শিশুর মন

পটুয়াখালী থেকে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে সারা রাত নদী দিয়ে স্টিমারে চলছি। শহরে উঠে আপার কাছে যেতে যেতে সকাল সাড়ে আট-টা প্রায়। দীর্ঘ সফরের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়াছি। ঠিক এমন সময়ই ভাগ্নি ফারিহার স্কুলে যাওয়ার সময়। দীর্ঘ এক বছর পর মামাকে পেয়েছে, ঠিক এই দারুণ মুহুর্তে আমাকে ছেড়ে স্কুলে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। কিন্তু স্কুলেও যেতে হবে। একপ্রকার বিষন্ন নিরাণন্দ ভাবে তার স্কুলের সময়টা কাটবে এ উপলদ্ধি করে ফারিহার সাথে আমিও রওনা দিলাম মনিপুর স্কুলে।
ফারিহার বয়স সাত বছর। তার এবং আমার মধ্যে ভক্তির সীমা ছিল না। আমার ক্লান্তি ভাব দেখে তার অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠল। অন্যদিকে আমাকেও ছারতে চাইছে না। উপায়ন্তর না দেখে তার চাওয়াকে প্রধাণ্য দিয়ে বলল, আমার জন্য আজকে কষ্ট করো। আমিও ফারিহাকে পেয়ে ভুলে গেলাম ক্লান্তি। সেই আবেগময় মুহুর্তে আমাদের ভালোবাসার কাছে ক্লান্তি ঝড়ের বেগে দৌড়ে পলালো।
জামা-কাপড় পাল্টানোর কারণে হাহাকার পড়ে গেল পকেটে। এ দুর্ভিক্ষ দেখে অন্য জামা থেকে একশত টাকা নিয়ে পকেটকে খেতে দিয়ে নিবারণ করলাম তার ক্ষুদা। বন্ধ হয়ে গেল পকেটের চ্যাঁচানো। শান্ত হৃদয়ে উৎফুল্ল মনে ফারিহার হাত ধরে সিড়ি বেয়ে নামছি।
গেটের কাছে যেতেই দেখলাম ভিক্ষা করছে একজন ফকির। ফারিহার সাথে আমাকে দেখে তার কেমন সংকোচ হচ্ছিল। তা দেখে আমিও তার ধরণÑধারণ লক্ষ্য করছিলাম। কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছে। ছেড়া কাপড়-চোপড় তার গায়ে। ভিক্ষুকের যে স্মৃতি থাকে ঠিক সেই অব¯’ায়। ফারিহা সুস্মিতা মুখে তার হাতে বিশ টাকা দিয়ে দিল। ফারিহাকে খুশি অব¯’ায় দেখে হয়তো কোন প্রশ্ন করেনি ভিক্ষুক। ফারিহার হাত ধরা দেখে মর্মাহতভাবে চেয়ে থাকল। আমাকে সন্ধেহ করছে তা নিশ্চিত। কিন্তু কেন! তা জানি না।
আমার মনে ক্ষটকা হল, এ কি ফকির না গোয়েন্দা! তাই ফারিহাকে জিজ্ঞেস করলাম; মামা, এটা কেমন ভিক্ষারি! আমার দিকে কেমন টিপটিপ করে সন্ধেহের চোখে তাকাল, তুমি লক্ষ্য করছ?
ফারিহা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, এই ভিক্ষুক প্রত্যাহ সকালে গেটে এসে দাঁড়ায়। একটা ম্যাজিক দেখবা?
কি?
চলো আবার গেটে যাই।
গিয়ে দেখলাম ভিক্ষুক নাই। ওখানে দাঁড়িয়ে রিকশা ডাক দিলাম, আর জানতে চাইলাম, কোথায় গেল সে ভিক্ষুক!
জানিনা, আমি ভিক্ষা দেওয়ার পর এখানে থাকে না।
রিকশা আসতে আসতে দেখলাম দুলাভাই ও সে ভিক্ষুক বাসা থেকে নেমে আসছে। আমাদেও দেখে ফেলামাত্রই ভদ্রতার হাসি বিনিময় করে রিকশায় উঠে চললাম স্কুলের দিকে। ভিক্ষুককে দেখলাম একটু লজ্জিত। কিছু রাস্তা অতিক্রম করার পর ফারিহা জিজ্ঞাসা করল,মামা-তোমার কাছে কত টাকা আছে?
বললাম, একশত।
দাও।

দিতেই সে আমাকে বিশ টাকা দিয়ে বলল, এটা পকেটে রাখো। ভদ্রের মতো কোন পাল্টা প্রশ্ন করলাম না। যা বলল তাই শুনলাম, তাই করলাম; বাধ্য মামার পরিচয় দিলাম। কোন প্রশ্ন জাগে নি মনে; কেননা বিশ্বাস ছিল ভরপুর।
স্কুলের সামনে যেতেই পাঁচজন ভিক্ষুক সামনে এসে দাঁড়াল। রিকশাওয়ালাকে বিশ টাকা ভাড়া দিয়ে ঐ একশত টাকা তাদের পাঁচজনকে বন্টন করে মৃদু হাসি ও মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা উপহার নিয়ে প্রবেশ করলাম স্কুলে। কিছুক্ষন পর চলে এলাম বাসায়।
বাসায় প্রবেশ করতেই আপা জানতে চাইল, তোর পকেটের কি বারোটা বাজিয়ে দিছে?
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সুচক সম্মতি দিলাম।
আপা অনায়াসেই হাসতে শুরু করল। বলল, তুই কি রাগ করছিস? তোর টাকা ভিক্ষুককে দেওয়ার জন্য!
আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আপা বলতে শুরু করল, গেটের সামনে যে ভিক্ষুকের সাথে দেখা হয়েছিল সে বাসায় আসছিল। কারন ফারিহার সাথে তোকে কখনও দেখে নাই। সে তোকে সন্দেহ করছে। তাই বাসায় এসে জেনে গেছে ফারিহার সাথে কে? বুঝলি তো! একটা ভিক্ষুকও ফারিহাকে কত নেক নজরে রাখে। তোর ভাইয়্যা যায় নি বলে তোর কাছ থেকে ধার নিয়েছে। উদ্দেশ্য শুধু কোন ভিক্ষুককে ফিরাবে না। কয়েকদিন থাকার পরই বুঝতে পারবি ফারিহার সব কর্মকান্ড।
ফারিহার উদারতা বুঝতে আমার দেড়ি হল না। বড় ভালো লাগলো আমার। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম ভিক্ষুককে। ভ্রু কুচকে গেলো আমার, চোখে একটু অশ্রুও এসে গেল। ভিক্ষুক হলেও ভালোমানুষি রয়েছে তার মধ্যে। সে নিজ থেকে ভালো- মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে বিচার করার শক্তি অর্জন করছে। ভিক্ষুকের এর চেয়ে বড় কৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে! অন্য কি আশা করা যায় তার কাছ থেকে!
কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম জানিনা। কিন্তু পায়ে সুড়সুড়ি পেয়ে জেগেছি। সেই থেকে এক সাথে খেলে একসাথে চলে বুঝতে চেষ্টা করছে তার শিশু মনের চাহিদা।
যে কয়দিন তার সাথে স্কুলে গেছি এবং নিয়ে আসছি রিকশা ভাড়া ব্যতিত বাকিটা ভিক্ষুককে দিয়ে দেয়। প্রতিদিনই ভিক্ষুকদের জন্য আলাধা টাকা নিয়ে বের হয়। ভিক্ষুক সামনে এসে দাঁড়ালেই টাকা দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়।
একদিনের ঘটানা।স্কুল থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় রিকশায় উঠার ঠিক পুর্ব মুহুর্তে এক ভিক্ষুক এসে করুন সুরে বলল, মা সকাল থেকে আমি কিছু খাই নি। অন্য কিছু বলার পুর্বেই হাত দেয়ে কর্ন চেপে ধরল। ইশারায় থামার জন্য বলল। ফারিহার চেহারার অব¯’া দেখে বুঝতে কষ্ট হল না যে, গরীবদের কষ্ট একদম সইতে পারে না। তার উদবেলিতহৃদয় গরীবকে সাহায্য করার জন্য সর্বদা প্র¯‘ত। রিকশা ভারাটা তার হাতে দিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে।
সব টাকা দিয়েও সে গর্ভ করে না।”ভিক্ষুকের জ্বালায় অ¯ি’র” এমন কথা বলা তো দুরের কথা, আমার কাছ থেকে প্রশংসাও পেতে চায় না। কিছু না বলেই ব্যাপারটা ওখানেই সমাপ্ত করল। সোজা আঙ্গুলে যখন কিছু হলো না তখন আঙ্গুল বাকা করতে হবে। মানে এ সম্পর্কে উল্টো বলেই জানতে হবে তার মনের অব¯’া কতটা দৃঢ়।
একটু গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, বিখ্যাত দানকারী হয়ে গেছ বুঝি?
আরে মামা-না, তুমি রাগ করো কেন? আর অমন কুটক্তি করে বলো কেন! মুলত আমার ভুরিটা একটু বেড়ে গেছে, তাই প্রচুর হাঁটা একান্ত দরকার। এজন্য ভাবলাম, টাকা থাকলে আলসেমিতে হাঁটা হবে না; তাই দিয়ে দিলাম। আর কি?
বেশ! তবে তোমার সাথে আমি কষ্ট করব কেন?
বাহ! আমার জন্য এইটুক কষ্ট করবে না? আচ্ছা মামা, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। বিক্ষুকের কষ্ট দেখে তোমার মনে কি দয়া জাগে না!
জাগবে না কেন! অবশ্যই জাগে। তাই বলে কি সব দিয়ে দিতে হবে?
তাকে ভিক্ষা দিয়ে আমরা এই যে হাঁটছি, এতে আমার কিন্তু অনেক ভালো লাগছে। আমাকে উত্তেজিত দেখে বলল, ওদের মতো সারাদিন কষ্ট করে করুন সুরে দুঃখ ব্যক্ত করে একদিন দুরে কোথাও ভিক্ষা করতে পারবে! না করতে পারলে তো তাদের কষ্ট বুঝা সম্ভব না। তোমাকে মাত্র ভিক্ষা করতে বলছি বলে তোমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু তাদের খরচপত্রের অত্যন্ত টানাটানির কারণে না খেয়ে থাকতে হয়। কতটা কষ্টে পড়লে এভাবে রাস্তায় দাঁড়ায়। ভেবে দেখছ? আর আমাদের টাকা থাকতে খালি হাতে ফিরিয়ে দেব। শুধু হাঁটার ভয়ে!
খুশির আবেগে হঠাৎ জাগিয়ে কোলে তুলে নিয়ে বললাম। মামা, তুমি অনেক ভালো। তোমার মনুষ্যত্ব অনেক বড়।
বাসায় প্রবেশ করতেই আপা জানতে চাইল, এত দেড়ি হল কেন?
হেঁটে আসছি, সেই জন্য।
জিজ্ঞাসা করল না, কেন। অন্য কিছুও জানতে চাইল না।
যখন আপা ও আমি গল্প করতে বসি এবং ফারিহার এই উদারতার প্রসঙ্গ আসলে বলে, ফারিহার এ আচরণে প্রকৃতপক্ষে আমি অত্যন্ত খুশি হই। ফারিহার মনটাও থাকে অনেক বড়। সব সময় মনে আনন্দ থাকে। লেখাপড়ায় ও বুদ্ধিতে ক্লাসের সবাই হারে। এর জন্য ওর বাবাই দায়ী। আমি উল্টো বললে বলে কি জানিস! আমার সাথে তর্ক করবে না, রাগবে না। রাগতে হলে তোমাকে প্রথমে সারাদিন রোদ্রে দাঁড়িয়ে কাটাতে হবে এবং কিছু খেতে পারবে না। রাত্রি বেলাও পেট পুরে খেতে পারবে না। পরেরদিনও ঐভাবে করে রাত্রি বেলা কিছুই খেতে পারবে না। তখন তোমার মনে লজ্জা, ঘৃনা, অসহাত্ব না আসলে তোমার কথা মানব। আবার বলবে, বকবা না; টাকা আমার বাবার। আর আমি তার একমাত্র মেয়ে।
বিকাল বেলা কলিংবেল বাজল। গেটে ভিক্ষুক আসছে। দশ টাকা নিয়ে যাচ্ছে ফারিহা। আপা বলল, পাঁচ টাকা দাও।
আপাকে শান্তনা দিয়ে বলল, আহা! বেচারা কত কষ্টে পড়ে কত আশা বুকে ধরে আমার নিকট আসে। তাকে কি হতাস করে ফিরিয়ে দিতে পারি! পাঁচ টাকা দিলে মন ভেংগে যেতে পারে।আহ! এই সামান্য দশ টাকার বিনিময়ে তার প্রানের ভক্তি কি মিশ্রিত নাই! আশা করে যদি কেউ আমার নিকট আসে আর মলিন মুখে ফিরে যায়। তাতে আমার বড় লজ্জা। আমাকে লক্ষ্য করে বলল, মায়ের তো অনেক আছে। তাকে তো মাত্র দশ টাকাই দেই, তাই না?
বারান্দায় গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কয়েক দিন ধরে আসেন নি কেন? সে কয়দিনের টাকাগুলো আমার কাছে আছে নিয়ে যান।
ফারিহার সাথে আমরাও গেলাম বারান্দায়। দেখলাম লোকটা কুজো হয়ে হাঁটছে, খুনখুনে বুড়ো। আমি আপার মুখে দেখতে পেলাম এক টুকরা অপুর্ব হাসি। সে হাসির সৌন্দর্য ও আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তখন মনে হলো, বিভিন্ন কথা বলে ফারিহাকে ভিক্ষা দিতে বারণ করে না, ঐটাও দোয়া করে আর শিশু মনের পরীক্ষাটা সেরে নেয়।
অনেক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও ভিক্ষুক দেখলেই ফারিহার কথা মনে উঠে। ভিক্ষুকদের আচানের জন্য ফারিহার কত চেষ্টা। ভিক্ষুককে ফিরিয়ে দিতে গেলেই তার কথাগুলো যেন কানে বাজে। আজকের দিনে এ জিনিস যে মানুষের মধ্যে একান্ত দুর্লভ। বরং সর্বত্র এর উল্টোটাই দেখা যায়। সব পিতামাতারাই তার আদরের সন্তানের মহান মনোভাব জাগানোর জন্য, তাদের আনন্দের জন্য শিশুদের হাত দিয়ে দান দেওয়াতে পারে না! একটা মাছুম শিশুকে ছোট থেকে বড় মনের অধিকারী করে গড়ে তুলতে পারলে যে সুখ পাওয়া যায় তা আপার মুখ ব্যতিত অন্য কারো মুখে দেখি নি।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *