ভয় হোক জয়

পড়ন্ত বিকেল। গাঁয়ের উত্তরের মাঠ। ছেলেরা কেউ কেউ বাড়ি ফিরছে, কেউ কেউ এখনও খেলছে।
প্রতিদিনের মতো আজও আদনান মাঠের একপাশে ঘাসের উপর বসে আছে। সাথে রনিও। বয়েসে রনি আদনানের চেয়ে চার বছরের ছোট হলেও তার সুন্দর কথার চমক আদনানের ভীষণ প্রিয়। তাই প্রতিদিন বিকেলে এই মাঠে এসে দুজনে গল্প জুড়ে দেয়। আদনান শান্ত স্বভাবের ছেলে। হৈ হুল্লোড় একদম ভালো লাগেনা। কিন্তু বিকেলের এই জনাকীর্ণ সময় এ জায়গাটা সে উপভোগ করে রনির সঙ্গপ্রিয়তার জন্যেই। তাদের প্রতিদিনকার গল্পে দুজনের দুই স্কুল ও বাড়ির নিত্যনতুন ঘটনাই মূখ্য থাকে। কিন্তু আজ রনিকে সে এক প্রস্তাব দেয়।
-রনি! চলো কাল মেলা থেকে ঘুরে আসি।
-রনি চমকে উঠে। মুহূর্তেই কী রকম হয়ে যায় তার চোখ-মুখ। প্রশ্ন করে
-বৈশাখী মেলা থেকে?
-হ্যাঁ।
-না, ভাইজান। মেলায় যাবো না আমি।
-কেন?
-বৈশাখ নামক এই রাক্ষুসীকে ভয় পাই আমি।
-ভয় পাও?
-হুমম।
-কিন্তু কেন রনি?
-এই বৈশাখ ঘর ভাঙে ভাইজান, স্বপ্নও ভাঙে।
-কী বলো? কার ঘর ভাঙলো? স্বপ্নই বা কার ভাঙলো?
-আমাদের ঘর, আমাদের স্বপ্ন।
-আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো তুমি।
-গেলো বছর আমরা চার ভাইবোন মিলে বাবার কাছে আবদার করলাম বৈশাখী মেলাতে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু বাবা রাজি হচ্ছিলেন না। বারবার বলছিলেন মেলাতে যেতে নেই। আমরা কি আর ওসব শুনি! বাবাকে বারবাার মিনতি করার পর শেষমেশ রাজি হলেন। বললেন পরের শনিবার আমাদেরকে নিয়ে যাবেন। আমাদের তর সইছিলো না। বললাম-না বাবা, আমরা আজই যাবো। বাবা বুঝিয়ে বললেন তাঁর কাছে টাকা নেই। এই চারদিনে তিনি কিছু বাড়তি টাকা জোগাড় করবেন। তারপর আমাদেরকে নিয়ে যাবেন। আমরা আর কিছু না বলে বাবার কথা মেনে নিলাম।

-তারপর?
-চার ভাইবোন মিলে গুণতে থাকলাম দিন। শুক্রবার রাতে খাবার খেয়ে সবাই ঘুমোতে গেলাম। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। চোখ বুজলেই মেলায় অদেখা দৃশ্যগুলো চিরচেনা হয়ে চোখে ভর করে। বাঁধভাঙ্গা খুশিতে ঢলতে ঢলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ শো শো শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখি বাবা আর মা বসে আছেন। মা বিড়বিড় করে কি যেন জপছিলেন। আমি কিছু আন্দাজ করতে না পেরে উঠে বসলাম। ঠিক তখনই ঘরের চালার ফুটো দিয়ে আলো এসে সমস্ত ঘর ফর্সা হয়ে গেলো। মনে হলো বাহির থেকে কেউ একজন আমাদের ঘর বরাবর টর্চ জ্বালিয়েছে। দু সেকেন্ডের মধ্যে আকাশ গর্জে উঠলো। আমার বুঝতে আর বাকি নেই যে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বজ্রপাত হচ্ছে। সেই সাথে ঝড়ও। আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আরও জোরে জোরে দোয়া পড়ছিলেন আর আমাদেরকে বলছিলেন ভয় পেয়ো না। আল্লাহকে ডাকো, তাঁর উপর ভরসা রাখো।
-ঝড় থেমেছিলো?
না। বরং বৈশাখ কালবৈশাখীতে রূপ নিলো। মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে নিলো ঘরের চাল। তছনছ করে দিলো সব। বাবা আমাদেরকে চৌকির নিচে ঢুকিয়ে বেড়ার একপাশ ঝাপটে ধরে রইলেন যাতে অন্তত এ পাশটা রক্ষা হয়। কিন্তু রাক্ষুসী বৈশাখ কী বুঝে? উড়িয়ে নিলো এপাশটাও। একটা টিন এসে বাবার পায়ে পড়তে পায়ের অনেকখানি অংশ কেটে গেলো। আমরা চিৎকার করতে করতে চৌকির নিচ থেকে বের হয়ে বাবার কাছে গেলাম। মা কাপড়ের এক টুকরো অংশ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাবার পা বেঁধে দিলেন। নিরূপায় হয়ে বাবাসহ সবাই আবার চৌকির নিচে আশ্রয় নিলাম। সে রাতে বৈশাখ ইচ্ছেমতো ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলো। ভোরে জানতে পারলাম বৈশাখ গ্রামের অনেকের ঘর ভেঙে গেছে, অনেক ক্ষতি করে গেছে। সেই থেকে খুব ভয় পাই বৈশাখকে।
-ওহ!এটা খুবই দুঃখের ব্যাপার রনি। কিন্তু তোমার বাবার পা কেটে গিয়েছিল বললে তাহলে তোমাদের ঘর আবার তৈরি হলো কিভাবে?
-বাবার সাথে যারা কাজ করেন তাঁরা অনেকেই পরদিন খবর পেয়ে আসেন। তাঁদের সহযোগিতায় বাবা আবার ঘর বানান আগের চেয়ে মজবুত করে।
-হুমম। মেলাতে তাহলে তোমরা যাও নি?
-কী যে বলো! রাক্ষুসী বৈশাখ কী আর যেতে দিলো? ঘর ভাঙার সাথে আমাদের স্বপ্নটাও ভেঙে গেলো।
-এভাবে বলতে নেই রনি। বৈশাখ রাক্ষুসে হয়না। আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভিত্তিতে বছরটা বারো মাসের। প্রতিটা মাস নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান। তুমি দেখো না যে আষাঢ় শ্রাবণ এলে মাঠ ঘাট পানিতে থৈ থে করে, পৌষে হাড়কাঁপা শীত ধরে। একেক মাসে একেক রূপ ধারণ করে প্রকৃতি। বৈশাখকে এতো ভয় পাবার কিছু নেই। আর বৈশাখ ঘর ভাঙছে তো কী হয়েছে, তোমাদের মন তো আর ভাঙেনি। মনোবল তো আর ভাঙেনি। বরং আরো সংগ্রামী করে গেছে। যার ফলে তোমরা ঝড়ের পরের দিনই আবার ঘর নির্মাণ করেছো। তুমিই তো বললে সে ঘর মজবুত করে বানিয়েছো যাতে বৈশাখ আর হানা দিতে না পারে। অথবা দিলেও সফল হতে না পারে।
-হুমম।
-জীবনযুদ্ধেও বৈশাখের মতো এমন অসংখ্য দুঃসময় আসে। কিন্তু ভেঙে পড়লে চলেনা। মনোবল আরো বাড়াতে হয়। শক্ত মনে প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হয় যেমন করে তোমার বাবা করলেন। বুঝতে পারলে আমার কথা?
-হ্যাঁ, ভাইজান। কিন্তু তবুও ভয় হয়।
-একদম ভয় না আর। ফাগুনের দক্ষিণা বাতাস ও ফুলের সুবাস নিতে হলে কৌশল ও দৃঢ় মনোবলের সাথে বৈশাখের মোকাবেলা করতে হবে।
-(মনে স্বস্তি এনে)ঠিক আছে ভাইজান। আর ভয় পাবো না বৈশাখকে।
-এই তো বীরদের মতো কথা বলছো।
-কিন্তু ভাইজান মেলাতে যাবার কথা ভাববোও না আর। শপথ করছি।
-(মুচকি হেসে)আচ্ছা। চলো মসজিদে যাই। মাগরিবের আযান হচ্ছে।
হুমম। চলুন ভাইজান বলে দুজনে মসজিদের দিকে হাঁটতে লাগলো।

Comments

comments

About

Check Also

কারবালার শিক্ষা

শাফীর বয়স বারো পেরুলো। ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা ওকে সব সময় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *