পাঁঠা ও মোরগা কাহিনী

‘খুঁটির জোরে পাঁঠা লাফায়’ এটা এক প্রবীণ প্রবাদ। খুঁটিটা যদি সরকার দলীয় হয়, তা হলে তো বাজিমাত। পাঁঠা শালাটা যতোই লাফাক, খুঁটি হেলাতে পারবে না। পাঁঠাকে সব সময় খুঁটির সাথে বেঁধে রাখতে হয়। এটাই নিয়ম। নিয়মের বিপরীত হলে বিপত্তি ঘটে। চোখের পলকে ছুটে পালাবে। কোথায় থেকে কোথায় গিযে় গা ঢাকা দেবে তা কেউ জানবে না। সে তার স্বভাব সুলভ কিছু একটা খুঁজতে বেরোয়। সেটা না বলাই ভালো। পাঁঠা পশুকে বেয়াড়া পুরুষের সাথে এবং খুঁটিকে ক্ষমতাবান ব্যক্তির সাথে তুলনা প্রবাদটির মতো সবার জানা। পাঁঠা পশু যে বস্তুর খুঁজে ব্যস্ত ও ব্যাকুল, তাকে না পেলে পরানের শান্তি-স্বস্থি উদাও হযে় যায়। মটরশুটি ও ছোলার মতো প্রিয় খাদ্যও তখন তার কাছে তেঁতো লাগে।
সজিব গ্রামের মেঠো পথ দিযে় বাজারে যাচ্ছে। আঁকা বাঁকা পথ। ঘন ঘন বাডি়র কারণে বার বার আড়ালে কিছু লোকের চিৎকার চেঁচামেচি সে শুনতে পেলো। যতো অগ্রসর হচ্ছে শব্দগুলো তার কাছে স্পষ্ট হলো। একদল যুবক পালা করে কখনো বা মিছিল আকারে উচ্চ শব্দে বলছে- পাঁঠা, পাঁঠা, পাঁঠা।
-জোরে বলো, পাঁঠা। – আরো জোরে, পাঁঠা। – এই যে গেলো,- পাঁঠা। – আরে ভাই আমাদের কি কোনো প্রতীক আছে? এই স্লোগান বলার সাথে সাথে সবাই সমস্বরে বলছে- আ- ছে। – কোন সে প্রতীক?- পাঁঠা। পাঁঠা প্রতীক নিযে় নির্বাচনে অংশ নিতে শুনেনি কেউ। সজীব ভাবলোা- তার শুনতে হয়তো ভুল হচ্ছে। তাছাড়া এখন কোনো নির্বাচনের সময়ও নয়। আর স্থানীয় কোনো সমিতির বা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন হলেও পাঁঠাকে টানতে যাবে কেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে পাঁঠা পশুর বিশেষ কোনো মর্যাদা আছে বলে তার জানা নেই। বলির পাঁঠাও যেটা হয় সেটারও আলাদা মান মর্যাদা আছে। কিন্তু পাঁঠা! শুনতেই কেমন বিকট লাগে।
মোরগ প্রতীকের নির্বাচন হতে দেখেছে সে। মোরগ প্রতীক নিযে় যে নির্বাচনে আসে, সেই ভোট প্রার্থীর চরম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। প্রার্থীকে দেখলেই যুবক ভোটাররা অযথা চিৎকার চেঁচামেচি, হাসি টাট্টায় মেতে উঠে। মোরগ প্রতীককে মোরগ না বলে প্রার্থীর দিকে কুৎসিত ইশারা ইঙ্গিত করে মোরগা, মোরগা বলে পরিবেশ সরগরম করে তুলে। আর মহিলা প্রার্থী হলে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে মোরগ প্রতীককে মুরগী মুরগী নাম দিযে় সস্থা ছোট খাট একটা মিছিল করে ফেলে।
নির্বাচনে মোরগ প্রার্থীদের জন্য এ বিড়ম্বনা বেশ উপভোগ্য। নির্বাচনের অনেক পরও প্রতীকের এই বিড়ম্বনা প্রার্থীদের বিব্রত করে রাখে। সজিব মনে মনে বললো- পাঁঠা মিছিলের ঘটনা তদ্রুপ নয় তো?
সজিব তার গতিতেই হাঁটছিল। তবু এক সময় মিছিল কারীদের কাছে পৌঁছে গেল। সে দেখলো একদল যুবক পাঁঠার মিছিল দিচ্ছে। লোকটা বার বার পিছনে ফিরে যেসব গালিগালাজ করছে তা শ্লোগানের তুডে় ক্ষীণতর শুনাচ্ছে। বৃদ্ধের ঠোঁট নড়া, হাত নড়া, দেখেই কেবল বুঝা যাচ্ছে, সে প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠেছে।
মিছিলকারীরা তার এসব অভিব্যক্তির দিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। তারা পাঁঠা পাঁঠা বলে ইচ্ছে মতো লাফাচ্ছে, ফুর্তি ও উল্লাসে ফেটে পডে়ছে। বৃদ্ধের সাথে ছোট একটি ছেলে আছে। সে এসব কাণ্ডে নির্বিকার। তার মুখ দেখে মনে হবে এমন মিছিল দেখে দেখে সে অভ্যস্ত, গা সওয়া হযে় গেছে। যেন স্বাভাবিক কিছু একটা।
বাজারের প্রায় নিকটে এলে বৃদ্ধ লোকটি বাজারে ঢোকার বিকল্প পথ ধরলো। সজিবও তার পিছনে পিছনে আসছে। মিছিলকারী যুবকদের একজন ছাড়া সবাই বাজারের সরল পথের দিকে চলে গেল। বৃদ্ধের সাথে সাথে সামান্য সামনে এগুলে ঘটলো এক কাকতালীয় ঘটনা।
পথের পাশে জমিতে একটি ছাগী খুঁটির সাথে বাঁধা। ছাগী বেচারী ইচ্ছে মতো কর্কশ ভাষায় চেচাচ্ছে। সম্ভবত সে প্রথম সন্তান ধারণের বয়স পেযে়ছে। গ্রামে তাকে বলে ‘ডাক ধরেছে’। ছাগীর চিৎকারে ‘ডাক ধরা’র ব্যপারটি বুঝা যাচ্ছে। ছোট বালকটি শিশুসুলভ আচরণে খুব আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো- দাদা, ছাগীটি এমন বেহুশের মতো ডাকছে কেন? সহজ প্রশ্ন। সহজে যে কোন উত্তর দিযে় নাতির প্রশ্নের একটা সুরাহা করা যায়। কিন্তু দাদা ব্যক্তিটি টাশ টাশ করে নাতির দু’গালে চার পাঁচটি চড় বসিযে় দিলো। চডে়র সাথে বিড় বিড় করে বললো- ছাগী ডাকছে কেন? হ্যাঁ, ছাগী ডাকছে কেন? তোর বিয়ার জন্য ছাগী ডাকছে। আর এই চড় কটি দেয়ার জন্য ঢেকে বলছে। বুঝছস হারামজাদা। বালকটি দাদার এই আচরণে খুবই অবাক হলো। তার চোখ দুটি কান্নায় টল টল করছে, কিন্তু কাঁদছে না। সে দাদার দিকে এতো আশ্চর্য হযে় তাকাচ্ছে যেন তার মুখাবয়ব কিছু একটা খুঁজছে। সে হয়তো মনে মনে ভাবছে- নিশ্চয় দাদা লোকটা পাগল হযে় গেছেন।
পাগলরাই তো এমন রূঢ় আচরণ করেন।
দাদার মেজাজ আগে থেকেই তিরিক্ষি হযে়ছিল। ‘পাঠা’র মিছিলটি এই কিছুক্ষণ আগে শেষ হযে়ছে। ভিতরে ভিতরে রাগে ক্ষোভে গরগর করছিলেন দাদা। পাঁঠার প্রসঙ্গ মন থেকে মুছে যাওয়ার আগেই ছাগীর প্রসঙ্গ আসায় আগুনে ঘি ঢালার মতো কাণ্ড ঘটলো। নাতীকে তার বয়সী সরলতার খেসারত দিতে হল। নাতীর দু’গাল লাল হযে় উঠেছে।
সজিব একটু পেছনেই ছিলো। দাদা নাতীর মধ্যে একতরফা বিতণ্ডা সে দেখছে ও শুনছে। ‘পাঠা মিছিল’ এবং ‘ছাগী ডাকা’ রহস্য জানতে সে সঙ্গের যুবককে জিজ্ঞেস করলো। যুবকটি মুখের হাসি আরো প্রসারিত করে বললো আপনি তো ভাই শহরে থাকেন, তাই জানেন না। গ্রামের সবাই এটা জানে। টেকই মিয়াছাব ‘হিল্লা বিযে়’ করেন। গ্রামে এটাকে বিদ্রুপ করে সবাই ‘পাঁঠা বিযে়’ বলে। তাই এই বৃদ্ধ টেকই মিয়াছাবকে দেখলেই ‘পাঁঠা’ ডেকে উত্যক্ত করে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠে যুবকরা। সজিব কথাগুলো শুনে পূর্বের মতোই গাম্ভীর্য মুখে বললো- ‘হিল্লা বিযে়’টি কি রকম? যুবক এবার টা টা করে একগাল হেসে বললো- কারো স্ত্রী তালাক হযে় গেলে আবার স্ত্রীকে ফিরিযে় নিতে চাইলে অন্য পুরুষ কারো সাথে একবার বিযে় দিতে হয়। এটাই হিল্লা বিযে়। শুনেছি তালাক হওয়া স্বামী স্ত্রীর জন্য শাস্তি স্বরূপ এটা হযে় থাকে। সজিব বললো- টেকই মিয়াছাব ছাড়া অন্য কেউ হিল্ল বিযে় করে না কেন? এই বৃদ্ধকে শুধু শুধু হয়রানি করা হচ্ছে না? যুবক তার হাসি একটু চাপা রেখে বললো- অন্য কেউ করতে যায় না। তাছাড়া এতে একটা ঝুঁকিও আছে। সন্তান দানে অক্ষম এমন বৃদ্ধ কাউকে এটা করতে হয়। তাছাড়া হিল্লা বিযে় করে পরে যদি তালাক না দেয় তা হলে সমস্যা সমাধানের চেযে় আরো জটিল হযে় উঠে। এ রকমও ঘটনা ঘটে নাকি?- অবশ্যই ঘটে। গুটার গ্রামের গদা মিয়াছাব হিল্লা বিযে় করে পরে স্ত্রীকে তালাক দেননি। হিল্লা বিযে়র তিন স্ত্রী এখন তার ঘরে। তাই গদা মিয়াছাবের চেযে় টেকই মিয়াছাবকে সবাই নিরাপদ ভাবে। সজিব মনে মনে হেসে ভাবে- হ্যাঁ, পাঁঠা হিসেবে গদা মিয়ার চেযে় টেকই মিয়াই উপযুক্ত। বিশ্বস্থ পাঁঠার কদর থাকবেই তো। তাই তো পাঁঠা মিছিলের কী বাহারি শ্রী। গদা মিয়াছাবের পেছনে এভাবে মিছিল হয় কি না সজিবের জানতে বড় ইচ্ছে করে। তার নামের যে ঢং, হয়তো পাঁঠা মিছিলে লাঠি দিযে় ইচ্ছে মতো ঠেঙায় বলে, ‘গদা মিয়াছাব’ নাম হযে়ছে। গদা মিয়া সম্পর্কে সাথের যুবককে জিজ্ঞেস করবে সে রুচিও তার হচ্ছে না। শরীয়তের একটি রীতিকে নিযে় এমনভাবে হাসি তামাশা, উপহাস করা তার তেমন ভালো ঠেকলো না। সজিব বিড় বিড় করে বলে- হায়রে বেচারা! স্বামী-স্ত্রীর ভাগ্য বিড়ম্বনার একটা হিল্লা বা সুরাহা করতে যাওয়ায় সমাজে সে ‘পাঁঠা’ নামক পশুর তকমা নিযে় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সমাজের রসিক লোকরা রসিকতার আর স্থান পেল না।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *