভাষাও সমর্থন করেছে মজবুতভাবে। খেয়াল রাখা হয়েছে আরবের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রতি। বুখারী শরীফের ২৪১৯ নং হাদীসে এসেছে-
‘কুরআনকে সাতটি উপভাষায় নাযিল করা হয়েছে। সুতরাং মাতৃভাষাকে গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়ার মতো ইসলাম ছাড়া আর কোথাও এমন উৎকৃষ্ট উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
বিশ্বখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে পৃথিবীতে ২৭৯৬ টি ভাষা রয়েছে। ঊঃযহড়ষড়মঁব নামের ভাষা বিশ্বকোষের ২০০৯ সালে প্রকাশিত ১৬ তম সংস্করণের হিসাব মতে পৃথিবীতে জীবিত ভাষার সংখ্যা প্রায় ৬৯০৯ টি। ইউকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৩৩০ টি ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে এতোগুলো ভাষার মাঝে প্রত্যেক জাতির কাছেই নিজ মাতৃভাষা অতি আপন, অতি প্রিয়, অতি শ্রদ্ধার। হৃদয়ের আবেগ মেটাতে পারে কেবলই মাতৃভাষা। কোন ভাষার সাথেই মাতৃভাষার তুলনা হয় না। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন – মাতা মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু।
ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও ভাষা শহীদদের মর্যাদা
কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আমাদের মুখের এ ভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। গায়ের জোরে আমাদের প্রভু বনে যাওয়ার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল তারা। ইসলামের দৃষ্টিতে বাঙালীর ভাষা আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ। এ আন্দোলন ছিল সত্যিকারের জিহাদ।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দম্ভভরে ঘোষণা করেছিল – একমাত্র উর্দূই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার এ ঘোষণার প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আমাদের বাংলাভাষাভাষী সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে ছাত্র সমাজ দুর্বার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শত বাধা, বিপত্তি, নির্যাতন, নিপিড়ন উপেক্ষা করে এমনকি ১৪৪ ধারা অতিক্রম করে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে রাস্তায় নেমে আসে বীর বাঙালী সন্তানরা। জুলুমের বুলেট বুক পেতে নিয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ে রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত সহ নাম জানা না জানা কত ভাষা সৈনিক। রচিত হয় কত মর্মস্পর্শী ভাষার গান। তরান্বিত হয় আন্দোলন। শেষতক ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তথা ৮ ফাল্গুন আমরা ফিরে পাই আমাদের মুখের ভাষা, মাতৃভাষা, বাংলায় কথা বলার অধিকার। স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে জাগরুক হয়ে থাকে সেসব ভাষা সৈনিক, যাদের রক্তের বদলায় নতুন করে লিখা হয় বাংলাভাষার নাম। পৃথিবীতে ভাষার তরে আন্দোলন করতে হয়েছে, মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে- এ ইতিহাস কেবলই বাঙালী জাতির। মাতৃভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করেছে এমন নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে শুধুই বাঙালীর। মাতৃভাষার প্রতি এ অকৃত্রিম ভালবাসাকে স্মৃতিময় করে রাখতে ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর অধিবেশনে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আজ জাতিসংঘের অধীনে প্রায় ১৮৯ টি রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালন করা হয় আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারিকে। এর চেয়ে আর গৌরব আমাদের কী থাকতে পারে! এ সব গৌরবগাঁথা কৃতিত্ব ও অর্জন একমাত্র আমাদের ভাষা সৈনিক ও ভাষা শহীদদের আত্মোৎসর্গের কারণেই। কিয়ামত পর্যন্ত আমরা তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে বাধ্য।
আমরা কি পারব, তাঁদের এক ফোঁটা রক্তের ঋণ কোন দিন শোধ করতে? যাঁরা জীবনের চেয়েও মাতৃভাষাকে মূল্য দিয়েছে বেশি-সেক্ষেত্রে আমরা ভাষার জন্য কি করতে পেরেছি? এতো কিছুর পরেও আমরা কি সেই ভাষাকে সর্বস্তরের অফিসিয়াল ভাষা ও উচ্চ শিক্ষার বাহন হিসেবে চালু করতে পারিনি। অনেকে ইংরেজিতে দু একটা শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করতে পারাটা আভিজাত্যের প্রতীক মনে করছি, স¦াচ্ছন্দ্য বোধ করছি।
অতি লজ্জার বিষয়- আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত অনেকের বাংলা উচ্চারণে প্রচুর হাস্যকর ভুল পরিলক্ষিত হয়। আর প্রিয় নবী স. বলেন- আমি আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। এটা কোন কবি সাহিত্যিক বা মিথ্যাবাদীর দাবী নয়। বরং পৃথিবীর সবচেয়ে সত্যবাদী মানুষটি মাতৃভাষার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। কোনদিন একটি অশুদ্ধ বাক্য তিনি উচ্চারণ করেননি। মাতৃভাষায় দক্ষতার্জন করা একটি সুন্নত, একটি ইবাদত। প্রতি বছর কেবল ২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই আমাদের তরুণরা ভাষাপ্রেম প্রদর্শনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যার অনেকটাই লৌকিক। কারণ, তারা সারা বছর হিন্দি গান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর বইয়ের শিরোনামে বানান ভুল এমন বইও ২১ এর বইমেলায় ঢুকে পড়ে। বানান ভুল এমন সাইনবোর্ড ব্যানারও বইমেলার শোভাবর্ধন করে। এটা কি আমাদের লজ্জার বিষয় নয়? তাই আসুন -মাতৃভাষায় পাণ্ডিত্যার্জন করি, নাগরিক হিসেবে এটি প্রথম কর্তব্য, মুসলিম হিসেবে এটি উৎকৃষ্ট জিহাদ। আমাদের সকলেরই উচিৎ ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি মাগফিরাত ও মুক্তি মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বেহেশতের শ্রেষ্ঠতম কল্যাণ দানে ধন্য করুন। আর তাদের বিদেহী আত্মার প্রশান্তির জন্য, জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য, বিশ্বে বাঙালীর সম্মানজনক পরিচিতির জন্যই আমাদের বাংলাকে গুরুত্ব দেয়া দরকার। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্যিকারভাবে মাতৃভাষার গুরুত্ব দিয়ে ভাষা শহীদদের মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার তাওফিক দান করুন। আমীন।

Comments

comments

About

Check Also

ইডেন লাইফ কষ্টের

ইডেন নিযে় মুখ খুললে শেষ হবে না। কিসের লেখাপড়া? সতিত্ব নিযে় বেঁচে থাকাই দায়। শুধু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *