স্মৃতির ডাক

জানুয়ারি মাস, সবেমাত্র বিয়ের দু’মাস হয়েছে। প্রতিরাতেই রাত গভীর হলে পাশ থেকে চুপিচুপি বর উঠে চলে যায়। আয়েশা আগে টের পায়নি কিন্তু তিন দিন হলো খেয়াল করেছে, প্রতিদিন একই ঘটনা। আশেয়া ঘুমিয়ে পড়লে নিস্তব্ধ গভীর রাতে নাহিদ কোথায় যেনো চলে যায়, ঘণ্টা দুই তিন পরে আবার ফিরে এসে যথারীতি শুয়ে পড়ে।
আশেয়ার সন্দেহ জাগে, কষ্টে বুকের ভেতর চিনচিন করে, প্রবল কান্না পায়। এভাবে নাহিদ আমাকে ঠকালো, ওর শুধু এই একটাই ভাবনা! একটা মানুষকে অবলম্বন করে ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠা সেই বাড়ি, উঠোন, গভীর সখ্যতার আঙিনা, পরিচিত গ্রাম, মানুষগুলো আর সবচেয়ে সত্য শাশ্বত সম্বন্ধ, নিখাদ নিঃস্বার্থ মায়ার মুখ বাবা-মা তাদেরকে ছেড়ে চলে এসেছি শুধুমাত্র এই একটা মানুষের ভরসায়, একটা মাত্র সম্পর্কের জোরে, আজীবন পাশাপাশি একসাথে চলার প্রতিশ্র“তিতে।
বিয়ের দিন চলে আসার সময় মা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আজ যে ঘরে যাচ্ছো, ওটাই মেয়েদের আপন ঘর; যার হাতে তুলে দিলাম তোমাকে, আজ থেকে সেই তোমার সবচেয়ে আপনজন মনে রেখো মা।’
নাহিদ ফ্রেশ হতে হতে আয়েশা আজ অফিসে মিটিং আছে একটা ফরেন টিমের সাথে, সো আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে অফিসে।’
‘কাল রাতে তুমি আমাকে সেটা বলবা না!’
অন্যদিন হলে আয়েশা ঠিক বলতো।
কিন্তু আয়েশা আজ কিচ্ছুটি বললো না।
বুকের মধ্যে সাগরের মত কান্নার ঢেউ নিয়েও সে চুপ,স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা।
আয়েশা জানে, সবসময় সবকিছুতে আগেই উত্তেজিত হলে চলে না, অন্তত সংসারে, সম্পর্কে করতে নেই, তাহলে সংসার টেকে না।
পরিস্থিতির সবটা নিখুঁতভাবে বুঝে, তারপর গভীরভাবে ভেবে বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, আবেগের প্রশ্রয় দিয়ে বাস্তবতার বিশ্লেষণ চলে না, উপসংহার টানা যায় না।
সংসার টিকিয়ে রাখতে, স্বামী আগলে রাখতে সব মেয়েরাই জানে, কারণ মেয়েদের মধ্যে একটা নারীত্ব থাকে সকল অবস্থায় সর্বদা।
সকালের নাস্তা টেবিলে দিয়ে আয়েশা নাহিদকে ডাকলো।
নাহিদ-আয়েশা তুমি খাচ্ছো না যে! তুমি খাবে না?
আয়েশা-খাবো পরে, তুমি খাও।
নাহিদ-পরে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?
আয়েশা-না, খিদে নেই। আর গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেম করছিলো সো ট্যাবলেট খেলাম, আধাঘণ্টা পরে খাই।
নাহিদ-আমাকে আগে বলবে না সেটা? বেশি খারাপ লাগছে?
ডাক্তারকে ফোন দিবো?
আয়েশা-আরে বাবা তেমন কিছু না, সিম্পল তো।
তুমি খাওতো। টাইম দেখছো? অফিসের লেট হয়ে যাবে তো!
নাহিদ-কিন্তু তুমি?
আয়েশা-বললাম তো আমি ঠিক আছি।
নাহিদ-প্রবলেম ফীল হলে আমাকে কল দিও।
আয়েশা-ওকে।
নাহিদ অফিসের উদ্দেশ্যে দরজা থেকে বের হল।
‘সমস্যা হলে কল দিও কিন্তু, আমি চলে আসবো এনি টাইম, মিটিং ভেবে আবার…’ কথা শেষ না হতেই
‘তুমি এত টেনশন নিচ্ছো কেনো, ইট’স ওকে সিম্পল ম্যাটার!’
দরজাটা অফ করে বেডরুমে চলে এলো আয়েশা।
এতক্ষণ যে ঢেউগুলো বুকের ভেতর খুব কষ্টে আটকে রেখেছে তা বোধহয় এবার দুচোখের পাড়ে আছড়ে পড়বে, আর আটকে রাখা যাচ্ছে না কোনভাবেই।
আপনজন!!
এ কেমন আপনজনের হাতে আমাকে তুলে দিলে মা?’
ভারি জমাট মেঘ প্রবল বর্ষণ শেষে খানিকটা হালকা হয়, আয়েশার বুকেরমধ্যের কষ্টের গভীর গাঢ় মেঘও ঝরায় কিছুটা তাই হলো, তীব্রতা কমলেও বৃষ্টি বন্ধ নেই।
এ জলধারা বন্ধ হবারও নয়। প্রতিশ্র“তির উজ্জ্বল আকাশ কালো মেঘেদের দখলে চলে গেলে সেই বৃষ্টি এমনই অঝর অবিরত ঝরতে থাকে।
রাত দেড়টা, নাহিদ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো,আয়েশাও নাহিদের পিছুপিছু নিশ্চুপ অনুসরণ।
নাহিদ ক্রমাগত হেঁটে চলেছে একটা প্যাকেট হাতে।
আয়েশাও অতি সাবধানে পশ্চাদগামী।
স্টেশনের কাছাকাছি প্রায় এসে পড়েছে।
এদিকওদিক নাহিদ কাকে যেনো খুঁজছে।
কিন্তু কাকে?
কেউ কি আসার কথা?
এতরাতে এখানে কে-ই বা আসবে?
প্লাটফর্মে, স্টেশনের মেঝে জুড়ে, থামের কোলঘেঁষে অসংখ্য মানুষ শুয়ে আছে।
মানুষ পশু পাশাপাশি পরিবারের মত, আপনজনের মত। যেভাবে ভাইবোন মা বাবা একসাথে শুয়ে থাকে!
কনকনে ঠান্ডার হিম পড়া রাতে শুধু একটা পাতলা ছেঁড়া কাঁথা বা কম্বল কিংবা পাটের বস্তা, চট গায়ে জড়িয়ে শিশুগুলো শুয়ে আছে। একই পৃথিবী একই দেশ হয়েও এ এক অন্য গ্রহ অন্য জগত, মানুষ হয়েও অন্য প্রাণী আলাদা বৈশিষ্ট্যে অসীম শক্তির!
‘অসীম শক্তির’ হ্যাঁ, অসীম শক্তি বলেই হয়তো প্রতিনিয়ত এভাবে যুদ্ধ করতে পারে, জীবনের সাথে জগতের সাথে।
তবে দুনিয়ার সকল যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের পার্থক্য ব্যাপক।
অন্যসকল যুদ্ধে দুইপক্ষই দু’পক্ষকে আঘাত করে, পরস্পরকে রক্তাক্ত করে।
কেউ কাউকে ছাড় দেয়না।
আর এখানে গৃহহীন, ঠিকানা বিহীন মানুষগুলো জীবন-জগতের সাথে যুদ্ধ করলেও কাউকে আহত করে না, অথচ আঘাতপ্রাপ্ত হয় সবসময়!
তুচ্ছতাচ্ছল্য, হীন, অবজ্ঞা ওদের নিয়মিত পাওনা একটু খাবার, দুটো পয়সা চাইলে!
ধনীদের সম্পদ অর্থের মধ্যে ওদের যদিও হক আছে তবুও!
একটা ছোট্ট শিশু মাকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে একটু ওমে ঘুমিয়ে আছে। একটা পাতলা কম্বলে বাচ্চাটার শরীরটা ঢাকা তাও জায়গায় জায়গায় ছেঁড়াফাটা, মায়ের গায়ে একটা চট।
নাহিদ কিছুটা দূরে বসা ছেলেটার থেকে।
অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে আছে।
কী দেখছে নাহিদ অমন করে?
মায়ের বুকের গভীরে জড়িয়ে থাকা সন্তানের সুখ? প্রশান্তি?
নাকি প্রচণ্ড ঠান্ডায় মা এবং সন্তানের কাতরতা?
মানুষের অসহায়ত্ব? কেউ জানে না।
চোখ থেকে গাল বেয়ে নাহিদের অশ্র“ ঝরে।
নাহিদ একলা কাঁদে। গাড়ি বাড়ি ব্যাংক ব্যালেন্সের মালিক নাহিদকেও হঠাৎ খুব অসহায় দেখায় শুয়ে থাকা ওই মানুষগুলোর মতই!
সবকিছু থাকার পরেও নাহিদের এমন অসহায়ত্ব কেন?
সে তো নিঃস্ব রিক্ত নয়। সবচেয়ে আপন মানুষটাকে কাঁদতে দেখে দূরে দাঁড়িয়ে আয়েশার চোখ ভিজে যায়, কাঁদতে থাকে আয়েশা। জানি না সে কী বুঝলো তবে আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে বাসায় চলে এলো।


ভীষণ কাঁদলো তারপর।
হয়তো এই কান্না স্বামীকে ভুল বোঝার। অনুশোচনার কিংবা অর্ধাঙ্গিনী হয়েও পুরোটা না হতে পারার। আবার হতে পারে নাহিদ তার অর্ধাঙ্গ হয়ে উঠতে পারেনি আজও সেই অভিমানের।
যাই হোক অভিযোগটা তো থেকেই যায়। আল্লাহ্ পাক পবিত্র কুরআন মজিদে স্বামী-স্ত্রীকে একে অপরের পোশাক বলে ইরশাদ করেছেন, তাহলে কেন দূরত্ব?
কেন একে অপরকে সবটা বলতে পারবে না?
দুজন দু’জনের ভালোমন্দ সবকিছু মেনে নিতে পারবে না? কেনো হবে না সমস্ত সুখ-দুঃখের অংশীদার?
এক হয়েও আড়াল থাকবে কেন এতোটা?
নাহিদ ঘরে ঢুকে দেখে আয়েশ বসে!
নাহিদের চোখ লাল।
খানিকটা ত্রস্ত অপ্রস্তুতভাবে
নাহিদ-এতরাতে তুমি বসে কেন আয়েশা?
আয়েশা-কোথায় গেছিলে তুমি এত রাতে?
নাহিদ চুপ।
কোনো কথা বলে না।
অতঃপর :
আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে নাহিদ ছোটো বাচ্চার মতো কাঁদে!
আয়েশা-কি হয়েছে তোমার?
এভাবে কাঁদছো কেন? আমাকে বলো! কি হয়েছে?
ছোটবেলায় মনের মধ্যে তাড়া থাকে কবে বড়ো হব!
দেখতে দেখতে মানুষ এক সময় সত্যিই বড়ো হয়ে যায়। সকলের চোখে সে বড় মানুষ। কিন্তু বুকের ভেতর সকলের একটা বাচ্চা মানুষ, ছোট্ট মানুষ থাকে, শিশু মন থাকে।
সেই মনটা সবসময় চায় ছোট্টবেলার মতো মা-বাবা সারাজীবন আদর করুক, ভালো বাসুক।
ছোটবেলায় না চাইলেও বড়োবেলায় চায়, মা খুব শাসন করুক সেই আগের মতো।
বুকের মধ্যে আগলে রাখুক, জড়িয়ে ধরুক।
অনেকক্ষণ কান্নার পর ‘আজ আমি বলবো, তোমাকে সব বলবো আয়েশা।’
‘আমি স্টেশনে গেছিলাম। এক সপ্তাহ হলো রোজ রাতেই যাই। শুধু এবার না প্রতি শীতেই প্রায় রাতে আমি স্টেশনে যাই।’
আয়েশা-কেন?
নাহিদ-পঁচিশ বছর আগে আব্বা মারা গেছে, মা মারা যাওয়াও পাঁচ বছর হলো তুমি জানো।’
আয়েশা-হুম জানি তো।
নাহিদ-আব্বা দিনমজুর ছিল। আমাদের আর্থিক অবস্থা কোনো দিনই ভালো ছিল না, আব্বা মারা যাওয়ার পর আরো খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আমার বয়স তখন চার, নিলার দুই আর মিলা ছয় মাসের। আমাদের ছোটো ছোটো তিন ভাইবোনকে নিয়ে কী করবে তখন মা!
নানা মারা গেছে নানি বিছানায় অসুস্থ। মামিরা তাকেই দেখতে চায় না, মা’কে রাখবে তারা?
সাথে আবার আমরা ছোটো ছোটো তিন ভাইবোন! দাদা-দাদি বেঁচে নেই। চাচারা আলাদা, সকলে দিনমজুর। শুধু মাত্র দুচালা ঘরটুকুই আমাদের সম্বল!
মা আমাদের নিয়ে শহরে চলে আসে। বাচ্চাসহ কেউ কাজে নিতে চায় না বাড়িতে।
সে এক ভয়াবহ বিচ্ছিরি পরিস্থিতি!
কাজ নেই, খাবার নেই, থাকারও জায়গা নেই!
আমরাও ওভাবে স্টেশনে শুয়ে থেকেছি, কতরাত কাটিয়েছি খোলা আকাশের নিচে!
ওই মানুষগুলোকে দেখলে আমাদের সেই দিনগুলো মনে পড়ে! ওদের মধ্যে আমাদের সেইসব দিন আমি দেখতে পাই!
শীতকাল আসলে আমি ঘুমাতে পারি না আয়েশা! ঘুমের মাঝে আর্তনাদ শুনি! প্রচণ্ড শীতে মানুষের কাতরতা শুনতে পাই! একটু উষ্ণ বস্ত্রের আকাক্সক্ষায় ছলছল চোখ দেখি!
মায়া-মমতার তৃষ্ণার্ত মুখ দেখি আমার মত, আমার ছোটো বোনদের মতো! সেজন্য ছুটে যাই।
পাঁচ’শ হাজারখানেক কম্বল বিতরণের মাঝেও শান্তি পাই না, যেটুকু পাই ওদের পাশে পাঁচ মিনিট বসে, আমার ছেলেবেলায় ফিরে গিয়ে। কাল মায়ের মতো একজনকে দেখেছি ছোটো বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্ট করতে, আজ সোয়েটার আর কম্বল দিয়ে এসেছি।
আমার মাও এমন কষ্ট করেছে!
মা যে কী কষ্ট করেছেন তোমাকে বোঝাতে পারবো না আয়েশা!
কীভাবে আমাদেরকে মানুষ করেছেন!
আমাকে বড় করেছেন! লেখাপড়া শিখিয়েছেন! আজ আমার সব আছে কেবল মা নেই!’
নাহিদ ছোট্ট বাচ্চার মতো কাঁদছে!
‘মা কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলো আয়েশা? কেন মা কষ্ট করলো, তার ছেলেকে মানুষ করলো, লেখাপড়া শেখালো অথচ তার সন্তানের সাফল্য দেখলো না, সুখ ভোগ করলো না?
মায়েরা কষ্ট করে সুখ ভোগ করে না কেন? মা’গুলো এমন হয় কেন বলতে পারো আয়েশা?’

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *