রোহিঙ্গাদের বাস্তবতার দলিল ‘আরাকান থেকে বাংলাদেশ’

অনেকক্ষণ থেকে ঘড়ি দেখা হয়নি, কারণ জয়নাল আবেদীন এর লেখা ‘আরাকান থেকে বাংলাদেশ’ উপন্যাসটির শেষের দিকটা পড়ছি। কি হতে যাচ্ছে? কি হচ্ছে এসব? তাহলে কি ২০১৬ সালের মাঝদিক থেকে শেষের দিকে ফেইসবুক পত্রিকায় যা দেখেছি শুনেছি সবই সত্যি? ঘটনা গুলো যতটা জানা যায় মিডিয়ার মাধ্যমে, তার চেয়ে অনেক কম জানা হয় আমার। আবার শেষ দিকে শুনেছি মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের নরকীয় তাণ্ডবের কথা সব অস্বীকার করেছে। উচ্চপর্যায় থেকে যে তদন্ত করা হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে মিডিয়াতে যতটা নরকীয় তাণ্ডবের কথা বলা হয়েছে আসলে তেমন কিছুই হয়নি।
কিন্তু এই উপন্যাস থেকে এখন চোখ সরাতে পারছি না কেনো? জীবন বাঁচানোর জন্যে যখন এত বছরের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই ঠিক সেই সময়ে আফিয়ার প্রতিবেশী সুলতানকে কেনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি এই নির্মম নিয়তির জন্যেই সুলতান পাশের এলাকার হত্যাযজ্ঞ দেখতে গিয়েছিল। সেইদিন সুলতান উপস্থিত থাকলেই তো সবাই বেরিয়ে পড়তো জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে। তবে কি সৃষ্টিকর্তাই চেয়েছিলেন সেই অন্ধকার বিভীষিকাময় রাতে আফিয়া হারাবে তার সন্তানকে হারাবে বাবাকে আর নিজের ইজ্জতকে। চোখের সামনে নিজের বুকের ধনকে কেড়ে নিয়ে আগুনের মাঝে ছুড়ে ফেলার দৃশ্য আর সন্তান পুড়ে কয়লা হওয়ার রাজসাক্ষী আজ আফিয়া।
না ঘড়িটা দেখতেই হবে, অভ্রর ছুটি হবে বেলা একটায়। স্কুলে থেকে আবার ম্যাডামের বাসায়। বাসা থেকে স্কুল যেতে সময় লাগবে মাত্র ৫ মিনিট। তৈরি হতে ৩ মিনিট। সব মিলিয়ে ৭/৮ মিনিট আগে উঠলেই চলবে। গল্প উপন্যাস গড় গড় করে পড়তে পারিনা আমি। খুব মন দিয়ে আস্তে আস্তেই পড়ি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র ১২টা বেজে ১৩ মিনিট। হাতে অনেক সময় আছে। স্বামী নিখোঁজ সেই ৪ বছর আগে, আজ একই সাথে হারালো বাবাকে আর নিজের সন্তানকে। এরপরও কি আফিয়া বেঁচে আছে, কি করে দিন পার করছে। আফিয়ার বাবা মাজেদ সেই ছোট থেকে মা মরা মেয়েকে নিয়েই জীবন পার করে দিল। আরাকানের সৈন্যদের হাতে মেয়ের সব হারানো দেখে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করে মাজেদ। আল্লাহর কাছে বিচার দিলেন মাজেদ…’ হে আল্লাহ, তুমি কি দেখো না তোমার জমিনে কী হচ্ছে। তুমি নীরব কেনো খোদা। ওদের গজব দাও খোদা, ওদের ধ্বংস করে দাও’।

সব হারিয়েও বাঁচার জন্যে লড়াই করছে আফিয়া। অন্যদিকে শাশুড়ি রোকেয়া নিজের এক সন্তানকে হারিয়ে খোঁজে আরেক ছেলের বউ আর নাতিকে। হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের সাথে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে। আফিয়া সব হারিয়েছে, তবুও আমার জানার কৌতূহল আনাসকে কি খুঁজে পায় আফিয়া। যে আনাসের সাথে তার অনেক স্মৃতি, যে আনাসকে নিয়ে রোজ বিকেলে নদীর পাড়ে বসে অজানা অনেক স্বপ্ন দেখেছিল। আনাস কাছে এসেছে বলে রৌশন ভাই দূরে চলে যায়। কিন্তু রৌশন দূরে গিয়েও আবার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ফিরে আসে। প্রায় দুই বছর আফিয়ার পাঠশালার দায়িত্ব পালন করে শিশুদের জ্ঞান অর্জনের পথ সুগম করে।
খুব হাসি পেয়েছে বাদুর আঁকা চোখবিহীন ছবির কথা জানতে পেরে। মনে পড়ে ‘টেলিভিশন’ নামের সিনেমার কথা। সিনেমায় পত্রিকায় মানুষের মুখ বা চোখ দেখলে গুনা হবে সে জন্যে পত্রিকা হাতে পাওয়ার পর সাদা কাগজ দিয়ে সব ছবি ঢেকে দেয়া হয়। বাদু দাদার কাছে যা শুনেছে শিখেছে তাই এঁকে দিয়েছে। কিন্তু চোখ দেয়া মানুষের ছবি তার সামনেই দেখতে পেয়ে লুকিয়ে আবার ছবি আঁকে। আর চুপটি করে আফিয়াকে দিয়ে বলে…
বাসায় গিয়ে খুলবে।
‘মগের মুল্লুক’ কথাটা প্রবাদ হলেও এর উৎপত্তি যখন মায়ানমারে, তার আরো প্রমাণ পাওয়া গেলো সুচির জয়ের পর। সুচিকে অসম্ভব ভালো লাগতো আমার। এটা সুধু নারী বলে নয়, মনে হতো অসহায় মানুষগুলোর মুখে হয়তো একদিন সুচিই পারবে হাসি ফুটাতে। কিন্তু ক্ষমতা যে মানুষকে কতটা অমানুষ করে ফেলে তা বিশ্ববাসী আবারো দেখেছে সুচির জয়ের পর।
অভাব মানুষের বিবেক কে কতটা অমানবিক করে তোলে তা জুলেখার বাবা মাকে না জানলে হয়তো অজানাই রয়ে যেতো। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতিটি ঘরে ঘরে জনসংখ্যাবৃদ্ধি ছিলো স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু সামরিক সৈন্য মুহূর্তে পরিবার গুলোকে নিঃস্ব করে দিলো।
একটু একটু পড়ে আবার অভ্রকেও ঘটনা বলতে হয়। ওর শুনার আগ্রহও বেড়ে যায়। আফিয়া যখন স্বামী আনাসের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, একা এক নৌকার যাত্রী হয়, মনের মাঝে ভয় আর আতংক নিয়ে পড়েই যাচ্ছি। ভয়টা পেয়েছি মাঝি জামসেদকে। হয়তো আফিয়ার ইজ্জত এই নদীতেই বিসর্জন হবে। কিন্তু না, শিক্ষিত ভদ্র সমাজ যা করতে পারেনা। যে মনুষত্বের পরিচয় দিতে জানেনা, তাই দিয়েছে জামসেদ। ভদ্র সমাজের মুখে ঝামা ঘসে দিয়েছে সাধারণ এক মাঝি হয়ে। এই অভাবি মানুষগুলোর মাঝে মায়া মমতা আর পরোপকারীর পরিচয় দেয় মাঝি জামসেদ। অভাব যখন তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা তখন মানবিক দিক বিবেচনা করে এক নৌকার মাঝি। যে সময়টা আফিয়াকে নিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছে, সে সময় অন্য কোন যাত্রী নিয়ে পারাপার করলে জামসেদ বেশ কিছু টাকা উপার্জন করতে পারতো। কিন্তু তা তো সে করেই নি, বরং নিজের পরিশ্রমের টাকাটাও নেয়নি। ভেবেছে এই টাকা আফিয়ার সাথে থাকলে হয়তো আফিয়া বিপদের মুখ থেকে রক্ষা পেতে পারবে। সেই পথ ঠিক পার হয়েছে আফিয়া।
অন্তঃস্বত্বা আফিয়া অচেনা জায়গা পার হয়ে ঠিক পৌঁছায় শাশুড়ির কাছে। কিন্তু এমন এক কঠিন দিন যে অপেক্ষা করছে নিজের জন্মস্থানে, নিজের ভিটেমাটিতে, নিজের ঘরের উঠোনেতে, তা কি করে জানবে আফিয়া। এটা রোহিঙ্গাদের নিয়তির বিধান ছিলো, নাকি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। রোহিঙ্গাদের সেই সব দিনের কথা জানতে হলেই পড়তে পারেন উপন্যাসটি। এই কথা গুলোকে গল্প উপন্যাস বললে ভুল হবে, রোহিঙ্গাদের এ এক বাস্তবিক দলিল। পড়াটা শেষ। আমি যা কিছু অপেক্ষায় ছিলাম। কিছুই পাইনি। সাড়ে চার বছর পর রোকেয়া সন্তানকে পেয়েও অজানা পথে পাঠিয়ে দেয় নিজের ঘরের লক্ষী আর স্বামীর বংশধরকে খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। পড়া শেষ। খাটের কোনায় বসে আছি। চোখের কোনায় আধা শুকনো দুফোটা জল। বুঝতে পারি জলটা বেরিয়েছে যখন ছিলাম আফিয়ার ছেলে জারিফের পোড়া গন্ধটা নাকে আসছিল। দ্রুত স্কুলে যাই, মনটা আধমরা হয়ে আছে।
— মা তোমার কি কিছু হয়েছে?
— না, আফিয়ার ছেলে হয়েছে। ওকে আগুনে ছুড়ে ফেলে…
— আর বলো না। বাসায় গিয়ে শুনি।
বাসায় আসে ও ৩:৩৭ মিনিটে। খাবার খেয়ে পাশে শুয়ে আছে।
— এবার বলো কি হয়েছে।
ওকে বাকী টুকু বলি। আসলে বলার আর কিছুই ছিলো না। আনাস রোকেয়া আর আফিয়ার মতো হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্বপ্ন আরাকান আর বাংলাদেশের মাঝখানে থাকা জল সীমানায় ভাসিয়ে যায় স্রোতের সাথে। একটার পর একটা ঢেউ আসে, নদীর কিনারে এসে বিলীন হয়ে যায়। রোহিঙ্গা মুসলমানদের স্বপ্ন মাঝিহীন নৌকার মতো এপাশ থেকে ওপাশ, কখনো মাঝ নদীতে ঘূর্ণিপাক খায়।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *