ঝরে পড়া ফুল

হৃদয়ে কিছু কান্নার অংশ থাকে যেখানে প্রিয়জনের জন্য ভালবাসার ফোয়ারা না দেখা কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। বারেবারেই মনে পড়ে আমার সেই মায়াবতী নারীর কথা। আর কেনই বা মনে পড়বে না? তিনি যে আমার পরম আত্মীয়া হন। রক্তের সম্পর্কের চেয়ে মনের সম্পর্ক কোন অংশেই কম নয়। আর যাদের সাথে মনের সম্পর্ক আর রক্তের সম্পর্ক দুটোই বিদ্যমান থাকে তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।
নাম ছিল তার সুফিয়া বেগম। সবাই তাকে সুফি বলেই ডাকত। ফিলোসোফারদের মতো গ্রাম্য মেয়ে সুফিয়ার দর্শন জ্ঞান ছিল না বটে তবে তার মনটা ছিল আকাশ ছোঁয়া পবিত্রতায় পূর্ণ। পাঁচ ভাইবোনের একটি মাত্র বোন সুফিয়া লেখাপড়ায় ছিলেন ভীষণ ফাঁকিবাজ। বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিল। বিঘার পর বিঘা জমিতে চাষাবাদ হত। শস্য থাকত উঠোন ভরে। যখনই মা তাকে পড়তে ডাকতেন তখনই সে বাহানা করত: মা আমি কলপাড়ে প্লেট ধুয়ে আসছি। মাও কয়েক বার ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে তার কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। এভাবেই পড়ার সাথে লুকোচুরি নয় যেন জীবনের সুখগুলোর সাথে লুকোচুরি করেই সময় কাটিয়ে দিত সুফিয়া। লেখাপড়ায় তত ভালো নয় বলে মা বাবা এবং আত্মীয় স্বজনরা মিলে তার বিয়ে ঠিক করে পাশের গ্রামের আলতাফ হোসেনের সাথে।
সুফিয়ার বর আলতাফ হোসেনেরও ছিল অনেক জায়গা জমি, কাঠের দোতলা বাড়ি, বাড়ির একপাশে একটি বড় পুকুর। সেখানে চাষ হত মাছের আর পুকুরের চারপাশে ছিল বড়সড় আর উন্নত জাতের বিভিন্ন ধরণের আমের গাছ। তবে লোক হিসেবে আলতাফ হোসেন ছিলেন ভীষণ কৃপণ টাইপের। অভাবী মানুষকে দান -দক্ষিণা তো দূরের কথা বাড়িতে বেড়াতে আসা মেহমানদের জন্যও অধিক খরচ করা তার পছন্দ ছিল না। সুফিয়া ছিলেন আবার খুব অতিথি পরায়ণ। দুজনার মনের সাথে ছিল যেন দুই মেরুর ব্যবধান তবু একই বন্ধনে গাঁথা। আদুরে দুলালী সুফিয়া কটুবাক্য শুনতে মোটেই অভ্যস্ত ছিলেন না তবু সামান্য একটু ভুলভ্রান্তিতে ধমক আর কটাক্ষ হজম করতে হত আর নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলতেন। বাপের বাড়ি যেতে চাইলে তার স্বামীর অনুমোদন পাওয়া দুরূহ হয়ে দাঁড়াত। এত বড় বাড়ি একাই থাকে আলতাফ হোসেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। তার বাবা মৃত্যুবরণ করেন বিয়ের কয়েক বছর আগে আর মাও পরলোকগত হন সুফিয়ার বাড়িতে বৌ হয়ে আসার কিছুদিন বাদেই। তার বোন ছিল তিনজন। তবে তাদেরকে তিনি প্রশ্রয় দিতেন না মোটেও। এটা সেটা আবদার করে যদি তারা আবার অর্থের বিয়োগ ঘটায় সেই ভয়ে। তাই বোনেরা ভাবীকে ভালোবাসলেও ভাইয়ের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে আর সেদিকে পা দিতেন না। সুফিয়া বেগমের তিন ছেলে দুই মেয়ে হবার পরেও আমার কাছে তাকে পরির মতোই সুন্দরী মনে হত।

বিদ্যালয়ের ছুটি হলে ডিসেম্বর মাসে আমরা সাধারণত ঢাকা থেকে গ্রামের পথ ধরতাম। অন্য সব আত্মীয়ের বাড়ির সাথে সাথে তাদের বাড়িতেও বেড়াতে যেতাম। তিনি যেই শুনতেন আমরা এসেছি এক দৌড়ে পৌঁছতেন বাড়ির ঘাটায়। আমাদের ভ্যান থামতে না থামতেই তিনি হাজির হয়ে যেতেন। আর বাড়ি পর্যন্ত লম্বা পায়ে হাঁটা রাস্তাটা আমাকে কোলে করে নিয়ে যেতেন। এরপরে গাছ থেকে ডাব পাড়িয়ে এনে ডাবের শরবত আর সেই সাথে লেবুর শরবত করে দিতেন। এরপর চলত তার নানাবিধ পিঠাপুলি বানানোর সাথে সাথে ঝালভাত রান্নার আয়োজন।
সুফিয়ার স্বামী সারাদিন গঞ্জে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। দুপুরে সাধারণত খাবারের জন্য আসতেন আবার কোন কোন দিন একসাথে রাতেই বাড়ি ফিরতেন। ভুল হলে ক্ষমা নামক শব্দটি আলতাফ হোসেনের খুব কম জানা ছিল। মাঝেমধ্যে মারধরও করতেন সুফিয়াকে। একবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে সুফিয়া মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান। বাপের বাড়িতে খবর পৌঁছলে তার ভাইয়েরা তাকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করায়। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য তারা ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন আমি তাকে মুখ ও চোখ ফোলা অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলাম। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল আমার তার সেই অবস্থা দেখে। কিছুদিনের চিকিৎসার পরে সুফিয়া বেগম সুস্থ হলেন। এতকিছুর পরেও সুফিয়া তার ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে ভাইদের কথা অমান্য করে আবার আলতাফ হোসেনের বাড়ি ফিরে আসেন। তখন থেকেই তার মাথায় মাঝেমধ্যে ব্যথা করত।
পিতামাতার কখনওই সন্তানকে অভিশাপ দেওয়া ঠিক নয়। কারণ তাদের দোয়া যেমন তাড়াতাড়ি লাগে তেমনই বদদোয়াও লেগে যায়। আলতাফ হোসেনের সামান্য ব্যাপারে বদদোয়া দেওয়ার প্রবণতাও ছিল । একবার তেমনই এক সামান্য কারণে তার ছোট ছেলেকে বদদোয়া দিলেন:”তুই মর। গলায় গামছা বেঁধে রক্ত পড়ে মর। “আমি সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তার এ ধরণের কথা শুনে। সুফিয়াকে বললাম,”এ ধরণের বদদোয়া পিতা হয়ে সন্তানকে কখনওই করা উচিত নয়। ফলে গেলে সেটা কতই না মন্দ হবে !”তবে সুফিয়া বেগম জোর খাটিয়ে কোন প্রত্যোত্তর করতে পারতেন না। সত্যিই অবাক লাগে ভাবলে তার সেই ছেলেটি মেট্রিক পরীক্ষা শেষে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসার পরদিন হঠাৎ রক্তবমি করা শুরু করে দেয়। তখন তার গলায় একটি গামছা ছিল যা দিয়ে সে বারবারই সেই রক্ত মুছছিল। আব্বা তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারের পরীক্ষায় যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। এরপর ঢাকায় মাস খানিকের মধ্যেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছেলেটি মারা যায়।
আলতাফ হোসেন তার ঢাকায় রেখে লেখাপড়া করানো বিএ পাশ বড় ছেলেকে বিয়ে করাবেন তাই মেয়ে খুঁজছেন। ঢাকার কোন বড়লোকের মেয়ে হতে হবে যাদের বাড়ি গাড়ি থাকবে, টাকার গাছ থাকবে যে গাছ থেকে ঝাকি দিয়ে দিয়ে সারাটি জীবন আরও সচ্ছলতায় কেটে যাবে তাদের। ছেলেকে ঢাকায় রেখে মানুষ করতে তার অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়েছে। তাই পাত্রী পক্ষকে সেগুলোর কিছু শোধ তো দিতে হবে। আমি শুনে বড় ছেলেটিকে বলেছিলাম :”গ্রামের একটি মেয়ে বিয়ে করুন যে আপনার মায়ের পাশে থেকে তাকে শান্তি দেবে। বিয়েতে যৌতুক নেওয়া ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষের কাজ না। ” কে শুনে কার কথা ? তারা তাদের পথেই অবিচল রইল আর ঢাকার এক বাড়ি ওয়ালার মেয়ে বিয়ে করে যৌতুক নিয়ে বিদেশে যাওয়া জন্য রওয়ানা হলো। সারাটিজীবন সুখে কাটানো আলতাফ হোসেনের ছেলে কি বিদেশের পরিশ্রমী জীবন সইতে পারে? অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয় সে ইউরোপের কোন এক হাসপাতালে। বাড়িতে তার মা এক সন্তান হারিয়ে অন্য সন্তানের দূর দেশে বেশ কিছু দিন নিখোঁজের পরে অসুস্থতার কথা সইতে পারেন নি। প্রতিদিনই তার কান্নাকাটি আর আহাজারির ভেতরে কাটাতে কাটাতে একদিন ব্রেইনে স্ট্রোক করেন। সেই থেকে নির্বাক শুধু নয় প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় যান। লোকজনকেও খুব কম চিনতে পারতেন সুফিয়া। তখন তার পাশে খানিকটা সময় কাটিয়ে এলে চোখের পানি বাঁধ মানত না আমার। এ কি সেই সুফিয়া যাকে এতোগুলি বছর আমি দেখেছি? এ কি সেই সুফিয়া যে ঘাটায় এক দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যেত? পাঁচ বছর পর্যন্ত এভাবেই জীবনের সাথে সংগ্রাম করে করে নিরবে অভিমানে সুফিয়া হারিয়ে যান আমাদের সবাইকে ছেড়ে অন্য এক ভুবনে। এখানে যে তার মনের কোন মূল্য নেই … তার আবেগ অনুভূতির কোন দাম নেই…তার আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসাকে অনেকেই দুর্বলতা ভেবে আঘাত করে-
তার জীবনের করুন পরিণতির কথা যখনই আমার স্মরণ হয় তখন সবসময়ই আমি ভাবি নারী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। আজ যদি সে পড়াশোনা শেষ করতে পারত তবে তার জীবনের গল্পটা হয়ত এতোটাই ব্যথার হত না। সে অন্ততপক্ষে প্রতিবাদ করতে জানত তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে। আবার প্রয়োজনে নিজের উপার্জন নিজেও করতে পারত। জীবনের প্রয়োজনেই মানুষের জীবিকার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। শিক্ষা নামক হাতিয়ারটা হাতছাড়া করা ঠিক নয় অন্ততপক্ষে বিপদসংকুল মুহূর্তের জন্য।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *