দেখ বাবা তুমি যখন আমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে পারবে না তখন অন্য কাউকে দিয়ে কেন আমাকে পাঠিয়ে দিতে চাইছ? আমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছি!! তাই আমার মনে হয় আমি একাই খুব ভালোভাবেই ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে পারব। (ইয়াসির সাহেবকে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে মাথার ওড়নাটা ভালো করে টেনে হনহন করে বেড়িয়ে পড়লো রুশনা)
মেয়ের এরকম রিয়্যাক্ট দেখে থ মেরে বসে আছেন ইয়াসির সাহেব। আর ভাবছেন, কি এমন বললাম আমি! শুধু এটাই তো যে, আজ আমার অফিসে একটা কাজ পড়ে গেছে মা, তাই তোমার সাইফ আংকেলকে বলেছি তোমাকে যেন ভার্সিটিতে একটু পৌঁছে দিয়ে আসে।
ইদানিং মেয়েটা কেমন যেন পাল্টে গেছে। আগের জামাকাপড় গুলো একদমই পড়ে না। তার বদলে লং থ্রি পিছ সাথে চওড়া ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে বাইরে বের হয় এমনকি বাসায়ও এই ধরনের ড্রেস পরে চলে।
সেদিন তো আরেক দফা অবাক হয়েছিলেন ইয়াসির সাহেব, যেই মেয়েকে সবসময় মর্ডান ড্রেস পরে বড় করেছি সেই মেয়ে বলে কিনা, বাবা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে একটা বোরখা কিনে দাও!
কি যে হলো মেয়েটার! মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওকে আমি কোনো অভাব বুঝতে দেই নি। যখন যেটা চেয়েছে সেটাই এনে দিয়েছি। সবসময়ই নিজের সাথে করে সবজায়গায় নিয়ে গিয়েছি। এমনকি ওর যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য সাইফ মানে আমার কাজিনকে তার পরিবার সহ এখানে নিয়ে এসেছি। যাতে আমার অনুপস্থিতিতে মেয়েটা একাকীত্ব বোধ না করে। যাতে সাইফের স্ত্রী, সন্তানরা মেয়েটাকে একটু সময় দেয়। কিন্তু এখন মেয়েটাকে বুঝতেই পারছি না। (কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইয়াসির সাহেব)
রাতে খাবার টেবিলে যখন সবাই খেতে বসেছে তখন ইয়াসির সাহেব দেখলেন টেবিলে সাইফ, শিমু (সাইফের স্ত্রী), তার দুই কন্যা সহ তিনি উপস্থিত কিন্তু রুশনা নেই। তাই তিনি মেয়েকে খেতে ডাকলেন। দুবার ডেকেও যখন মেয়ে আসল না তখন তিনি নিজেই রুশনার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। গিয়ে দেখেন মেয়ে জায়নামাজ ভাজ করছে। খুব অবাক হয়ে গেলেন ইয়াসির সাহেব। এই মেয়ে নামাজ শিখলো কোথা থেকে??
নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলেন ইয়াসির সাহেব, রুশনা সবাই তোর জন্য টেবিলে অপেক্ষা করছে খেতে চল। কি হয়েছে তোর?
রুশনা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা আমার খাবারটা রুমে নিয়ে এসেছি। আজ থেকে আমি সবার সাথে টেবিলে খেতে পারব না বাবা। আমাকে ক্ষমা কর। তারপর সে ওয়াশরুমে চলে গেল।
ইয়াসির সাহেব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলেন। সামনের মাসে অফিসের কাজে তার বাইরের দেশে যাওয়ার কথা কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার মেয়েটার জন্য বাড়িতেই থাকা উচিৎ। রুশনাকে বুঝতে গেলে একটু সময় দিতে হবে। তাই এ ব্যাপারে সাইফের সাথে তিনি কথা বলতে চান।
সাইফ আমি ভাবছি এবছর বাইরে যাওয়ার ডেইটটা ক্যান্সেল করে দিব। (ইয়াসির সাহেব সাইফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-এটা কি বলছেন ভাইজান? তাহলে কোম্পানিতে অনেক টাকা লস হয়ে যাবে। (অস্থির হয়ে বলল সাইফ)
-আসলে টাকার চেয়েও বেশি দামি আমার রুশনা। ওর জন্য আমি এর থেকেও বেশি লস করতে পারি। কি যে হল মেয়েটার বুঝিনা! (হাতদিয়ে ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন ইয়াসির সাহেব)
-ভাইজান আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা তো আছি রুশনার দেখাশোনা করতে। আপনি নিশ্চিন্তে যান। (ছলছল চোখে বলল সাইফ)
-তোরা আছিস বলেই তো আমি অনেকটা নিশ্চিত। জানিস সাইফ আমার বিশ্বস্ত লোকের মধ্যে তুই তো সবার প্রথমে। তুই আমার সমস্যা গুলো বেশি বুঝিস বলেই তো নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য এবাড়িতে আছিস। এখনকার দিনে কে কার জন্য এতো বড় সেক্রিফাইস করে বল। তাইতো তোকে এতো বিশ্বাস করি। সেজন্য তো নিশ্চিন্তে অফিস সহ বাড়ির বিভিন্ন দ্বায়িত্বই তোর উপর দিয়েছি। (স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন ইয়াসির সাহেব)
রাতের খাবার শেষে মেয়ের ঘরের উদ্দেশ্য চললেন ইয়াসির সাহেব। কিন্ত ভিতরে ঢুকতে পারলেন না তিনি। দরজাটা ভিতর থেকে লক করা। মেয়েটা কেন পাল্টে গেল? ও তো সবসময় দরজা খোলা রেখেই ঘুমাতো যাতে কোনো সমস্যা হলেই আমি ওর রুমে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারি। (মনে মনে ভাবলেন ইয়াসির সাহেব)
হতাশ হয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন ইয়াসির সাহেব। আজ বিছানায় শুতে একদমই ইচ্ছে করছে না তাই রুকিং চেয়ারটায় বসে নিজের ফোনটা টেবিল থেকে টেনে নিলেন। তখনই একটা কাগজ নিচে পড়ে গেল। তাকিয়ে দেখলেন কাগজের উপর বড় করে লিখা ‘বাবা এটা তোমার জন্য’।
ইয়াসির সাহেব তাড়াতাড়ি কাগজটা হাতে নিলেন। খুলেই পড়তে শুরু করলেন,
প্রিয় বাবা
জানি তুমি শুধু আমারই বাবা। আমার একমাত্র প্রিয় বাবা। যাকে আমি খুব ভালোবাসি। যে আমার কাছে সবসময়ই একজন হিরো। তোমাকে একদিন না দেখলে যেন আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। তাই তো তোমার সঙ্গ সবসময়ই পেতে চাই।
আমি জানি তুমিও আমাকে খুব ভালবাসো। আমি চাইলে তুমি সবকিছুই করতে পার। যখন যেটা আবদার করি সাথে সাথেই এনে দাও। জীবনে আমি সবকিছুই পেয়েছি শুধু মায়ের আদর ছাড়া। আমার জন্যই তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করনি। যদি সৎ মা আমাকে কষ্ট দেয় এই ভেবে। বড় হওয়ার পর যাতে একাকীত্ব বোধ না করি এজন্য সাইফ আংকেল আর চাচীকেও এই বাড়িতে নিয়ে এসেছো।
কিন্তু সাইফ আংকেলরা আসার পর যে তুমি আমার থেকে এতটাই পর হয়ে যাবে আমি সেটা ভাবতেই পারিনি। জান বাবা তুমি এখন আমার আগের বাবা নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি আমার থেকে সাইফ আংকেলকে বেশি বিশ্বাস কর। আমার তখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। মনে হয় আমার পাশে কেউ নেই।
কিন্তু আমি জানতাম না। একজন আমার পাশে সবসময়ই থাকেন আর তিনি হলেন আমার রব। সেদিন কুরআন থেকে সূরা মারিয়াামের ৪ নং আয়াত টা পড়েছিলাম,
‘হে আমার রব! আমি তো তোমায় ডেকে কখনো নিরাশ হইনি।’
এই আয়াতটা পড়ার পর মনের মধ্যে অদ্ভুত এক প্রশান্তি লাগছিল। যেটা তোমাকে বোঝানোর মতো ক্ষমতা আমার নেই। শুধু এইটুকুই বলবো তুমিও ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসো বাবা।
যেদিন থেকে সাইফ আংকেল এ বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই আমার উপর উনার কু নজর পড়েছে। আমার দিকে বাজে ভাবে তাকানো, আদর করার ধান্দায় আমার গায়ে হাত বুলানো, রাতে আমি ঘুমিয়ে পড়ার পর আমার ঘরে চুপিচুপি আসাটা উনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এমনকি ঘুমের ঘোরে উনি আমার গায়ে হাত বুলাতেন। আর তুমি নিজেই ওনার কাজের ভারগুলো নিয়ে ওনার সাথে আমাকে ভার্সিটিতে পাঠাতে?
জান বাবা তখন আমার কতো কষ্ট হতো? আমি না পারতাম সহ্য করতে আবার না পারতাম কাউকে বলতে। তবুও তোমাকে আমি অনেক বার বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু যতোবারই বলতে গেছি ততবারই আংকেলের প্রতি তোমার অগাধ বিশ্বাস দেখে পিছিয়ে এসেছিলাম। এটাকে বিশ্বাস বলেনা বাবা এটাকে অন্ধ বিশ্বাস বলে! এখন আমি মায়ের মতো একটা বন্ধুকে খুব মিস করছি। দোয়া করি তুমি ভালো থেকো বাবা।
ইতি তোমার কষ্টের রাজকন্যা।
ইয়াসির সাহেব চিঠিটা পড়ে বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলেন। চোখগুলো যেন আজ কোনো বাধা মানছে না। অঝোর ধারায় অশ্র“ প্রবাহিত হচ্ছে। আর নিজের করা ভুলগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।