পরিণয়

বই পড়া বেশ ভালো লাগে তাজরীনের। ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি লাইব্রেরী থেকে পছন্দ মতো বই কিনে এনে বাড়িতে একটা বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছে সে। গ্রন্থাগার গড়া তার মূল উদ্দেশ্য ছিল না। বই জমে জমে এমনিতেই গড়ে উঠেছে। এতে সে বেশ খুশি। বিন্দু বিন্দু জমে সিন্ধু যে হয় তার বাস্তবতা তাজরীনের সামনেই।
শামীমের সাথে আক্বদ হয়েছে তাজরীনের। একুশ দিন হলো আক্বদের। তার পরও কথা নেই, দেখা নেই আপন হওয়া মানুষটির সাথে। শামীমেরও তাড়া নেই অনুষ্ঠানের আগে নববধুর সাথে দেখা বা কথা বলার। তবে ভেতরে ভেতরে মনের কোণে কথা বলা ও দেখা করার একটা অলৌকিক তাড়না সে নিয়মিত অনুভব করতে থাকে। শামীম একজন লেখক। চাকুরি পেশার পাশাপাশি সখের বশে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লেখে। ইতোমধ্যে তার চারটি গ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে। তাজরীন এটা জানে। তবে তাজরীনের সংগ্রহে স্বামীর লেখা বই নেই একটিও।
একদিন বান্ধবী রিনাকে সাথে নিয়ে লাইব্রেরী থেকে শামীমের বইগুলো কিনতে গেল তাজরীন। শুধু গল্পের বইটি পেল। কবিতা ও প্রবন্ধের বই দুটি পাওয়া যায়নি। গল্পের বইটি বাড়িতে এনেই এক নিঃশ্বাসে যেন পড়ে শেষ করল। সে খুব মুগ্ধ হলো। তার ইচ্ছে করল সেলফোনে কথা বলে শামীমকে স্বীয় মুগ্ধতার কথা জানিয়ে লেখার একটু প্রশংসা করতে। কিন্তু তার সেলফোন নেই। বড় ভাইয়ের সেট থেকে ফোন করবে সেটাও সম্ভব না।
একঝাক লজ্জা জাপটে ধরে বড় ভাইয়ের ফোনে কারো সাথে কথা বলতে। শামীমের লেখা গ্রন্থের একটি গল্পের কিছু দৃশ্য বার বার তার চোখে ভাসতে থাকে। তাজরীনের মনে হয় সে গল্পের কথাগুলো পড়ছে না বরং শামীমের সামনাসামনি বসেই দু’জনে আলাপ করছে।
গল্পে নবধুকে বাড়িতে রেখে একটু দূরে স্বামীর কর্মস্থলে যাওয়ার প্রাক্ষালে আলাপ-
:- ‘তুমি কি আমায় ভালোবাসবে আগের মতো?’
-হ্যাঁ, বাসবোতো বললাম।
ভুলে যাবে নাতো?
কি যে বলো তুমি!
স্বামীকে ভুলে গেলে আর কাকে মনে রাখব।
আমাকে নিয়ে তোমার খুব একটা স্মৃতি নেই। কিভাবেই বা স্মরণ করবে।
তুমি আমার স্বামী। আক্বদ, বিয়ের অনুষ্ঠান, বাসর এসবতো জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি।’
বাসর রাতের একটা দৃশ্য পড়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠে তাজরীন। সে ভাবে-তার স্বামীর মুখে ছাপ দাঁড়ি। পরনে পাঞ্জাবি, টুপি। অথচ লেখক হিসেবে কেমন আধুনিক রোমান্টিক। ধার্মিকতা সবাইকে ধর্মান্ধ করে রাখতে পারে না এটাই দেখছি তার জ্যান্ত উপমা। উপমাটা খুব কাছেই, হাতের নাগালে। তাজরীন নেকাব পরতে অভ্যস্ত নয়। আক্বদের পর থেকে নিজের অজান্তেই বোরকা-নেকাব পরতে শুরু করেছে। পর্দা ছাড়া বাইরে বের হওয়ার কথা এখন ভাবতেই কেমন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় সে।
গল্প গ্রন্থে বাসর রাতের স্বামী ও নববধুর আলাপের ক্ষিয়দাংশ-
:- ‘স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে তুমি নিশ্চয় জানো।
: বেশী জানি না। যতোটুকু জানি ততোটুকু যেন পালন করতে পারি সেই দোয়া করবেন।
: স্বামী-স্ত্রী একে অপরের ভূষণ বা পোশাক স্বরূপ। আমিও দোয়া চাই যেন তোমার প্রতি আমার গুরুদায়িত্ব গুলো আদায় করতে পারি।
:- পোশাক বলতে কি বুঝানো হয়েছে আমি ঠিক বুঝিনি।-
: আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফে বলেছেন-তারা (নারীরা) তোমাদের (পুরুষের) পোশাক, আর তোমরা (পুরুষরা) তাদের (নারীদের) পোশাক।’ পোশাক যেমন মানুষের লজ্জা ঢেকে রাখে তেমনি পোশাককেও মানুষ যতœ করে রাখে।-এইতো বুঝতে পেরেছি। স্বামী-স্ত্রী পোশাকের মতোই একে অপরের ভদ্রতার আবরণ। পরস্পর সম্মানকে রক্ষা করবে যাতে ইহকাল ও পরকালে কেউই লজ্জিত হতে না হয়।
আর দায়িত্বের কথা যে বললেন? স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আবার আলাদা কী দায়িত্ব?-
: কেন নয়? অবশ্যই আছে। আল্লাহ এরশাদ করবেন ‘স্বামীদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি স্ত্রীদের অধিকার রয়েছে স্বামীদের উপর যথাযথ নিয়মে।’ এবার বুঝতে পেরেছো সখি? সমান অধিকার।’
গল্পের চুম্বক অংশটা পড়তে পড়তে নববধু তাজরীন স্বামীর অনুরাগে আকুল হয়ে উঠে। কিভাবে তার সাথে কথা বলা যায় এই ফন্দি মনে মনে আটতে থাকে। একটু রাগ উঠে ভাবীর প্রতি। ভাবীটাও যে এ ব্যাপারে নিস্ক্রীয়। যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার কোনো লক্ষণই নেই তার মাঝে। সে আবারও ডুব দেয় শামীমের লেখা গল্পে। গল্পটা বেশ দীর্ঘ। পুরোপুরি শেষ না করেও স্বস্তি হচ্ছে না।
“দু’টি ভিন্ন জীবন যখন একই মোহনায় একিভূত হয় তখন একে অপরকে আপন করে নেয়। যৌথ জীবনে প্রেম ভালোবাসা সম্পর্ক গড়ে উঠে। সংসার হয় জান্নাতি ধারার। তুমি কি আমাকে ততোটুকু আপন করতে পেরেছ?-আপনি ধার্মিক স্বামী। সব কর্তব্য জানেন। আমি অজান্তে যদি আপনার মনে কষ্ট দেই তা হলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনাকে জীবন সঙ্গী পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী লাগছে।- যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে অধিকার ও কর্তৃত্ব উঠে যায়। যেখানে ভালোবাসা কমে যায় সেখানে অধিকারের মানদণ্ডে সমস্যার সমাধান করতে হয়।-এ জন্যই বুঝি পদে পদে নারীরা পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়। পুরুষরা নারীদের যাবতীয় কিছুর ব্যবস্থা করে, দেখাশোনা করে। এ জন্য অভিভাবক হিসেবে পুরুষদেরকেই মেনে নিতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়ে বলেছেন ‘পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল।’-এই কর্তব্য সুন্দর ও সহনশীল হয় উভয়ের মাঝে ভালোবাসা ভরপুর হলে। -ঠিক বলেছ প্রিয়। ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই।-আমি যদি কখনো অজান্তেই বদমেজাজী হয়ে যাই, আপনি কি আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাবেন?
-কি যে বলো তুমি। তবে শুনো একটা ঘটনা। এক দরবেশকে লোকেরা একদিন দেখল তিনি বিষাক্ত সাপ দিয়ে কাঠের বোঝা বেঁধে নিয়ে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে আসছেন। অবাক হয়ে লোকেরা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন ‘এটা আমার বদমেজাজী স্ত্রীর সাথে সদ্ব্যবহারের পুরস্কার।’ হা হা, বুঝলে তো এখন তোমাকে পেটাব কি না।
-বুঝেছি গো, খুব বুঝেছি। শুনেছি নারীদের জন্য বেহেস্তে যাওয়ার পুরুষের থেকে সহজ হয় চারটি বিষয় যথাযথ মেনে চললে। সে গুলো বলেন।
-তুমি যখন শুনেছো তাই তুমি বলো না। ভুল হলে আমি বলে দেবো।
:- সে চারটি হলো- ‘ঠিক মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, রমজানের রোজা রাখা, স্বামীকে শরীয়তের গণ্ডির মধ্যে থেকে খুশি রাখা এবং পর্দার সাথে নিজের ইজ্জত আব্র“র যতœ করা।
:- এই তো ঠিক বলেছো। একটি হাদিসে আছে শিরকের আশঙ্কা না থাকলে প্রত্যেক স্ত্রীকে নির্দেশ দেয়া হতো তার স্বামীকে সেজদা করার। আল্লাহ তায়ালা স্বামীদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানের স্থান এতো উঁচুতে রেখেছেন।
: দোয়া করবেন আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যেন ঘুনপোকায় না ধরে। হা হা হা।
শামীমের লেখা গল্পগ্রন্থের ‘বাসর রাতের আলাপ’ গল্প থেকে অংশটুকু নেয়া হয়েছে। গল্পটি পড়তে পড়তে তাজরীন একা একা হারিয়ে যায় শামীমের বাসর রাতে। বিয়ে অনুষ্ঠানের তারিখ এখনো দু’মাস বাকি। তার কাছে লাগছে দু’যুগ যেন অপেক্ষা করতে হবে। আর অপেক্ষা সইছে না যেন। আকতের পর থেকে একজন অজানা, অচেনা পুরুষের প্রতি এমন চুম্বকীয় আকর্ষণ কেন যে সৃষ্টি হলো, সে কোনো কারণ খোঁজে পায় না। অচেনা পুরুষটির প্রতিও তার ক্ষোভ-অভিমান বাড়ে ঝড়ো বাতাসের মতো। তার মনে প্রশ্ন জাগে-একবারও কি দু’জনের এই পরিণয় নিয়ে স্বামী পুরুষটির মনে কোনোই তুলপাড়-রেখাপাত হয় না?
বিয়েতে শত্র“দের একটা মরণ কামড় থাকেই। বরের পক্ষ বা কনের পক্ষ কারো না কারো পক্ষের শত্র“রা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে তখন। আকত হয়ে গেছে তবুও শামীম ও তাজরীনের শকুনী মামারা থেমে নেই। উভয় পক্ষের কাছে একে অন্যে যতো পারে দুর্নাম-বদনাম পৌঁছে দেয় ষোলকলা পূর্ণ করে। ধীরে ধীরে স্বামী ও তাজরীনের কানে পৌছে তা। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের যতো সব দোষ ত্র“টি, বদনাম শুনতে থাকে বাতাসের মুখে মুখে। এদিকে ঘনিয়ে আসছে বিয়ে অনুষ্ঠানের তারিখ। শামীম ও তাজরীনের মনের গুপ্ত ঘরে চলতে থাকে অচেনা তুলপাড়। কাল বৈশাখী ঝড় যেনো তাদের দু’জনের হৃদয়কে তছনছ করে মিশিয়ে দিতে চায় মাটির সাথে।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *