সোনালি আঁশের গন্ধে মুখর গ্রাম

সুবহে সাদিকের স্নিগ্ধ মায়ায় আলোর কুসুম পাপড়ি মেলছে। মায়ের পীড়াপীড়িতে হালকা নাস্তা করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গাড়িতে জানালার পাশে সিট পেয়ে ভাবলাম রাতের ঘুমটা পুষিয়ে নেব। গাঁও গেরামের রাত সাধারণত সন্ধ্যাতেই গভীর হয়ে ওঠে। চারদিকে নেমে আসে শুনশান নীরবতা। কানে কানে বিলি কেটে জেগে ওঠে রাতের প্রাণিরা। ঘুম পরীরা চোখের পাতায় বিছিয়ে দেয় মায়াবী মোহ। এমন মোহনীয় আবেশে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমের রাজ্যে উড়ে গিয়েছিলাম গত রাতে। কিন্তু মাঝ প্রহরে পালাক্রমে মুঠোফোনের ডাকাডাকি ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। এরপর কিছু সময় এপাশ-ওপাশ করে ঘুম পালানো বাকি রাতটুকু গল্প লিখে কাটিয়ে দেই। রাতের ঘুম পোষাতে তাই গাড়ির সিট কিছুটা পেছনে হেলিয়ে চোখ বুজলাম।
গাড়ি হেলে-দুলে এগিয়ে চলল। কিছু দূর যেতেই ফরমালিন মুক্ত পাট পঁচা গন্ধে কুটকুট করে উঠল নাক। এ গন্ধে মিশে আছে গ্রাম্য জীবনের প্রেমোময় সংগ্রামী পরশ। ঘুম রেখে সোজা হয়ে বসে জানালা আরেকটু খুলে দিলাম। ফুরফুরে বুনো হাওয়ার শীতল পরশে দৃষ্টি মেললাম ভোরের প্রকৃতিতে। শহুরে খাঁচায় বন্দি চোখের শুষ্ক ফ্রেমে ভেসে উঠতে লাগল রূপসী বাংলার অপরূপ শিহরণ। এ সাঁঝ-সকালেই রুটি-রুজির সন্ধানে মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়েছে কৃষাণ-কৃষাণীরা। খাল-ডোবাগুলো পানিতে থই থই করছে। দু-এক জায়গায় ভেসাল পেতে বসে আছে জেলেরা। উপরে তোলা একটা ভেসালে দেখলাম সাদা মাছের অপূর্ব লাফালাফি। নান্দনিক একেকটি দৃশ্য পেছনে ফেলে আরেকটি দৃশ্য হাজির করছে গাড়ির চাকা। আমার পলকহীন নেত্র একে একে গাঁথছে গ্রাম্য লীলার স্বর্ণালী মালা।
গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাটের ছড়িয়ে পড়া এসব সাধারণ মানুষের অনেকেই মরিচ ডলে পান্তা খেয়ে কাজে নেমেছে। আবার কারো পেটে হয়তো দুপুরের আগে তাও জুটবে না। তাতে কী! আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে উদোম গায়ে মালকাছা দিয়ে মাথায় গামছা পেঁচিয়ে কাদা-পানিতে নেমে পড়েছে। এ মৌসুমটা পাট চাষের। কৃষাণেরা কেউ কেউ নতুন পাট কাটতে বা জাগ দিতে ব্যস্ত, কেউ আবার জাগ দেয়া পঁচানো পাট আঁছড়ে-পাঁছড়ে ধুচ্ছে। বসে নেই কৃষাণিরাও। তারা রাস্তার পাশে পাশে, উঠানে বসে খড়ি থেকে পাট আলাদা করছে। কেউ আবার পাট খড়ি শুকাতে আটি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আর যাদের এসব কাজ আগেই শেষ হয়েছে তারা শুকনো পাট মাথায় করে গন্তব্যে ছুটে চলছে। সে পাটের উপর সূর্যের রশ্মি প্রতিবিম্ব হয়ে সোনালি বদনে জ্বল জ্বল করছে। আমরা হয়তো অজান্তেই বলে ফেলেছি সোনালি আঁশ। অজস্র লড়াইয়ের পর মাটি থেকে বের হয়ে আসে এই সোনা। ছুটে চলা গাড়ির জানালায় বসে পাট চাষের আলাদা আলাদা এক-একটি দৃশ্য কুড়িয়ে মালা গাঁথতে থাকলাম এভাবে।
হঠাৎ গাড়ি স্লো হতে হতে থেমে গেল। জানালা থেকে চোখ সরে পাশের সিটের লোকটার দিকে গিয়ে থামল। মুখ তার বিড়বিড় করছে। ‘দালালের বাচ্চাগুলার জন্য মানুষের দূর্ভোগের শেষ নেই। সাধারণ মানুষ কষ্ট কইরা ফসল ফলাইয়া দূর দূর দিয়া হাটে পাট বেচতে নিয়া আইছে। আর হারামীরা বাজারে ঢুকতে না দিয়া রাস্তার উপরেই ডাক উঠাইয়া কম দামে লুইটা নেবে। ব্যবসা জুইড়া দিছে রাস্তার উপর। খালি খালি রাস্তা আটকাইয়া যায়। ঘুষ খাইয়া ঠোলার জাতের মুখও বন্ধ। কেউ কিচ্ছু কওয়ার নাই।’
তার কথা শুনতে শুনতে আমি বাস্তব চিন্তায় ফিরে গেলাম। আমাদের সরকারি অনিয়মের কারণেই মূলত বাংলার এ ঐতিহ্য আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। এই সোনালি আঁশই এক সময় বাংলার প্রধান বৈদেশিক আয়ের খাত ছিল। আজ ২০ টাকার নোট থেকেও মুছে গেছে সোনালি আঁশের ছবি। বিপন্ন এ শিল্পকে আজ গ্রাম বাংলার কিছু মানুষ যখন হাড় ভাঙা খাটুনিতে জীবিকার তাগিদে বাঁচিয়ে রেখেছে, তখন তাদের উপর অভিশাপ হয়ে চেপে বসেছে দালাল নামের শুয়োর শ্রেণি। সরকারি গুদামও আজ ওদের দখলে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঝড়-ঝাপটা, রক্ত পানি করা শ্রম শেষে বয়ে আনা পাটের উপর যখন দালাল হায়েনারা কেদ্দারি দেখায়, তখন বোবা কেঁদে কারো কারো বাড়ির পথ ধরা ছাড়া উপায় থাকে না। তাদের ঘরের দুয়ার আড়াল করে আগের থেকেই দাঁড়িয়ে থাকে সুদী মহাজন। একরাশ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠানে পা রাখতেই কেঁপে ওঠে কৃষাণের বুক। কতটা মর্মান্তিক এ প্রহসন! তাদের প্রতিটি দীর্ঘ শ্বাস যেন এক একটি অভিশপ্ত আসমানী সমাধানের অপেক্ষা! জটলা ছাড়িয়ে আবার এগিয়ে চলে গাড়ির চাকা। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই পাশে বসা লোকটার মুখের বদলে নাক ঝিরঝির শুরু করে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *