নির্বাক রাজাকার

‘রাজাকারের ফাঁসি চাই, দিতে হবে দিতে হবে’ এবং ‘দাবি শুধুই একটাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই’ শ্লোগানে মুখরিত বক্তৃতার মঞ্চ। ফাঁসির দাবি নিয়ে মানুষের মুখে মুখে আলোচনা-সমালোচনা, পক্ষে-বিপক্ষে প্রশংসা-নিন্দা চলতে সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে। দেশ ছাড়িয়ে প্রবাসে বাংলাদেশি নাগরিকদের মুখেও ঝড় উঠেছে এই বিষয়ে। পরিস্থিতি দেখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন কয়েকটি বিশ্ব সংস্থা এবং রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিগণ।
মখদ্দস আলীর চোখ মুখ উদ্বেগহীন নির্বাক। আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের ভার বহনে যত না ক্লান্তি, পরিবারের ঘানি টানায় তার চেয়ে বেশি বিপর্যস্ত মখদ্দস আলী বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। তার উপর লেগে থাকা রাজাকার শব্দের তকমাটা তাকে কোনো দিন ভাবায়নি। তিনি কোনো চিহ্নিত রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধীও নন। দারিদ্রতায় কাবু করে আছে সেই পাকিস্তান আমল থেকে। চুরির অভ্যাস ছাড়তে পারেন নি যোদ্ধাত্তর স্বাধীন দেশেও। সিদ খুঁড়ে চুরি করার জন্য তার মতো দক্ষ দশ গাঁয়ে কেউ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালে লুটতরাজ করেছেন ইচ্ছে মতো। পাক বাহিনীকে পথ চিনিয়ে দেয়ার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধকালীন দিনগুলো তার বেশ ভালোই কেটে ছিল। রাজাকার আখ্যাটা যে কী তা উপলব্ধি করার জ্ঞানও তার যথার্থ নেই। ‘চুরের পুত চুর’ গালাগালি শুনতে শুনতে তার জীবন আজ অবসানের প্রান্তরে। যেহেতু মখদ্দস আলী কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন এবং কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্যও নন। তাই রাজাকার আখ্যাটা তার বেলায় চাপা পড়ে আছে বহু বছর হয়। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধীও ছিলেন না কখনো। পাক সেনাদের সহায়তার প্রাপ্তিতে চুরির মুক্ত ও সহজ রাস্তা পরিস্কার করা ছিল তার মতলব। রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার গৃঢ় তত্ত্বে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন তিনি বোধ করেন নি কোনো দিন। তাই রাজাকার তকমায় ছিল না তার একটুও ভ্রƒক্ষেপ। দেশ স্বাধীন কিংবা পরাধীন তার কাছে ছিল সমান বিষয়।
কেঁচো খুঁজতে সাপ বেরিয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটল সায়াহ্ন বেলায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষ নামে মানুষকে শ্রেণিভাগ করে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মকদ্দস আলীর ছোট ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ গ্র“পের সক্রিয় কর্মী। এলাকার কমিটিতে খাটো ধরণের একটি পদও নাকি সে পেয়েছে। এসব কথা তিনি শুধু শুনেছেন কারো কাছে। কিন্তু আজ বক্তৃতার মঞ্চে ছোট ছেলেটির বজ্রকণ্ঠে দেয়া শ্লোগানগুলো তাকে নির্বাক করে দিয়েছে।
গ্রামের বড় বাজার ঘেঁষে তার বাড়ি। দেশ স্বাধীনের পর এখানে নতুন বাড়ি করেছেন মখদ্দস আলী। যুদ্ধের সময় লুট করে জমানো টাকা-কড়ি কাজে লাগিয়েছেন বড় আকারের এ বাড়িটি তুলে। বাজারে মিছিল, জনসভা, লড়াই-হাঙ্গামা যাই হয় তিনি স্পষ্ট শুনতে পান বিছানায় শুয়ে শুয়ে। তার ছোট ছেলে মঞ্চে শ্লোগান দিচ্ছে-‘রাজাকারের চামড়া, তুলে নেব আমরা’ ‘আর কোনো দাবি নাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই’। শ্লোগান গুলো শুনে কান খাড়া করে থাকেন তিনি। নিরবে একাকি ভাবেন-ছেলেটি হয়তো জানে না তার জন্মদাতা এই পিতাটি মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারের মতো কর্মকাণ্ড করেছিল। নাকি সে জেনেও পিতার কলঙ্ক মোচনের অপচেষ্টা করছে? বৃদ্ধ লোক তিনি। অনেক বছর হয় মানুষের সাথে দেখা সাক্ষাত যোগাযোগ নেই। লোক মুখে তার কথা এখন আর শুনা যায় না। সবাই হয়তো ভেবেছে মরে গেছি। মখদ্দস আলী আবার ভাবতে থাকেন। ভেবে ভেবে মনে মনে কথা বলেন। তখনও ছেলেটির জন্ম হয় নি। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় স্থানের পথ ও আস্থানা পাক সেনাদের দেখিয়ে দিয়ে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলাম। পাক সেনা এবং মুক্তিযুদ্ধাদের মাঝে তুমুল যুদ্ধ গুলাগুলি চলছে। জীবন প্রদীপ হাতের মুঠোয় রেখে গুলাগুলির ভেতর দশটি ঘর লুট করে তার মায়ের কাছে দিয়ে আবার সেনাদের কাছে ফিরে এসেছিলাম। তখন যদি মৃত্যু হত তবে কিভাবে তার জন্ম হত? সিঁদেল চোর নিয়ে এতো ঘাটাঘাটি, গালাগাল হয় কিন্তু পুকুর চোরদের নিয়ে কেউ টু শব্দ করার সাহস পায় না কেন? বাবারা, তোমাদের স্বাধীন দেশকে পুকুর চোরেরা পাকআমল থেকেও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ওদেরও চামড়া খসানোর শ্লোগান তুলো।
মখদ্দস আলীর ভাবনায় জট পেকে যায়। মঞ্চে বক্তৃতা হচ্ছে, শ্লোগান চলছে। তার হৃদয় আকাশে বৈপরীত্য স্রোত বইতে থাকে। তবে সত্যিই কি আমি ঘৃণিত রাজাকার? আমি কি যুদ্ধাপরাধী?
স্বীয় রক্তের আপন ছেলেটি বলছে আমার পিঠের চামড়া খসিয়ে নিতে? সে কি আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মারবে? বাকহারা মখদ্দস আলী বিছানায় ছটফট করেন আর গড়াগড়ি খান। তার সব ক্ষোভ এসে পড়ে আজরাঈল (আ.) ফেরেশতার উপর। গুলাগুলির ভেতর না হয় মরণ বার্তা নিয়ে আসনি তবে এখনো কেন আসছ না? আপন ছোট ছেলের কাছে ফাঁসির হুমকি ও গালমন্দ শোনার জন্য না হয় এতো দিন অপেক্ষা করছিলে, আর কিসের অপেক্ষা? ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলার? মখদ্দস আলী রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধী বিষয়টি গুলিয়ে একাকার করে ফেলেন। তিনি অবুঝের মতো অযাচিতভাবে সব অপরাধ নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নেন। তার মনোভাব এমন যে, তিনিই যেন সব দোষের দোষী। ছেলের জন্য অভিশাপের অভিপ্রায়ে বলেন-যদি শরীরে অন্তত: নিজের চেষ্টায় উঠে বসার ক্ষমতা থাকত তবে এই ছোট ছেলেকে ত্যাজ্য পুত্রের ঘোষণা দিতাম।
মখদ্দস আলী অসহায়ভাবে ফেল ফেল করে নির্বাক খাঁটি রাজাকার সেজে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ তার মুখের পরিচিতি অবয়ব পাল্টাতে থাকে। মারাত্মক ভয়ে সমস্ত মুখ পাংসুটে বর্ণ ধারণ করে। এ কিসের ভয়? ফাঁসি কাষ্ঠের দড়ি দেখে নাকি পিঠের চামড়া খসানোর যন্ত্রনা ভেবে? তার কপাল বেয়ে ঝরতে থাকে অশ্র“র নহর। তিনি বিড় বিড় করে বলতে থাকেন-আল্লাহ তুমি বড় দয়াবান। তোমার এ পাপিষ্ঠ গোলামকে মাফ করে দাও। তোমার ফেরেস্তা আজরাঈল (আ.)-এর কোনো দোষ নেই। যত দিন হায়াত আছে তিনি তো জান কবচ করবেন না। আমি রাজাকার হতে পারি, কিন্তু খুন, ধর্ষণ করিনি। খুনের জন্য প্ররোচনা দেই নি। হে আল্লাহ! তুমি তো সব দেখেছ, তুমি তো সব জানো। পেটের তাড়নায় বিপদগামী হয়ে তোমার নির্দেশ অমান্য করে চুরি-লুট করেছি কেবল। পাপীষ্ঠ এ বান্দাকে মাফ করে দিলে তোমার রহমের এক বিন্দুও কমতি হবে না। হে রাব্বুল আ’লামীন! আমি ভয় করি না দুনিয়ার কোনো শাস্তি ও নিন্দা। আমার ভয় শুধু পরকালের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর আজাবের’। মৃত্যুকষ্ট শিয়রে রেখে জাহান্নামের ভয়ে অশ্র“র নহরে সিক্ত হতে থাকে মখদ্দস আলী রাজাকারের শুভ্র দাঁড়ি।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *