ফেরা

নিঝুম রাত। ঘরের ভেতর বাহির নিশ্চুপ, নিঃশব্দ। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন পুরো পৃথিবীর মানুষ। কাসেমের স্ত্রী রুবাইয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। ঘুম নেই শুধু কাসেমের চোখে। ইদানীং প্রায় রাতই তার ঘুমহীন কাটে। কী এক যন্ত্রণা আর অশান্তিতে ছটফট করতে করতে শেষরাতে একটু আধটু ঘুমায়। কখনও আবার ছটফট করতে করতেই জাগে। কিন্তু কাসেম এই অশান্তির কথা কাউকে বলতে পারেনা। দেখাতে পারেনা ভেতরকার যন্ত্রণা। কাকে দেখাবে? কে শুনবে তার কথা? সবাইকে সবকিছু বলা যায়? যার তার কাছে বললে মনের ভারী বোঝা হালকা হওয়া তো দূরের কথা বরং আরও বিপদ ও তামাশার পাত্র হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়। তাই মনের সুখ দুঃখের কথা বলতে হয় খুব কাছের মানুষকে। কিন্তু এই দুনিয়ায় তার সেরকম আপন কেউ থাকলে তো? কী করে থাকবে? সে নিজেই তো আতœীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের সাথে সম্পর্কের ইতি টেনেছে। তাতে এতদিন কোনো সমস্যা না হলেও আজকাল প্রায়ই নিজের একাকীত্ব অসহায় করে দেয় তাকে। মাঝেমাঝে দিনদুপুরে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। মাঝেমাঝে এভাবেই রাতভর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর মনে করে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। তার নিজের দেহ মন দিয়ে করা কুকর্মের কথা। তার মনে পড়ে নেতার কথায় শত শত ঘর বাড়ি পুড়ানোর কথা, বহু নারীকে দলবল নিয়ে বিধবা করার কথা। চোখে বারবার ভাসে তার সেই দৃশ্যগুলো। বারবাার ভাসে নির্দোষ রকিবকে তার মায়ের সামন থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে কুত্তার মতো পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলার কথা, দোকানদারদের কাছ থেকে জোর করে চাঁদা আদায়ের কথা। মনে পড়ে নেতাকে খুশি করতে কত শত মেয়েকে তার হাতে তুলে দেওয়ার কথা। মনে পড়ে তার, খুব মনে পড়ে।
কিন্তু এতদিন ওসব তাকে ভাবায়নি। এখন ভাবায়। সেদিন যখন আবুল হায়াত নামের তার বাল্যবন্ধু বলছিলো, কাসেম? ঐ মেয়েটা যদি তোমার বোন বা মেয়ে হতো? পারতে এভাবে তাকে তোমার নেতার হাতে তুলে দিতে? কাসেম সেদিন কোনো জবাব না দিয়ে বাসায় চলে আসে। কথাটি সে এর আগে অনেকবার শুনলেও সেদিনকার কথাটি যেন অন্যরকম ছিলো, ঠিক কোনো অদৃশ্য চাবুকের মতো। নাহলে এভাবে তার বুক কাঁপায়? সেদিন সেখান থেকে ফিরেই সে তার সাত বছর বয়েসি একমাত্র মেয়ের কাছে ছুটে যায়। মেয়েটি তখন ঘুমোচ্ছিল। কাসেম মেয়েটির যতো কাছে যাচ্ছিল ততো তার হাত পা কাঁপছিল। এ যেন তার মেয়ের মুখ নয়, সর্বনাশা গ্রোতে ঢেলে দেয়া সেই মেয়েগুলির প্রতিচ্ছবি। কাসেম বারবাার শিউরে ওঠছিলো সেদিন। মেয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন থাকায় কাসেমের চোখের জল তার কপালে টের পায়নি। কিন্তু টের পেয়েছে তাকে মেয়ের রুমে পাগলের ন্যায় ছুটতে দেখে জানালার পাশে চুপ মেরে থাকা তার স্ত্রী রুবাইয়া। যে চাইলেও তাকে সবকিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনা।
কাসেম এপাশ থেকে ওপাশ হয় আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হঠাৎ করে কেন জানি তার আবুল হায়াতের সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে জাগে। ছোটবেলায় প্রায়সময় দুজন একসাথে থাকতেন। আবুল হায়াত কাসেমের তখনকার অনেক সমস্যা সমাধানের পথ বের করে দিতেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আজ দুইজনের চলাচল দুই প্রান্তে। নিকটাত্মীয়দের সাথে তার দূরত্ব থাকলেও আবুল হায়াতের সাথে তার মাঝেমধ্যে দেখা হয়, কথা হয়। তাই এই হতাশাঘেরা রাত সে তার সাথে দেখা করার আগ্রহে পাড়ি দেয়।
ভোর হতে না হতেই কাসেম ছুটে যায় আবুল হায়াতের কাছে। আবুল হায়াত তখন ফজরের নামায শেষ করে বারান্দায় বসে তাঁর মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শ্রেণির পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। পায়ের আওয়াজ শুনে পেছনে তাকিয়ে কাসেমকে দেখে অবাক হয়ে যান। ততক্ষণে কাসেম তাঁর টেবিলের কাছে চলে এসেছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন কী ব্যাপার কাসেম? তুমি এই ভোরে? কাসেম ছলছল নয়নে তাঁর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আবুল হায়াত একটি চেয়ার টেনে তার হাত ধরে বসতে বললেন। কাসেম বসতে বসতে তাঁর হাতটি শক্ত করে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি ভালো নেই হায়াত। ভালো থাকতে পারছি না। আবুল হায়াত কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। কাসেম আবার বললো বিশ্বাস করো এতটুকু শান্তি নাই মনে। সারাক্ষণ অদৃশ্য এক অশান্তি আর ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আবুল হায়াত তার হাতের উপর অন্য হাত রেখে বললেন কী করে ভালো থাকবে কাসেম? এত মানুষের সর্বনাশ করে ভালো থাকা যায়? মানুষের কান্না, মানুষের অভিশাপ তাড়া করছে তোমায় বুঝতে পারো না?
পারি হায়াত। বড় দেরিতে বুঝেছি আমি। বড় অন্যায় করে ফেলেছি নিরীহ মানুষগুলোর প্রতি। এখন কী করবো? কোথায় গেলে এতটুকু শান্তি পাবো আমায় বলো তুমি প্লীজ। কাসেম চোখ মুছে আর কথাগুলো বলে। আবুল হায়াত আলতো করে তার হাতে আবার হাত রেখে বলেন-‘কতবার তোমাকে বললাম এ পথ ছেড়ে দাও। তুমি শুনলেনা। ছেড়ে দাও কাসেম, ছেড়ে দাও এ পথ। অনেক তো হলো। ফিরে এসো এবার শান্তির পথে। আতœসমর্পণ করো বিশ্ববিচারকের কাছে। অনুতপ্ত মনে ক্ষমা চাও।’ ক্ষমা কী পাবো আমি? কী করে হিসেব দেবো এত পাপের? কোন মুখে ক্ষমা চাইবো? নিরাশ কণ্ঠে বলে কাসেম। আবুল হায়াত বলেন-খালেস দিলে তওবা করো কাসেম। আল্লাহ পাকের দয়া ও ক্ষমা অসীম। বান্দার পাপ পাহাড়সম হলেও তাঁর ক্ষমা আকাশসম। ক্ষমা চাও, মুক্তি চাও। আতœসমর্পণ করো। কাসেম আবার বলে এত পাপের মাফ আমি… তাকে কথা শেষ করতে দেননি আবুল হায়াত। কাঁধে হাত রেখে বললেন-হতাশ হয়ো না কাসেম। আজ শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ। আজকের রাত মহিমাণ্বিত এক রাত। এ রাতে খোদা অসংখ্য পাপীকে ক্ষমা করেন। চলো আমরাও সেই সৌভাগ্যবানদের দলভূক্ত হই। ক্ষমা চাই তার কাছে একাগ্রতার সাথে। আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই আমাদের কথা শুনবেন। কাসেম এবার চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। কাঁধ থেকে আবুল হায়াতের হাত সরিয়ে ধীরে ধীরে বাসার দিকে পা বাড়াতে থাকে। চোখে বুকে তখন তার অপরাধস্বীকারের ধ্যান। তাকে আতœসমর্পণ করতে হবে অতল অপরাধের। শাহানশাহের দরবারে লুটিয়ে পড়তে হবে আজ রাতেই। আবুল হায়াত কাসেমের চলে যাওয়া পথে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছেন। এক চোখে কাসেমের ভয়ংকর কাজগুলো ভাসছে ডুবছে, অন্য চোখে তার প্রত্যাবর্তনের স্বস্তি ছড়াচ্ছে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *