শিউলি ফুল

ফুপিদের উঠোনের এক কোণে টিনের ঘরটার সামনে বড় একটা শিউলি গাছ ছিলো। সে গাছে ছিলো কচি কচি সবুজ পাতা। পাতার ভারে গাছের বেশিরভাগ ডাল চালের উপর ঝুঁকে পড়তো। শুনেছি দাদি যখন নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন, তখন খুব সখ করে গাছটি লাগিয়েছেন। শরৎকাল এলেই সাদা ফুলে গাছটি ভরে যেতো। সাদা পাপড়ির মাঝে কমলা রঙের বোটা। আমার কাছে মনে হতো যেনো শুভ্র পরী। বড্ড লোভ লাগতো তার রূপ দেখে। খুব পাগল ছিলাম শিউলি ফুলের। রাতে ফুটতো ফুল। সারা বাড়ি মৌ মৌ করতো ঘ্রাণে। আর ভোরে ঝরঝর করে ঝরে পড়তো ফুলগুলো; চালের উপরে, উঠোনের মাঝখানে, গাছের গোড়ায়।
সাদা সাদা ফুলে উঁচু স্তুপ জমে যেতো। পা ফেলার জায়গা থাকতো না। দু হাত ভরে ফুল কুড়াতাম। আঁচল ভরে বাড়ি ফিরতাম। খুব ভালো লাগতো ফুল কুড়ানো। কেবল আমি না, গাঁয়ের আরো অনেক ছেলেমেয়েও এই ফুলের পাগল ছিলো। ভোর হলেই ফুল কুড়ানোর প্রতিযোগিতা শুরু হতো। কার আগে কে আসবে এই চিন্তা থাকতো মাথায়। রাতে ভালো ঘুমও হতোনা ফুলের চিন্তায়, ওরা যদি আগে এসে ফুল নিয়ে যায়! খুব ভোরে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতাম। আমি, মেঝো আপু আর ছোট আপু সবাই মিলে যেতাম শিউলিতলায়। আব্বু-আম্মু তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। টের পেলেই সর্বনাশ। ধরা পড়লে রেহাই নাই। তাই এক পা দু’পা করে আস্তে আস্তে দরোজার সামনে যেতাম। ছিটকিনিটা আস্তে খুলে বের হয়েই দিতাম দৌড়। এক দৌড়ে ফুপিদের বাড়ির উঠোনে। আমাদের আর পায় কে? বাইরে তখনো আবছা অন্ধকার। কুয়াশায় দূরের কিছুই দেখা যেতোনা। গিয়ে দেখতাম এখনো কেউ আসেনি ফুল নিতে। আমাদের চোখে-মুখে কী-যে আনন্দ!
ফুপিদের বাড়ির কেউ ঘুম থেকে জাগেনি তখনো। মনে মনে কিছুটা ভয়ও কাজ করতো। শুনেছিলাম ফুপিদের বাড়ির দক্ষিণে যে বিরাট জলপাই গাছটা আছে ওটায় নাকি ভূত থাকে। ওই পাড়ার রাণী আপাকে নাকি সেখান থেকে ভূতে ধরেছিল। মাঝে মাঝে গা কাঁটা দিয়ে উঠতো এসব মনে হলে।

কিন্তু ফুলের লোভে ওসব ভুলে যেতাম।
শিউলিতলায় ফুল পড়ে উঁচু হয়ে থাকতো। চালের ওপরটা ছেয়ে থাকতো শুভ্রতায়। সাদা ফুলের গায়ে শিশিরবিন্দু জমে থাকতো।
প্রথমে গাছের নিচের তাজা তাজা ফুলগুলো মুষ্ঠি ভরে জামার আঁচলে তুলতাম। তারপর মেঝো আপু বারান্দার গ্রিল বেয়ে চালে উঠতো। আমরা নিচ থেকে আঁচল বিছিয়ে ধরতাম, আর আপু দু হাত ভরে উপর থেকে ফুল নিচে ফেলতেন। আমাদের আনন্দ আর ধরেনা এত্ত ফুল দেখে! সবার কোচর ভরা ফুল। আমার, মেঝো আপুর, ছোট আপুর।
সেই ফুল নিয়ে সারা সকাল বসে সুই দিয়ে সুতায় গাথঁতাম। ছোট-বড় মালা বানাতাম। গলায় পরতাম। সারা ঘর সাজাতাম। আর আম্মু শুধু বকতো! কে শুনে কার বকা। এভাবেই প্রতিদিন ফুল কুড়াতে যেতাম শিউলিতলায়।
কিন্তু একদিনের ঘটনা। সেদিন খুব ভোরে গেলাম ফুল কুড়াতে। আমরা ফুল কুড়াচ্ছিলাম, হঠাৎ সেই জলপাই গাছ থেকে কিসের যেনো ভয়ঙ্কর একটা আওয়াজ এলো। আমরা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরলাম। ভয়ে আমরা কেঁদেই দিলাম। সব ফুল ফেলে দিয়ে দিলাম দৌড়। সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। সেদিনের পর থেকে আমরা আর ফুল কুড়াতে যাই না। মালাও গাঁথি না। একটা ভয় সব লোভ কেড়ে নিলো। আর যাওয়া হয়নি শিউলি তলায়। সেই শিউলি গাছ এখন আর নেই। গাছের মালিকও নেই। নেই ছোট্টবেলার দিনগুলি। নেই ফুল কুড়ানোর আনন্দ। সব হারিয়ে গেছে। কেবল স্মৃতিগুলো জমা হয়ে আছে মনের ডায়েরিটায়।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *