নির্জন হিজল বনে

গোরস্থান আর নির্জন হিজল বনের গাঁ ঘেষে আধাপাকা পথটি গ্রামের বাজারে গিযে় মিশেছে। পথের দু’পাশ ঘিরে ছোট-বড় বাডি়গুলো দূর প্রান্তরে গিযে় শেষ হযে়ছে। সারিবদ্ধ বৃক্ষরাজি মাথা উঁচু করে ছাতার মতো শাখা মেলে আপন ছায়ায় চেনা অচেনা পথিককে যেন হাতছানি দিযে় ডাকছে। কিছুদিন আগের শ্যামল হাওর এখন কাঁচা-পাকা ধানে রুপালী রঙে রাঙ্গা হযে় উঠেছে। ধানের শীষে বাতাসের ছোঁয়ায় অপরুপ ঢেউ খেলছে। পাকা ধান দেখেই বুঝা যায় দু’এক দিন পর ধান কাটার ধুম পড়বে।
হাসান আলী নিজের জমিতে এসে ধানের ভাল ফলন দেখে বেশ খুশি হলেন। মনে মনে তিনি মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। বন্যার পানিতে সারা দেশে দুই বার ধান ক্ষেত নষ্ট হলে দেশ জোডে় অজানা এক আশংকা আর হাহাকার বিরাজ করে। কিন্তু মুুমিন ঈমানদার লোকেরা আল্লাহর উপর পুর্ণ ভরসা রেখে তার রহমত কামনায় করজোডে় রুনাজারী করতে থাকেন। দুর্বল ঈমানের লোকেরা দুর্ভিক্ষের ভযে় অশান্তির আগুনে পডে় খাদ্য মজুদ করতে ব্যস্ত হযে় পডে়। আল্লাহ তায়ালা অসহায় মানুষের আর্তনাদে তুষ্ট হযে় এ বছর বেশ ভাল ফসল দিযে়ছেন। সারা দেশেও ভাল ফসলের সংবাদে হাসান আলী আনন্দিত হন। তিনি বিড় বিড় করে বলেন ‘আল্লাহ গরীবের ডাক শুনেছেন’।
হাসান আলী ধান ক্ষেত দেখে মাঠ থেকে বড় পথে এসে উঠেন। পথের দু’পাশের বৃক্ষরাজির সুশীতল ছায়ায় তার দেহ প্রাণ জুডি়যে় গেল। পথ চলতে চলতে গোরস্থানের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ান। গোরস্থানে তিনটি নতুন কবর পথিকের চোখ দু’টি সহজে কাডে়। নতুন কবরের বুকে মাটিতে ভুঁই ছিটানো। রোদের আলোয় তিনটি কবরের বুক কেমন ঝলোমলো করছে। কবর তিনটিতে কে কে চিরজনমের জন্য শুযে় আছেন তা হাসান আলী ভাল করেই জানেন। পলাশ গ্রামের ছতই মিয়া, কাজল পাড়ার আখন ডিলার, বালাকুট পাড়ার নেজাম আহমদ এ তিন মানব সন্তান মাত্র দু’তিন দিনের ব্যবধানে মায়ার পৃথিবী ছেডে় পাডি় জমালেন নিঃশব্দ কবরে। হাসান আলী ভাবনার রাজ্যে সাতরাতে থাকেন। আখন ডিলারের সম্পত্তির দাপট তার মনের চোখে জীবন্ত হযে় নডে় উঠে।
গ্রামের অনেক গরীব লোক নিরুপায় হযে় তার কাছ থেকে ঋণ নিযে় জমিনে ফসল ফলাত। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে নামে মাত্র মূল্য দিযে় অসহায় দরিদ্র লোকদের সব ধান নিযে় যেত আখন ডিলার। কত মানুষ চোখের জল মুছে মুছে কচি সন্তানদের চোখের সামনে থেকে বস্তা ভরে ধান এনে আখন ডিলারের কাছে স্বল্পমুল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হত। কেউ ধান দিতে না পারলে ঋণ পরিশোধ করতে অপারগ হলে সে থানায় মামলা করে সর্বস্ব লুটে নিত। ভযে় কেউ এ সবের প্রতিবাদ করতনা। প্রতিবাদ করার ক্ষমতা যাদের ছিল তারা কোনো না কোনো সূত্রে আখন ডিলারের আত্মীয় হয়। সম্পদের পাহাড় গডে় ধূলার ধরণীতে সব ফেলে রেখে সেই আখন ডিলার আজ কোথায়? হাসান আলী একবার পথের দিকে তাকান আবার আখন ডিলারের কবরের দিকে চোখ ফেরান। আখন ডিলারের পার্থিব জীবন, সম্পত্তি আর কবর থেকে হাসান আলী আরো গভীরভাবে যেন অশেষ ইবরত হাছিলে মগ্ন হযে় পডে়ন। হঠাত তার ইচ্ছা হলো অদৃশ্য আত্মাকে প্রশ্ন করে বলবেন -হে আখন ডিলার! তোমার এত সম্পদ ও প্রতিপত্তির দাপট তোমাকে কি পারলোনা মৃত্যুর ছোবল থেকে রক্ষা করতে? কিন্তুু এ প্রশ্নটি করা হলোনা হাসান আলীর। তিনি বরং স্বীয় কৃত কর্মের জন্য লজ্জিত হযে় বলেন – হে হাসান ! কবরে শান্তির জন্য, পুলসিরাত নিষ্কন্টক করতে তুমি কি সম্বল সংগ্রহ করেছ? তোমার ডাক পড়তে আর কতক্ষণ?
বিজন কোলাহল শূন্য গোরস্থানে শুযে় আছেন অসংখ্য নর-নারী। এই মানূষেরাইতো একদিন এই জমিনে বুক উঁচু করে বিচরন করতেন। আজ সবাই কোথায়? কোন অবস্থায় কাটছে তাদের কবর জিন্দেগী? সে কোন অদৃশ্য সুতোর টানে বুকের কথা বুকেই রেখে নিরবে নিভৃতে একাকি পাডি় জমালেন অজানার পথে, কেমন অভিমানে আপনজনদের পিছনে ফেলে? মনের প্রশ্ন মনেই গুমরে কাঁদে, উত্তর খোঁজে পান না হাসান আলী। গোরস্থানের বুক জুডে় ঠায় দাঁডি়যে় থাকা কবরবাসীর একান্ত আত্মীয় বিরাট বটবৃক্ষের দিকে অপলক তাকিযে় হাসান আলী ভাবেন- হাজার বছরের সাক্ষি এই বৃদ্ধ বটবৃক্ষ দেখেছে সব। গোরস্থানের মাটির পরতে পরতে হাজার বছরের ইতিহাস লেখা আছে সুস্পষ্টভাবে।সে লেখাটি পড়ার ভাষা জানলে বটবৃক্ষ অবশ্যই মুখ ফুটিযে় সাক্ষী দিত- কত তৃপ্ত আর অতৃপ্ত আত্মার দীর্ঘশ্বাস ছডি়যে় আছে নির্জল হিজল বনের বাতাসে।
হাসান আলীর আজ যেন কি হযে়ছে, তিনি ভেবে তার জবাব পান না।এই গোরস্থানকে ফেলে রেখে চলে যেতে কেন যে তার মন চাচ্ছে না।হাসান আলী ভাবেন আজ হোক,কাল হোক, কোনো না কোনো একদিন এখানে তো আসতেই হবে সকল কর্মব্যস্ততা ঘুচিযে়। তারপর চিরশাযি়ত হতে হবে পৃথিবীর সকল বন্ধন ছিন্ন করে। এর পর তার কথা হয়তো সবাই ভুলে যাবে। কোনো নেক দিযে় প্রভুর দরবারে দু’হাত তুলে তার জন্য কি একটু প্রার্থনা কেউ করবে? ছোট কালে মাঝে মাঝে, বিশেষ করে ঈদের দিনে বাবা হাত ধরে নিযে় আসতেন এই গোরস্থানে। আঙ্গুল ইশারা দিযে় বলতেন, এই হচ্ছে তোমার দাদার কবর, ঐ হল তোমার দাদীর কবর, আর ঐযে বটবৃক্ষ দেখছো তার ঠিক পশ্চিম পাশে তোমার এক ফুফুর কবর। বাবা আমাকে নিযে় দীর্ঘসময় গোরস্থানে কাটাতেন আর জিয়ারত করে চোখের পানিতে বুক ভাসিযে় কবরবাসীর জন্য দোয়া করতেন। আরো কত মানুষ এভাবে জিয়ারত করতেন তা ভাবলে বড় দুঃখ লাগে,বড় কষ্ট হয়। কেননা সে সব মানুষ আজ আর বেঁচে নেই। সবাই পাডি় দিযে়ছেন আপন ঠিকানায়, মাটির ঘরে।
একটি পাখি হিজল বনের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে কিচির মিচির ডেকে ডেকে উডে় গেল। হাসান তাকালেন সে দিকে। হিজল বনের দিকে চেযে় মনটা কেমন আনচান করে উঠলো। কত মানুষের স্বপ্নের বালুচর ভাঙার বেদনা মিশে আছে এই হিজল বনের লতা পাতায় -তার হিসাব কেউ জানে না। পাশের জারুল গাছটি যেন থম থমে মুখে একদৃষ্টে খুটে খুটে তাকে দেখছে। পুরনো কেউ বহুদিন পর আসায় গাছটি যেন বেশ অভিমানের চোখে তাকাচ্ছে। পথের উপর কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিযে় হাসান আলী সম্বিৎ ফিরে পেলেন। কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো কেমন বিদ্রুপ করে মিটি মিটি হেসে তাকে অবলোকন করছে। হাসান আলী চোখ ফিরিযে় নিলেন।
নতুন তিনটি কবরের একটু উঁচুতে যে কবরটি তাতে শুযে় আছেন ছতই মিয়া। তিনি বেশ সহজ সরল ছিলেন। তিনি কারো সাতেও ছিলেন না, পাঁচেও না। তার মৃত্যুতে গ্রামের মানুষেরা বেশ শোকার্ত হযে়ছে। দিন রাত ফকিরের মতো চলতেন ছতই মিয়া। ছেলেদের বিশাল সম্পত্তির প্রতি তার কোন আগ্রহ ছিল না। ছেড়া লুঙ্গি, ছেড়া জামা তালি দিযে় সেলাই করে আবার পরতেন তিনি। ফজরের আজানের সাথে সাথে আল্লাহর জিকির দিযে় সমস্ত গ্রাম প্রকম্পিত করে তুলতেন। সবাই নামাযে যেতে উচ্চ কন্ঠে ডাক দিযে় বলতেন ‘গ্রামবাসী জাগো, ঘুম হতে নামাজ ভাল।’ যারা নামাযে আসতোনা তারা ছতই মিয়ার প্রতি বেশ বিরক্ত ছিল। তাদের আরামের ঘুম নষ্ট হয় বলে তারা ছতই মিয়াকে বলতো- তোমার নামায তুমি পড়বে, এতে সারা গ্রাম জাগানোর কি দরকার? বেনামাযী লোকদের কথায় ছতই মিয়ার কোন ভাবান্তর হতোনা। তিনি তাদের কথা শুনেও না শুনার মতো ভাবলেশহীন থাকতেন। মৃত্যুর পূর্ব দিন পর্যন্ত তিনি ফযরের সময় গ্রামের লোকদেরকে নামাজের প্রতি আহবান করেছেন।
ছতই মিয়া গরীব অসহায় মানুষের বড় আপন জন ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ভাবে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি দরিদ্র কৃষকদেরকে সাধ্যমত শর্তহীন ঋণ ও দিতেন। কেউ ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হলে কিংবা দেরী করলে কারো প্রতি বিমূখ হতেননা। ঋণ দিযে় কারো প্রতি জুলুম করাতো দুরের কথা বরং কারো কারো ঋণ মওকুফও করে দিতেন।
নতুন তিনটি কবরের মধ্যে একটু ঢালুতে তৃতীয় কবরটির প্রতি দৃষ্টি দিতেই হাসান আলী একেবারে মুষডে় পড়লেন। বড় কম বয়সে আল্লাহর পাক নেজাম আহমদকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। পাক মাওলার মহিমা বুঝা সত্যিই বড় বিস্মযে়র। নেজাম আহমদের মৃত্যুতে চারটি আদম সন্তান এতিম হলো, বিধবার শুভ্র শাড়ী পরলো স্ত্রী রাহেনা বেগম। নেজাম আহমদের আকস্মাৎ মৃত্যুতে এতিম সন্তানদের অবিশ্রান্ত রোদনে সেদিন যেন আকাশ বাতাসও বুক ধরাতে পারেনি। এতিম চার সন্তানের মধ্যে ফুলের মতো নিষ্পাপ কচি ছেলে দুটির কান্নায় প্রকৃতিও যেন কাঁদছিলো আপন সুরে। সন্ধ্যার পর কবরস্থ করা হয় নেজাম আহমদকে। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র মিট মিট করে জ্বলছে। মাথার উপর চাঁদ যেন বিষন্ন মুখ জ্যো¯œার সফেদ চাদর দিযে় দাপনকারীদের ঢেকে রেখেছে। নির্জন হিজল বনে জোনাকির আনাগোনা, অচেনা পাখির ডানা ঝাপটানো শব্দ, ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের একটানা সুর, বট বৃক্ষ আর জারুল গাছের থম থমে মুখ- এই পরিবেশে দুটি কচি শিশু চোখের অশ্রু দিযে় আপন পিতার কবরের মাটি সিক্ত করে তুলেছিল । হাসান আলী সেই বিরহ গাঁথা দুঃখ সন্ধ্যায় কর্দমাক্ত দুটি হাত কচি দুই শিশুর মাথায় রেখে সজল নেত্রে বলেছিলেন- আল্লাহ তোমাদের সহায় আছেন বাবারা। আনমনে সকলের অগোচরে মনের ভাষায় আরো বলেছিলেন- চোখের অশ্রু দিযে় যদি তোমাদের পিতৃবিযে়াগের কলিজার আগুন নেভানো যেত, তবে এই ফকির হাসান দিন রাত কেঁদেই যেত। আল্লাহর তার রহমতের শীতল ছায়ায় তোমাদের কলিজার সে আগুন যেন নিভিযে় দেন এই দোয়া করি।
সূর্য্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পডে়ছে। দু’চোখের অশ্রুতে হাসান আলীর দাডি় ভিজে উঠেছে। তিনি আর ভাবতে পারছেন না। গোরস্থান আর নির্জন হিজল বনকে পিছনে রেখে তিনি বাডি়র পথ ধরার ইচ্ছা করলেন। কিন্তুু তার পা দু’টি যেন অচল হযে় পডে়ছে। গোরস্থানের মাটি বুঝি তার পা দু’টিকে শক্ত করে আকডে় ধরেছে। হাসান আলী অনেক প্রচেষ্টায় যেন গোরস্থানের মাটি থেকে পা তুলতে পারছেন না। প্রখর রোদে বহু দূরে মাঠের প্রান্তরে দেখা গেল মরিচিকায় গ্রাম গুলো দোল খাচ্ছে। অজানা স্থান থেকে ভেসে এলো কোকিলের কুহু কুহু করুন আর্তনাদ। মসজিদের মিনার থেকে ‘আল্লাহু আকবার’ আজানের ধ্বনি নির্জন হিজল বন আর গোরস্থানের ছোট-বড়, চেনা-অচেনা অসংখ্য বৃক্ষের পাতায় পাতায় স্বর্গীয় সুর তুলে আকাশ বাতাস কাঁপিযে় ছুটে চললো আরশে আযীমের দিকে ।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *