সাড়ইল একটি গ্রামের নাম

লাহিনের মন ভাল নেই। পরীক্ষা শেষ হয়েছে। স্কুল বন্ধ। মাঠের সোনালী ধান কাটা হয়েছে। সূর্যডুবা সময়ে মাঝে মাঝে বসা হয় বটগাছের নীচে। এখানে বসে সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভাল লাগে। আকাশে বাহারি রঙ্গের আয়োজন। ধান কাটা মাঠের নাড়াতে বসে কয়েকটি ফিঙে কতই না মজা করছে। ফড়িং ইড়ছে।
প্রজাপতি ঘাসের বুকে কখনো বসে কখনো উড়াল দেয়।
কী দুষ্টোমিই না করে প্রজাপ্রতি গুলো।
মাঝে মাঝে লাহিনের ইচ্ছে করে প্রজাপতি হতে।
প্রজাপতি হলে ফুলের বুকে বসা যায়।
ঘাসের সাথে বন্ধুত্ব করা যায়।
বটগাছের পাশ দিয়ে সুতোর মত বয়ে গেছে একটি খাল। আঁকাবাঁকা। যেন কোন শিল্পের তুলিতে আঁকা। লাহিন যদি নদী হত?
কেমন আছো লাহিন?
ছোট মামার ডাকে আনমনা ভাব থেকে ফিরে আসে লাহিন। ছোট মামার দিকে চায়। ছোট মামা তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন?
কেন সুন্দর লাগছে তা তুমি একটু বল না বাবা।
সত্যিই বলব ছোট মামা?
তোমার শরীরের সুন্দর পাঞ্জাবীটাই তোমাকে আজ অন্যরকম ভাবতে মন কে নাড়া দিচ্ছে।
আচ্ছা আর পাকামো করতে হবে না।
লাহিন মুচকি হাসে।
ছোট মামাও।
আচ্ছা ছোট মামা তোমার পরনের পাঞ্জাবীটার রঙ সবুজ কেন?
কেন বুকের উপর সবুজ কাপড়ে সূর্যের মত লাল রঙের এমন খেলা?
ঠিক যেন আমাদের জাতীয় পতাকার মত, তাই না লাহিন?
ঠিক তাই ছোট মামা।
লাহিন বলতো এখন কোন মাস চলছে ?
ডিসেম্বর।
বলতো ডিসেম্বর কিসের মাস?
কেন ছোটমামা? তুমি না ডিসেম্বর এলেই আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বল। বিজয়ের গল্প বল।
ডিসেম্বর তো বিজয়ের মাস তাই না?
লাহিন তুমি ঠিক বলেছ। তোমার তাহলে মনে আছে। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে। স্বাগতম।
ছোটমামা একটা গল্প বল না। অনেক দিন হল তোমার মুখে কোন গল্প শুনিনা। আমার মনটাও আজ খুব ভাল নেই।
মন ভাল নেই কেন বাবা?
পরীক্ষা শেষ।
কোথাও বেড়িয়ে আসলে হয় না।সবাই ব্যস্ত। আমি কেবল বসে বসে সময় কাটাতে পারি না। ছোটমামা তুমি আসলেই আমার সময় ভাল কাটে।

তুমিই আমার প্রজাপ্রতি।
তুমিই আমার নদী।
তুমিই আমার সূর্য। রঙিন আকাশ। হা: হা: হা:। তাই তো?
চল, তোমাকে আজ একটি গল্প শুনাই।
হ্যাঁ হ্যাঁ বলে ফেল তাড়াতাড়ি।
ঐ দেখছ সবুজ গ্রাম, নাম তার সাড়ইল। সবুজ গাছে পাতা ভরা, নানা রঙের ফুলে ভরা, মানুষের মায়াভরা দারুণ একটা পরিবেশ। এ গ্রামটা বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে।
কিভাবে ছোটমামা ?
এ গ্রামের একটি ফুল তার সৌরভ দিয়ে আমাদের গর্বিত করেছে। কী রকম ফুল ছোটমামা?
গোলাপ-জবা-কৃষ্ণচূড়া-না পলাশ।
না লাহিন আমি এইসব ফুলের কথা বলছি না। তাহলে? আমি বলছি আবুল ফুলের কথা।
ভাল নাম আবুল কালাম আজাদ খাঁন। ছায়াঘেরা, মায়াভরা একটি পরিবেশে তার জন্ম। আবুল তখন কিশোর। শ্রীমঙ্গলে ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র। গ্রীষ্মের আম কাঁঠালের ছুটি কাটাতে বাড়ীতে আসে। এমন সময় এলো যুদ্ধের ডাক। আবুল ঘরে বসে থাকতে পারে না। বন্ধু লাল মিয়া ও আব্দুল হককে নিয়ে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে ঘর থেকে পালিয়ে যায়।
সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ ছেলেরা কোথায় যায়?
ভেবে পায় না কিছুই।পথে গোবিন্দগঞ্জে পশ্চিমা হানাদারদের কবলে পড়ে তারা। সাহসের সাথে তাদের সাথে চলে বাক-বিতন্ডতা। এমন সময় ছাতক থানার মাধবপুর নিবাসী আব্দুল কুদ্দুসের সহায়তায়, আবুলরা পশ্চিমাদের হাত থেকে রেহাই পায়। মনের কথা বলে তিন কিশোর। তারা যুদ্ধে যাবে। আব্দুল কুদ্দুস তাদেরকে ভারতে পাঠিয়ে দেন। আবুল, লাল মিয়া, আব্দুল হক নসিমপুর বাজার হয়ে বাশঁতলা ক্যাম্পে পৌঁছে।
তারপর থেকে শুরু হল প্রশিক্ষণ। মোজাহিদ কমান্ডার আব্দুল তাদের তালিকা ভুক্তি করেন।সেখানে জড়ো হওয়া আরও কিছু লোকের সাথে তাদের কে মেঘালয়ের ইকোওয়ানে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। এখানে ৫, ৬, ও ৭ নং ব্যাচের প্রশিক্ষণ একসাথে হয়।এই ব্যাচের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। জগৎজ্যোতি দাসের কমাণ্ডে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে তাদের কে ভোলাগন্জ সাব-সেক্টরে পাঠানো হয়। ইয়ামিন চৌধুরী ছিলেন এখানকার কোম্পানী কমান্ডার। তার অধিনে আবুল, লাল মিয়া, আব্দুল হক আলফা কোম্পানীতে যোগ দেয়। এ দলটিকে নির্দেশ দেয়া হল তিলখাল, বুড়ির ডহর, দন্তর গাঁও, গৌরিনগর, আলমপুর ও রামপুর আক্রমণ করার জন্য। পাক-হানাদের সাথে এই দলটি এখানে সম্মুখ যুদ্ধে অগ্রসর হয়। সম্মুখযুদ্ধ চলাকালে প্রাণহারায়-এনাম, ফেলন, ও পি.কে সরকার। তাদের কে হারিয়ে মনোবল হারায় নি যোদ্ধারা। সাহসের সাথে লড়তে থাকে পাক-হানাদের সাথে। যুদ্ধের শেষ দিকে তারা মাহবুবের কোম্পানির অধীনে থেকে টুকের বাজার সেতু তারা ধ্বংস করে।
তারা আবার সংঘটিত হয় ভোলাগঞ্জে। আবার শুরু হয় পাক-হানাদারদের উপর গুলি।
বার বার আক্রমণের ফলে পাক-সেনারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এই দলটি তখন বাদাঘাটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। বাদাঘাটে আসার পরে আবারও পাকবাহিনীর সাথে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে পাক-হানাদার বাহিনী সিলেট শহরের দিকে পালাতে থাকে। এভাবে বাদাঘাট শত্র“মুক্ত হয়।
তারপর কী হল ছোট মামা ?
তারপর….
কিছুদিন পরে এই মুক্তিযোদ্ধা দলটি খবর পেল, পাক-সেনারা আত্মসমর্পণ করেছে। তারা জয় বাংলা ধ্বনিতে উল্লাসে মেতে উঠে।
তারা অস্ত্র জমা দেয় আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আলমগীর সাহেবের কাছে।
তারপর বাড়ি ফেরা।
এখন বুঝলেতো সাড়ইল গ্রামের সাথে বাংলাদেশের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। খুব বুঝলাম।
ছোটমামা আমাকে একদিন নিয়ে যাবে সাড়ইল। অবশ্যই নিয়ে যাব বাবা।
এখন চল ঘরে ফিরে যাই।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *