রাস্কেল স্যার

প্রাইমারি স্কুলে সব শিক্ষার্থীর কাছে ‘রাস্কেল স্যার’ নামে খ্যাতমান ছিলেন শ্রী সুধাংশু বাবু। ছাত্র-ছাত্রীরা জুজুর মতো ভয় করতো থাকে। স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী সকালে কিংবা বিকেলে তার বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট পড়তো। স্কুলের পাশেই ছিল তার বাড়ি। এই স্কুলে স্যারের বয়স বিশের কাছাকাছি। গ্রামের অধিকাংশ যুবক তার ছাত্র। অভিভাকরাও বেশ মান্য করেন তাকে। ‘রাস্কেল স্যার’ হিসেবে পরিচিতির একটি ছোট্ট কাহিনী এখানে রয়েছে।
একদিন তমালের বাবা স্কুলে এসে ক্লাসের সবার সামনেই সুধাংশু বাবুকে বললেন, ‘স্যার এই গাধাটাকে পিটিয়ে মানুষ করবেন। আমি আর কিছু চাই না, শুধু হাড়টুকু দিলেই হবে। প্রয়োজনে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবেন।’ একটু থেমে ঢুক গিলে আবার বললেন-‘গাধাটাকে বাড়ির কাজেও লাগাতে পারি না আবার নিয়মিত স্কুলেও আসে না। স্কুলের সময় হলে সে কোথায় যে বেরিয়ে যায় খুঁজেই পাই না। তবে একদিন খুঁজতে গিয়ে দেখি, ঠাকুর বাড়ির বাগানে বেলগাছে উঠে ইন্ডিয়ান বিড়ি টানছে। এই আপদটাকে নিয়ে বড় বিপদে আছি।’
শ্রী শুধাংশু বাবু হাতলওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে কথাগুলো শুনছিলেন। তমালের বাবার বক্তৃতাটাইপের কথা বলা শেষ হলে স্যার একটু নড়েচড়ে বসে গলা খাকানি দিয়ে বললেন, ‘কোনো চিন্তা করবেন না। এই সব রাস্কেলদের পিটিয়ে কিভাবে মানুষ করতে হয় তা আমার ভালোভাবেই জানা আছে। দেখেন নি, এই গ্রামের কত রাস্কেলকে পিটিয়ে আজ কাজের মানুষ বানিয়েছি।’
ছাত্রছাত্রীদের পিটুনি দেয়ার নানান ধরণ দুনিয়ায় আবিষ্কার হয়েছিল তখন। যিনি যে টাইপটা গ্রহণ করতেন তিনি সেই টাইপের পিটুনি দিতে দক্ষ হয়ে উঠতেন। শ্রী সুধাংশু বাবু যখন পিটুনি দিতেন তখন তার মুখ এমন বিকৃত হতো যে, স্কুলের দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির শিশুরা দেখে প্রশ্রাব করে প্যান্ট ভিজিয়ে দিতো। আর তৃতীয় শ্রেণির শিশুরা দেখে এমনিতে কান্না জোড়ে দিতো। তার দুর্দান্ত পিটুনির সাথে থাকতো মুখে উচ্চারিত বিকট আওয়াজ। যেন ঝড়ের দিনের বিদ্যুৎ চমক ও মেঘের গর্জন। স্যার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্কুলঘর কাঁপিয়ে বলতেন-‘কত রাস্টেট পিটিয়ে মানুষ করেছি, তাই তো সামান্য রাস্কেল। আসলে তুই রাস্কেল, তোর বাবা রাস্কেল, তোর চৌদ্দগোষ্ঠি রাস্কেল।’
স্যারের এই রাস্কেল বলার মুদ্রাদোষের কথা কেউ এতো দিন আমলেই আনেনি। সেদিন তমালের বাবাকে ‘রাস্কেল’ পিটিয়ে মানুষ করার কথা না বললে এটা নিয়ে শান্ত মাথায় কেউ চিন্তিত করতো না, আর অভিভাবকদের প্রিয় শ্রী সুধাংশু বাবুর নামও ‘রাস্কেল স্যার’ হিসেবে খ্যাত হত না।
সেদিন থেকে স্কুলের সর্বমহলে তমালের একটা অঘোষিত নাম হয়ে গেল ‘রাস্কেল’। এদিকে পিচ্ছি শিশুদের কাছে শ্রী সুধাংশু বাবুর নাম হয়ে গেল ‘রাস্কেল স্যার’।
দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিল। বিপত্তি ঘটালেন স্কুলে নতুন আসা মাস্টার দিপক মশাই। তিনি দেখলেন শিক্ষার্থীরা যখন তখন ‘রাস্কেল স্যার, রাস্কেল স্যার’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলছে। এই সম্মানজনক খেতাবটি কোন স্যারের তা আবিষ্কারের জন্য তিনি আদাজল খেয়ে কোমর বেঁধে মাঠে নামলেন। পিচ্চি শিক্ষার্থীদের কাছে চুপিচুপি পই পই করে অনেকদিন খোঁজা খুঁজির পর উদ্ধার করলেন খেতাবের মূল রহস্য। এই রহস্যের ঘোড়ার ডিমটি তিনি ফুটালেন সহকর্মী সব শিক্ষকের সামনে। এর আগে অন্যান্য শিক্ষকরা জানতেন এই ‘রাস্কেল স্যার’ শব্দের হদিস কিন্তু এটা নিয়ে কেউ কখনো মাথা ঘামাননি। তাদের এক কান দিয়ে শব্দটি ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তবে এবারতো আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। মাস্টার দিপক মশাইয়ের অতি উৎসাহী আবিস্কারে শ্রী সুধাংশু বাবু কিছুটা লজ্জা পেলেন সবার কাছে। তবে তিনি দমে থাকার পাত্রও নন। এ রহস্য ফাঁস ঘটনার পর শ্রী সুধাংশু বাবুর ‘রাস্কেল’ বলার মুদ্রাদোষ এবং বাঁশের বেত গাধাদের পিঠে ভাঙার শক্তিটা প্রবলভাবে বেড়ে গেল। হাতের কাছে বেত না পেলে বা বেতটি ভেঙে গেলে পিতলের চাকতিতে ঘণ্টা মারার কাঠের হাতুড়ি মাথায় জোটতো হতচ্ছাড়া মানুষরূপী গাধাদের। বেশি সংখ্যাক ছাত্রছাত্রী তার বাসায় টিউশনি পড়ার নামে যাতায়াত ও মাস শেষে টাকা হাতে তুলে দেয়ার রহস্যও বের হলো এর সাথে। সবাই দেখলেন, ‘রাস্কেল’ তমকাপ্রাপ্ত স্যারের মহাপরিশ্রমী পিটুনীর কবল থেকে নিস্তারের মহৌষধ হিসেবে তারা এক ধরনের প্রতিযোগিতায় তার বাসার স্কুলে নাম লেখাতো।

মাস্টার দিপক মশাই স্কুলে একটু পুরনো হতে না হতেই তার মতি-গতিও যেমন সুবিধার দেখলো না বরাবর পিটুনি খাওয়া পিচ্ছিরা। পিচ্ছি ছাত্রছাত্রীদের শাসনের ব্যাপারে রাস্কেল স্যারের মতো তার থিওরিটাও দাঁতে মুখে দিতে পারছিল না তারা। একটু এদিক ওদিক হলেই দুই কান লাল হয়ে ব্যথায় টনটন করতো তাদের। দিপক স্যার সর্ব শক্তি দিয়ে কান ধরে, কানের পাতলা চামড়ায় ধারালো নখ বসিয়ে এস্পার ওস্পার করতেন। তবে সতর্কও থাকতেন, যাতে জোরে টান পড়ে কচি কচি কানের মূল উপড়ে হাতে না আসে। আর অবস্থা দেখে মনে হবে যে, যদি কানের মূল একটু শক্ত হতো তাহলে কানের লতি ধরে তিনি ঝুলে পড়তেন তখন। মাস্টার দিপক মশাইয়ের এই বৈধ উৎপাতে শিক্ষার্থীরা ভীত-ত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। মনের এই দুঃখে ঝাল মেটাতে তারা দিপক মশাইকে ডাকতে লাগলো ‘ঝাড়িখাওয়া স্যার’।
‘ঝাড়িখাওয়া স্যার’ পদকটি দেয়ার ভেতর পিচ্ছি শিক্ষার্থীদের ইচড়ে পাকা স্বভাবটি ফুটে উঠলো। দিপক স্যার যেদিন আষাঢ়ে আকাশের মতো মুখ কালো করে স্কুলে ঢুকতেন সেদিন ইচড়ে পাকারা বলতে শুরু করতো ‘দিপক স্যার আজ বউয়ের হাতে প্যাদানি খেয়েছেন। এই ঝাল ক্লাসে আজ আমাদের পিঠে ও কানের উপর ঝাড়বেন। বাস্তবতাও ছিল প্রায় এরূপ। যেদিন মুখ কালো করে তিতিক্ষা মেজাজে তিনি স্কুলে ঢুকতেন সেদিন শুধু কানের চামড়ায় নখের কামড়ই বসাতেন না বরং সান্ডা টাইপের ছাত্র জয়কে দিয়ে পাশের বাড়ির বাঁশ বাগান থেকে আট দশটি বেতও আনাতেন। ভয়ে তটস্থ পিচ্ছিরা পিটুনি খেয়ে ইচ্ছা মতো স্যারের বউকে গালমন্দ করতো। রাক্ষুসী, ডাইনির কারণে আমাদের পিঠে আজ বিষের জ্বালা জ্বলবে বলেও কেউ কেউ ফিস ফিস করতো। বাস্তবে দিপক স্যারের বউ রাক্ষুসী, ডাইনি, বদমেজাজী স্বভাবের কিনা তা একদিনও কেউ খোঁজ নিয়ে দেখেনি। তারা বলাবলি করতো ‘স্বামীর ঝাড়ি খেয়ে স্ত্রী ঝাল মেটায় ঘরের নিরীহ বিড়ালের উপর। আর বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে শিক্ষক স্বামী ঝাল মেটান আমাদের মতো নিরীহ পিচ্ছিদের উপর। শালার ঝালের জীবনচক্র বড় ফেন্টাসটিক।’
কয়েক বছর পর মাস্টার দিপক মশাই এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হয়ে গেলেন। পদ-পদবী বদল হলেও বউয়ের ঝাড়ি খাওয়া, হতভাগ্যটি এখনো মোচন হয়নি তার। নতুন ভর্তি হওয়া পিচ্চি শিক্ষার্থীরা ‘ঝাড়ি খাওয়া স্যার’ নামেই তাকে চিনে এবং নিয়মিত ডাকে। দিপক স্যার এখনো মাঝে মাঝে মুখ কালো করে স্কুলে ঢুকেন। আগে পিচ্চি শিক্ষার্থীরা শুধু দিপক স্যারের আষাঢ়ে মুখ দেখে গবেষণা করে নিজেদের সতর্ক করতো। কিন্তু এখন অনুগত সহকারী শিক্ষকরাও তার গতিবিধি গবেষণা করে সতর্ক হন। এই বাড়তি সতর্কতা না নিলে তাদের ভাগ্যেও ঝাড়ির দুর্গতি অপেক্ষা করতো। তাই নিজেদের হেফাজত করতে প্রধান শিক্ষক দিপক স্যারের আষাঢ়ে মুখ দেখলে সহকর্মীরা বলাবলি করেন-‘আজ দিপক মশাই বউয়ের চড় থাপ্পড় কিছু একটা খেয়ে এসেছেন। ঝাড়–র পিটুনি খাওয়াও বিচিত্র নয়। সবাই সাবধান। এর উত্তরে অন্য শিক্ষক বলেন-‘আজ লাথি উস্টা জোটেছে মনে হচ্ছে, মুখ বেশি কালো দেখাচ্ছে।’ অন্যজন বলেন-‘নারে ভাই, ধ্বজির পিটা খেলেও দিপক মশাই মুখ এমন কালো করেন। তবে যাই হোক সাবধানে থাকা উচিত। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভেতরে কালনাগীনির মতো ফুঁস ফুঁস করে ফুঁসছেন। কখন কাকে কোন ছোতোঁয় যে ছোবল দেয় বলা যায় না।
মানুষের কিছু কিছু মুদ্রাদোষ থাকে যা কখনো বদলানো যায় না। মাস্টার দিপক মশাই সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক হলেও তার অনেক মুদ্রাদোষ বদলায়নি। আগে শুধু পিচ্চি শিক্ষার্থীদের উপর রাগ-ক্ষোভের ঝাল মেটানোর সুযোগ থাকলেও এখন বাড়তি হিসেবে পেয়েছেন অনুগত সহকারী শিক্ষকদের। যাদের সাথে একসময় বন্ধু সুলভ আচরণ করতেন এখন তাদের সাথে বস সুলভ আচরণ করতে গিয়ে মুদ্রাদোষের বদ অভ্যাসটি প্রয়োগ করে ফেলেন। এভাবে ‘রাস্কেল স্যার’ এবং ‘ঝাড়ি খাওয়া স্যার’ চাকুরী জীবন থেকে অবসর নেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কচি মনের শিশুরা বড় হয়ে আর সহকারী শিক্ষকরা জীবনের বিভিন্ন খোশ গল্প আসরে সবাই আনন্দ দিতে বারবার টেনে আনেন ‘রাস্কেল স্যার’ আর ‘ঝাড়ি খাওয়া স্যার’ এর কথা। শ্রোতারা হাসতে হাসতে ঢলতে ঢলতে উপভোগ করে বাস্তব গল্পের দৃশ্য গুলো।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *