এখন তিনি এমপি

মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করে মুতি দেয়া কম্বলটা গা থেকে নামিযে় আস্তে করে গোছাতে গোছাতে মনে পড়ল আজ ১৬ই ডিসেম্বর। আমাদের বিজয় দিবস। মনে পড়ল, আজকের বিকেলে অনুষ্ঠিতব্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আযে়াজকদের কথা। দেশ স্বাধীনের আজ এতোদিনপর একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কাছে পেযে় ছেলেগুলো আনন্দে একদম ফেটে পডে়ছে। ফাতেমাতুজ জোহরার বুক গর্বে ভরে ওঠে। তিনি মশারীর ভাজটা সেরে নিয়মমাফিক অযু করতে যাবেন। এই একটা কাজ, সামান্য অন্ধকারে অযু করতে ঘাটে যেতে এই পড়ন্ত বয়সে গ্রামের বাডি় এসে বেশ কষ্ট পোহাতে হয় ৪০ বছরের প্রবাসী ফাতেমাতুজ জোহরাকে। তিনি দেশে ফিরেছেন এক সপ্তাহ হল।
দীর্ঘ ৪০ বছর লন্ডন থেকেও লন্ডনীকন্যা হযে় যাননি তিনি। এদেশের মাটির সাথে তার রক্তের বন্ধন। সেই দুঃস্বপ্নের ৭১-এ নিজের বাহুর রক্ত কম ঝরাননি আর স্বামীকে তো এই মাটির বুকেই সপে দিযে়ছিলেন। এতোদিন ভাইযে়র অনুমতি পায়নি বলেই এমাটির বুকে ফিরে আসতে পারেননি। সেই যে দেশ স্বাধীন হবার পর লন্ডনে ভাইযে়র ওখানে উঠেছেন আর কোথাও যাননি। ভাইযে়র সব অনুরোধ রক্ষা করলেও দ্বিতীয়বার বিযে় করতে রাজি হননি তিনি।
দেশে ফিরে এই এক সপ্তাহে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এলাকার ছেলেদের থেকে যে সম্মান পেযে় আসছেন, এই দেশের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার সম্মান তাতে আরো বেডে় গেছে। এই দেশ আর এই দেশের সোনার ছেলেদের ছেডে় আর কোথাও যেতে তার মন চাইছে না। আজ বিজয় দিবসে তাকে সংবর্ধনার আযে়াজন করেছে এলাকার ছেলেরা। বিভিন্ন রাজনীতিক, লেখক, সাংবাদিক আর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে আমন্ত্রণ করা হযে়ছে। ফাতেমাতুজ জোহরার বুক আবারো আনন্দে নেচে ওঠে।

দুই
নির্দিষ্ট সমযে় বিকেল চারটার মধ্যে অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হয়। উপস্থিত সুধীবৃন্দের মাঝে এলাকার এমপি সাহেবও উপস্থিত আছেন। রহমতপুর হাইস্কুল মাঠে আযে়াজিত জনসাধারণের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো। অনুষ্ঠান চলছে। একে একে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের নিযে় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করে যাচ্ছেন মাননীয় সুধীজন।

কিন্তু যাকে নিযে় এই আযে়াজন, সেই বীরমুক্তিযোদ্ধা ফাতেমাতুজ জোহরার চেহারায় কিসের এক আগুন যেন দাউ দাউ জ্বলছে।
ছেলেরা লক্ষ্য করে কযে়কজন তার কাছে এগিযে় যায়। কানের কাছে মুখ নিযে় কোন সমস্যা হযে়ছে কিনা জিজ্ঞেস করে। ফাতেমাতুজ জোহরা কোন কথা বলে না। ছেলেরা আরো কিছুক্ষণ তার চোখে তাকিযে় থাকে। তারপর তিনি ওদের দিকে মুখ ফিরিযে় শুধু বলে-‘আমি বক্তৃতা করব, আমাকে মাইক দাও। ’ ছেলেরা বলে আগে সংবর্ধনা দেয়া হবে তারপর বক্তৃতা। তিনি কারো কথা শোনেন না। বলেন, এক্ষুণি আমি বক্তৃতা দেবো, তোমরা ঘোষণা দাও।
ফাতেমার অগ্নিমুখে তাকিযে় ছেলেরা আর কথা বাড়ায় না। তডি়গডি় ঘোষণা দিযে় দেয়। ছুটে গিযে় মাইক্রোফোন ছিনিযে় নেয়। তার এই অগ্নিমূর্তি দেখে হতচকিযে় যায় মঞ্চে উপবিষ্টরা।
ফাতেমাতুজ জোহরা শুরু করেন তার কথা-উপস্থিত সর্বস্তরের জ্ঞানী, গুণী সুধীজন, সবাই আমার সালাম ও শ্রদ্ধা জানবেন। আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সবারই কমবেশি ধারণা আছে। আজ আমি আমার জীবনের সবচেযে় স্মরণীয় ঘটনার কথা বলব।
একটু আগের সেই আগুন মূর্তিটি মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন গলে গলে পড়তে চায়। তিনি যেন মাটির সাথে মিশে যেতে চান। তার চোখে ৭১-এর সেই ভয়ংকর দিনগুলি একেক করে যেন ভীড় ঠেলে সামনে এগিযে় আসে। তিনি যেন এই মঞ্চে আর নেই। চলে গেছেন দুঃস্বপ্নের সেই কালো রাত্রির অন্ধকারে। যেন বন্দুক হাতে ছুটে চলছেন একদল দুরন্ত মুক্তিযোদ্ধার সাথে। তার চোখে ভেসে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ভীতিময় দিনগুলো। একেক করে সব কিছু যেন কুয়াশা মুছে স্পষ্ট হযে় উঠছে। দেশে তখন সংকট সব কিছুতে। প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তার চেযে়ও বেশি নিরাপত্তাহীনতা। বিযে় হযে়ছে মাত্র চার মাস। স্বামী যুদ্ধে যাবে। ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুড়-শাশুডি়র কাছে থাকতে ভরসা হল না। জেদ ধরল স্বামীর সাথে যুদ্ধে যাবে।
শেষমেষ চলে গেলো স্বামীর সাথেই। স্বামী-স্ত্রী বলে একই সেক্টরে একই সাথে থাকে। ট্রেনিং হয়, যুদ্ধ হয়। যুদ্ধ ক্ষেত্র অন্য এলাকায় বলে বাবা মাযে়র সাথে দেখা করতে অসুবিধা। তাই প্রায় মাসখানেক পর রাতের অন্ধকারে দুজনের দুই ছায়ামূর্তি এগিযে় চলে বাডি়র দিকে। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহায়। অল্পতেই তারা ধরাশায়ী হয় মিলিটারী আর রাজাকারের হাতে। ‘এরা মুক্তি’ কথাটা মিলিটারীর কানে পৌঁছতেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে তারা। রাইফেল হাতে লোড করে গুলি। এমন সময় এক ঝটকায় রাজাকারের হাত থেকে প্রাণপণে দৌঁডে় পালায় ফাতেমাতুজ জোহরা। আর স্বামী তার ওখানেই শহীদ হন। পর দিন সকালে তার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া যায়।
কিন্তু এতেই দমে যাননি ফাতেমা। প্রতিশোধের আগুন নিযে় আবারো ঝাপিযে় পডে়ছেন যুদ্ধে। অবশেষে একদিন স্বাধীন হল দেশ। চারদিকে হৈ চৈ পডে় গেল। কিন্তু দেশের অবস্থা তখন অবনতির চরমে পৌছে গেছে। তার অল্পকাল পরেই ভাইযে়র ডাকে সাড়া দিযে় পাডি় দিযে়ছেন লন্ডনে। কিছুদিন হল দেশে ফিরে আজ দাঁড়াতে হযে়ছে এই মঞ্চে।
বলতে বলতে নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো আবার দপ করে জ্বলে উঠলেন তিনি। আপনারা কি দেখতে চান সেই কাপুরুষ রাজাকারটাকে? যে সেদিন আমার স্বামীর হাত দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছিল পাকিস্তানী হায়নাদের সামনে।
ফাতেমার চিৎকারে মঞ্চে যেন একটা বজ্র পড়ল। জনতার উৎসুক চোখ তখন ফাতেমার দিকে। সমস্ত ময়দান জুডে় পিনপতন নিরবতা নেমে এলো।
ফাতেমা তেমনি অগ্নিমূর্তি নিযে় সরাসরি আঙ্গুলি ইশারা করলেন এমপি সাহেবের দিকে।
এমপি সাহেব মাথা নিচু করলেন। উপস্থিত জনতার চোখের দৃষ্টিতে দলাদলা ঘৃণা তার মাথার ওপর পড়তে থাকল।

Comments

comments

About

Check Also

বিদায়বেলা

জামুরাইল হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক ইমরান হোসেন। প্রতিদিন সকাল ৯ টায় স্কুলে আসেন। যথারীতি তিনি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *